×
  • প্রকাশিত : ২০২৪-০৮-১৮
  • ৪৫ বার পঠিত
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক উপদেষ্টা, বিরূপাক্ষ পালের একটি মন্তব্য দিয়ে না হয় আজকের নিবন্ধটি শুরু করা যাক। তিনি বলছেন, ‘ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বাইরের রূপ কোটাবিরোধিতা হলেও এর ভেতরের কারণ অর্থনীতি থেকেই উৎসারিত। এদের শাস্ত্রের ভাষায় বলা হয় অর্থনীতির দুই পাপ—বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি। এ দুই পাপকে যদি আওয়ামী লীগ সরকার মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারত, তাহলে তাদের এই দুর্ভাগ্যজনক বিদায় ঘটত না।

তৃণমূল থেকে উঠে আসা একটি রাজনৈতিক দল শেষতক গোয়েন্দা আর ব্যবসায়ী নির্ভর হয়ে পড়ল।’ প্রসঙ্গত মনে পড়ল কিছুদিন আগে এক দৈনিকে আমার লেখার শিরোনাম দিয়েছিলাম এ রকম, ‘কোটা নয় গোটা গল্প’। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের তীব্রতায় জ্বালানি জুগিয়েছিল তরুণদের অন্তরে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ এবং অভিযোগ; যথা—লাগামহীন মূল্যস্ফীতি, শিক্ষিত বেকারত্ব ৪০ শতাংশ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনাচার, নির্বাসিত ছাত্রসংসদ নির্বাচন, বঞ্চিত ভোটাধিকার, রুদ্ধ বাকস্বাধীনতা, বেশুমার দুর্নীতি, ঋণখেলাপি ইত্যাদি।

বিগত সরকার অতিমাত্রায় ব্যবসায়ী ও আমলা নির্ভর ছিল বলে বিজ্ঞমহলে সমালোচনা হতো। বিরূপাক্ষের মতে, ‘যদি গোয়েন্দা আর ব্যবসায়ীরাই কোনো শাসকের স্থিতি নিশ্চিত করতে পারত, তাহলে কোনো সামরিক শাসনেরই ইতি ঘটত না। বাংলাদেশের ইতিহাসে ক্ষমতার শুরু আর শেষ—দুটিই ছাত্র-জনতার হাতে। যে সরকার আসবে, গোয়েন্দারা তাকেই অবুদ্ধি দেবে।

আর ব্যবসায়ীরা এরই মধ্যে ভোল পাল্টে ফেলেছে।’

দুই.

বর্তমান নিবন্ধের মূল লক্ষ্য বেহাল অর্থনীতিকে কিভাবে হাল বা সঠিক অবস্থায় আনা যায় সে বিষয়ে দু-একটি কথা বলা। তবে বিদেশি ঋণ নির্ভরতার দোহাই দিয়ে অর্থনীতির নাজুকতার যে চিত্র চাউর হচ্ছে গুজবের ডালপালা বেয়ে, তা যথার্থ নয়। যা হোক, অর্থনীতির স্বাস্থ্য খুব খারাপ, এটিই মূলকথা। অস্থিতিশীল একটি অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার বিষয়টি সময়সাপেক্ষ সন্দেহ নেই, তবে তাই বলে একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে আগেও যেমন নিরপেক্ষ উপদেশ দিতাম, এখনো তা-ই করার প্রয়াস নেব।

সুখের কথা এই যে বর্তমান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এই দুজনই মূলস্রোতের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ। এর আগেও এমন একটি জুটি—যথাক্রমে শাহ এ এম এস কিবরিয়া ও মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন অর্থনীতিকে একটি গ্রহণযোগ্য অবস্থায় রাখতে পেরেছিলেন বলে আমরা আশায় বুক বাঁধতে পারি। এখনকার উপদেষ্টা ও গভর্নর বিগত সরকারের আমলে অর্থনৈতিক ডাক্তার হিসেবে তৎকালীন গৃহীত নীতিমালার তীব্র ইতিবাচক সমালোচক ছিলেন, এখন তাঁরা নিজেরাই নীতিনির্ধারক বিধায় অর্থনীতির সুচিকিৎসা প্রত্যাশার বাইরে নয় নিশ্চয়।

তিন.

