নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ও বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রদান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত ক্ষোভের জেরে তাকে নানাভাবে হয়রানি করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। সেই সরকারের পদচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবৈধ কাজের কূটকৌশলের অন্যতম সহযোগী ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বৈষম্য নিরসনে এই স্বৈরাচারী চেয়ারম্যানের পদত্যাগ ও প্রশাসনমুক্ত এনবিআরের দাবি তুলেছেন সংস্থাটির সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
গতকাল বুধবার এনবিআর ভবনে স্বৈরাচারী চেয়ারম্যানের দপ্তরের সামনে ক্ষোভ প্রকাশ করেন সংস্থাটির সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এসময় দেওয়া বক্তব্যে ভীতি প্রদর্শন, নিয়োগে অনিয়ম, বদলি-পদায়ন ও পদোন্নতি বাণিজ্য, অবসরকালীন সুবিধা বঞ্চিত করা, পাচার ও লুণ্ঠনে সহায়তা সহ নানা অনিয়মের কথা তুলে ধরা হয়।
এছাড়া তার নামফলক খুলে ফেলে সেখানে লেখা হয়েছে ‘ড. ইউনুসকে একের পর এক মামলা দিয়ে হয়রানীকারী স্বৈরাচার’। এনবিআর ভবনের মূল ফটকের সামনে একই লেখার সঙ্গে তার ছবি জুড়ে দিয়ে জুতার মালা পরিয়ে দেওয়া হয়।
এনবিআরের মূসক নীতির সদস্য হোসেন আহমেদ বলেন, আমাদেরকে পুতুল বানিয়ে রাখা হয়েছে।
প্রতিটি ন্যয়সংগত কথা বলতে গেলে খারাপ ব্যবহার করা হয়েছে। কথা বলতে দেওয়া হয়নি। শেখ হাসিনা সরকারের অলিগার্ডেরা হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। সে বিষয়ে কথা বললে এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দিয়েছে।
এই পাচার প্রতিরোধে কোন পদক্ষেপ নিতে দেওয়া হয়নি। বিষয়গুলো উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের পুরো প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে। এনবিআরের সদস্যকে এখন চেয়ারম্যানের সিপাহীর পর্যায়ে চলে গেছে। অন্য ক্যাডারের (অ্যাডমিন) লোকজন এসে কিভাবে এনবিআর চালাবে?
এনবিআর সদস্য (পিআরএলে) ড. হুমায়ুন কবির বলেন, এনবিআর একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান।
এই প্রতিষ্ঠান সঠিকভাবে চালাতে হলে আয়কর অথবা কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দিতে হবে।
তিনি বলেন, স্বৈরাচারী সরকারের দোসর এই এনবিআর চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনুসের মতো মানুষের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। সরকারের পদলেহন করেছে। অথচ টাকা পাচারকারী, ব্যাংক লুটপাটের সংঙ্গে যারা জড়িত ছিলো, তাদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়নি।
এনবিআর সদস্য ড. সহিদুল ইসলাম, অতিরিক্ত কমিশনার সাধন কুমার কুন্ডু সহ শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী স্বৈরাচার চেয়ারম্যানের পদত্যাগের পক্ষে স্লোগান দেন।
বক্তরা বলেন, এই চেয়ারম্যানের সময়ে সরকারের বিভিন্ন অসাধু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, দলীয় ব্যক্তি দেখে রাষ্ট্রীয় করছাড়ের সুবিধা দেওয়া ও কথায় কথায় নিজে ও তার সহযোগীদের মাধ্যমে হুমকি ও ভয় দেখানোর কাজ করতেন তিনি। যারা এই কাজে তার সহায়তা করতেন-কর প্রশাসনের প্রথম সচিব মো. শাহিদুজ্জামান, শুল্ক ও ভ্যাট প্রশাসনের প্রথম সচিব ঈদতাজুল ইসলাম ও সাবেক বোর্ড প্রশাসনের প্রথম সচিব গাউসুল আযম। এনবিআর চেয়ারম্যানের পাশাপাশি তার এই সহযোগীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান তারা।