মজার কথা, প্রকৃত এবং সৎ অর্থনীতিবিদরা সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভোল পাল্টাতে পারেন না। ডাক্তার ও অর্থনীতিবিদ একই গোত্রের—“ভালো ডাক্তার যেমন শরীরের সমস্যার কথা বলেন, অর্থনীতিবিদরাও তেমন শরীররূপী অর্থনীতির সমস্যাগুলোর ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক করে থাকেন। সেগুলো অনেক সময় রাজনৈতিকভাবে উপাদেয় নয় বলে অর্থনীতিবিদরা সরকারের শত্রুপক্ষে পরিণত হন। কখনো কখনো তাঁদের তাচ্ছিল্যের সুরে ‘সুশীল’ বলে বিদ্রুপ করা হয়।” তবে অর্থনীতিবিদদের উচিত হুজুরদের মতো ওয়াজ করে যাওয়া, স্বর্গ ও নরকের যাওয়ার নিয়ামক সম্পর্কে ধারণা দেওয়া—কে শুনল বা না শুনল, তা যেমন হুজুরের বিবেচ্য বিষয় নয়, তেমনি অর্থনীতিবিদের নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ কে পাত্তা দিল বা না দিল, তা দেখার বিষয় নয়। কথায় আছে, যেমন বপন তেমন ফসল—এজ ইউ সো, সো ইউ রিপ।

চার.

বিগত এক মাসের মধ্যে ঘটে যাওয়া আন্দোলন এবং তার দমন ঘিরে অর্থনীতির ক্ষতির দিকটায় চোখ বোলানো যাক। বিভিন্ন উৎস থেকে কয়েক দিন আগে সংগৃহীত তথ্য ছিল নিম্নরূপ :

১. দেশের অর্থনীতির প্রতিদিন এক বিলিয়ন ডলার করে গড়ে ছয় বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে; ইন্টারনেট পুরোপুরি সচল না হওয়ায় ক্ষতির অঙ্ক বেড়ে সাত বিলিয়ন ডলারও হতে পারে, টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি।

২. সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, তৈরি পোশাক, যোগাযোগ, ই-কমার্স, পর্যটনসহ স্থানীয় উৎপাদনমুখী খাত। এ সময়ে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় রপ্তানিকারকদের। কাজ হারিয়েছেন ফ্রিল্যান্সাররা, সঙ্গে গ্রাহকও। এবং তার সঙ্গে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে যারা দিন আনে দিন খায় তারা। এর বাইরে যারা ধনী, তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; বিশেষ করে যাঁরা উদ্যোক্তা, তাঁদের কলকারখানা বন্ধ থাকার পরও বেতন দিতে হবে। সাপ্লাই চেইনে চরম ব্যাঘাত ঘটেছে। এর চ্যালেঞ্জ এখন বহুমুখী। টেকসই সমাধান না হলে আবার কী হয়, সে চিন্তা তো সবার আছেই।

৩. শুধু কড়াকড়ি কারফিউয়ের পাঁচ দিনে সাত বিলিয়ন ডলারের মতো ক্ষতি হয়েছে। তার মানে দিনে এক বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে।

৪. বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রা আয়ের বড় অংশীদার পোশাক খাত। মোট রপ্তানি আয়ের ৮৫ শতাংশই আসে পোশাক রপ্তানির মাধ্যমে। বাংলাদেশের চলমান অস্থিরতার কারণে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় চার দিনে ছয় হাজার ৪০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করেন এই খাতের ব্যবসায়ীরা।

৫. টাকার অঙ্কের চেয়েও আমাদের ইমেজের ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। জ্বালাও-পোড়াও, মেট্রো রেলে ধ্বংসলীলাসহ এত হিংসাত্মক ঘটনার কারণে আমাদের ক্রেতারা অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে গেছে। বিশ্বে আমাদের যে শান্তিপূর্ণ ও ব্যাবসায়িক পরিবেশের ইমেজ ছিল, সেটি ক্ষুণ্ন হয়েছে। এখন যত দিন না আমরা তাদের দেখাতে পারব যে সব স্বাভাবিক, তত দিন আমরা উদ্বিগ্ন।

৬. উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বাংলাদেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। ২৮ মাসের ওপরে দেশের গড় মূল্যস্ফীতির চেয়ে গড় মজুরি কম; অর্থাৎ মানুষের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। অর্থনীতির পরিভাষায় গড় মজুরির চেয়ে গড় মূল্যস্ফীতি বেশি হলে সেটি দেশের অর্থনীতির দুরবস্থাকেই ইঙ্গিত করে। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা উদ্যোগও ব্যর্থ।

পাঁচ.