আজ বৃহস্পতিবার এনবিআরের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এনবিআর ভবনে ন্যায্য দাবীর বিষয়ে কর্মসূচীর ঘোষণা দেবেন ও অবস্থান কর্মসূচী পালন করবেন বলে জানা গেছে। শিগগির একটি স্মারকলিপি নতুন সরকার প্রধানের কাছে পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন তারা।
পদত্যাগের গুঞ্জণ
সকাল থেকেই গুঞ্জণ ওঠে চেয়ারম্যানের পদত্যাগের। চেয়ারম্যান ঘনিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সকালের দিকেই পদত্যাগপত্রসহ অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে যান মুনিম। সেখানে রাষ্ট্রপতির কাছে নিজের পদত্যাগপত্র হস্তান্তর করবেন তিনি। তবে মুনিমের মুঠোফোনে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
পরবর্তীতে তার পিএস উপসচিব মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, পদত্যাগ করার কোনো বিষয় নেই। এটা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। এই চুক্তি সরকার বাতিল করতে পারে আর স্যার (এনবিআর চেয়ারম্যান) যদি বাতিল করতে চায়, তাহলে আবেদন করবেন তার এক মাস পর থেকে কার্যকর হবে। চুক্তি বাতিল করার স্যারের কোন ইচ্ছা নেই। এক্ষেত্রে সরকার যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেটাই চুড়ান্ত।
দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের নয় দফা দাবি
এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণ সহ নয় দফা দাবি জানিয়েছে সংস্থাটির ১০ম থেকে ২০তম গ্রেডের কর্মচারীরা। দাবিগুলো হলো- প্রশাসন ক্যাডার থেকে প্রেষণে এনবিআরে পদায়ন না করা, আয়কর অথবা কাস্টমস ক্যাডার থেকে চেয়ারম্যান নিয়োগ, দুই বছর পর বদলি বাণিজ্য বন্ধ করা, অবৈধ নিয়োগ ও আউটসোসিং পদ্ধতিতে নিয়োগ বাতিল, পদায়ণে জৈষ্ঠতা বিধিমালা ও আইন অনুসরণ, শূন্য পদে পদোন্নতি ও কোন পদ খালি না রাখা, এসাসিয়েশনের সঙ্গে পরামর্শ করে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সিদ্ধান্ত নিতে হবে ও আয়কর অনুবিভাগের সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র আয়কর বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই করবে।
যেভাবে ড. ইউনুসের পেছনে লাগেন মুনিম
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে গণঅভ্যূত্থানে পদত্যাগে বাধ্য হওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন সবসময় প্রতিহিংসাপরায়ণ। নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান গ্রামীন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) পদ থেকে অব্যাহতি, সর্বোচ্চ আদালতকে দলীয়করণ করে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে ব্যবহার ও হয়রানি, পদ্মা সেতুর বিদেশি ঋণ বাতিলে তাকে দায়ী করা, সেতু উদ্বোধনের পর তাকে নিয়ে বিরুপ মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা।
এরপর স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের অন্যতম দোসর আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম তার বিরুদ্ধে কর ফাঁকির ইস্যু তোলেন। তার পরামর্শে শেখ হাসিনা কর ফাঁকির মামলা দ্রুত চালাতে নির্দেশ দেন। ২০২৩ সালে ড. ইউনুসের বিরুদ্ধে ১২ কোটি টাকা কর ফাঁকি প্রমাণ হওয়ায় এনবিআরকে টাকা পরিশোধের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এরপর চলতি বছর ৬৬৬ কোটি টাকা কর ফাঁকি ইস্যুতে আবারও ড. ইউনুসকে আদালতের শরনাপন্ন করেন মুনিম।
এ জাতীয় আরো খবর..