মোটকথা বাংলাদেশের অর্থনীতি গভীর খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে বললে সম্ভবত অত্যুক্তি হবে না।

এক. অতি দ্রুত আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হবে। আমরা আশান্বিত যে প্রায় ভঙ্গুর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমেই উন্নতি ঘটছে এবং প্রথমবারের মতো নিয়োজিত বাহিনীর সঙ্গে তরুণরাও সক্রিয় হয়ে অবদান রাখছে। প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন কিংবা লাইনচ্যুত ট্রেন টেনে তোলা ইত্যাদি যা-ই বলি না কেন, এর পূর্বশর্ত হচ্ছে যথাযথ আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনা, যেখানে আইনের শাসন বলবৎ থাকবে, শাসনের আইন নয়।

দুই. লাগামহীন মূল্যস্ফীতি রোধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। অনেকের ধারণা, প্রকৃত মূল্যস্ফীতির হার ১২ থেকে ১৫ শতাংশ। এই মূল্যস্ফীতির পেছনে অন্যতম প্রধান চালক চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেট। খুব ক্ষুদ্র উদাহরণ হলেও বাজারের কারসাজি তথা মূল্য নিয়ন্ত্রণে ছাত্রদের সাম্প্রতিক উদ্যোগগুলো কিভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া যায় সেদিকে লক্ষ রাখা জরুরি। নীতিনির্ধারকদের প্রথম কাজ হবে চাঁদাবাজি বন্ধ করা এবং যথাযথ তদারকির মাধ্যমে বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করা।

তিন. ব্যাংকিং খাতে যে লুটেরা শ্রেণির সৃষ্টি হয়েছে—এক হিসাবে গেল দেড় দশকে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা লোপাট—তাদের কুশীলবসহ আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি সময়ের দাবি। একই কথা পুঁজিবাজারের ক্ষেত্রেও সত্যি। মরা এবং খোঁড়া ব্যাংক জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বাঁচিয়ে লাভ নেই।

চার. আপাতত  প্রবৃদ্ধির চিন্তা না করে আগে অর্থনীতির চাকা সচল করতে হবে—যা আছে, তা ঠিকমতো চলছে কি না, সেটি আগে নিশ্চিত করতে হবে। এবং সব শেষে দুর্নীতি এবং অর্থপাচার, বছরে প্রায় সাত বিলিয়ন ডলার, রোধে চলমান কিছু পদক্ষেপ বেগবান করা এবং নবধারামূলক উপায়ে দুষ্কৃতকারীদের আইনের আওতায় এনে অর্থ উদ্ধার করা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করা যায়। এবং শপথবাক্যের প্রতিটি শব্দের প্রতি সম্পূর্ণ সমর্পিত হয়ে, যতটুকু সম্ভব, একটি নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সুফল এনে দিতে পারে। মনে রাখা জরুরি, এ দেশের মাটি যেমন নরম কাদা, তেমনি শক্ত; এ দেশের মানুষ যেমন বুকে টেনে নেয়, তেমনি ছুড়ে ফেলে দিতে দ্বিধা বোধ করে না।

পাঁচ.

রাজনীতিবিদ ও অর্থনীতিবিদরাই সমাজের বেশির ভাগ বিষয়ের ভাগ্য নির্ধারণ করে থাকেন, এর বাইরে অতি অল্প লোকই প্রভাবক হতে পারে—সে কথা বহু আগে বলেছিলেন জন এম কেইন্স। প্রসঙ্গত কেইন্স দেখেছেন, রাজনীতিকরা তাঁর কথা শুনতে আসেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল অর্থনীতিবিদদের ডাকতেন, কথা শুনতেন এমন ধারণা বহুবিস্তৃত। এমনকি চার্চিল নাকি একবার গর্ব করে বলেছিলেন, “ব্রিটিশদের ‘কমনসেন্স’ উত্তম। তার প্রমাণ আমাদের কেইন্স।” বাংলাদেশের জন্মের আগে ও পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদদের কথা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতেন, বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন সাজিয়েছিলেন বিদগ্ধ সমাজবিজ্ঞানী দ্বারা। তাঁর নির্মম হত্যার পর যাঁরাই ক্ষমতায় এসেছেন তাঁরা, এমনকি তাঁর কন্যাও অর্থনীতির সমালোচকদের সমীহের চোখে দেখতেন না বলে অভিযোগ আছে। দুর্ভাগ্য আমাদের যে এই সমাজে রাজনীতিবিদ-অর্থনীতিবিদদের সম্পর্ক অনেকটা দা-কুমড়ার মতো, যেখানে অর্থচিন্তকদের অবস্থা কুমড়ার মতো—শুধু অবজ্ঞা আর আঘাতের শিকার।

পাদটীকা

বাংলাদেশের তথা বিশ্বের ইতিহাসে বোধ করি এই প্রথম একটি দেশের প্রধান উপদেষ্টা (প্রধানমন্ত্রী), অর্থ উপদেষ্টা (অর্থমন্ত্রী) এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর তিনজনই প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ। এমন একটি দেশের অর্থনীতি অতি দ্রুত ত্বরান্বিত প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের পথে হাঁটবে বলে আপাতত হতাশার সুযোগ কম।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, সাবেক উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat