সর্বজনীন পেনশন স্কিম (প্রত্যয়) ঘোষণার পর থেকেই ক্ষোভে ফুঁসছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। এটি বাতিলের দাবিতে মানববন্ধন, অর্ধদিবস কর্মবিরতির মতো কর্মসূচি পালন করেছেন তারা। কিন্তু শিক্ষকদের দাবি উপেক্ষা করে সোমবার থেকে ‘প্রত্যয় স্কিম’ চালু করেছে সরকার। প্রতিবাদে এ দিন থেকেই অনির্দিষ্টকালের জন্য সর্বাত্মক কর্মবিরতি শুরু করেছে দেশের ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। এতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস-পরীক্ষার পাশাপাশি প্রশাসনিক ও দাপ্তরিক কাজ, সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামসহ সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ থাকে লাইব্রেরিও। ফলে অচলাবস্থায় পড়েছে দেশের উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে চরম ভোগান্তির শিক্ষার শিক্ষার্থীরা। তারা সেশনজটের আশঙ্কা করছেন। তবে শিক্ষকরা বলছেন, তারা পরবর্তীতে বিশেষ ক্লাস নিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে দেবেন। এদিকে চলমান আন্দোলনের বিষয়ে কোনো ধরনের উদ্যোগ নেয়নি সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায়ের কেউ। এতে সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে বলে মনে করছেন শিক্ষকরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বলছেন, প্রত্যয় স্কিমে মূল বেতন থেকে ১০ শতাংশ অর্থ কেটে নেওয়া হবে। যেটা আগে কাটা হতো না। এ স্কিমে আনুতোষিক শূন্য। বর্তমানে পেনশনার ও নমিনি আজীবন পেনশনপ্রাপ্ত হন; কিন্তু নতুন এ স্কিমে পেনশনাররা ৭৫ বছর পর্যন্ত পেনশন পাবেন। বিদ্যমান পেনশনব্যবস্থায় ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট পাওয়া যায়, সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থায় সেটা সুস্পষ্ট করা হয়নি। সব থেকে বড় বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদকাল ৬৫ থেকে ৬০ বছর করা হয়েছে। মাসিক চিকিৎসাভাতা, উৎসবভাতা, বৈশাখী ভাতা নতুন প্রত্যয় স্কিমে প্রদান করা হবে না।
তারা আরও বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য যে প্রত্যয় স্কিম আরোপ করা হয়েছে, তা তাদের পারিবারিক সুরক্ষা নষ্ট করছে। এ প্রত্যয় স্কিমের ফলে মেধাবীরা আর শিক্ষকতা পেশায় আসতে আগ্রহী হবে না। আর তাই সর্বজনীন পেনশন স্কিম বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। তারা ‘প্রত্যয় স্কিম’ থেকে শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি প্রত্যাহার, স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন ও প্রতিশ্রুত সুপারগ্রেডে অন্তর্ভুক্তির দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন।
জানা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত ও সংবিধিবদ্ধ অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রত্যয় স্কিমের অন্তর্ভুক্ত করেছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, চাকরিতে যেসব কর্মকর্তা বা কর্মচারী চলতি বছরের ১ জুলাইয়ের পর যোগ দেবেন, সরকার তাদের সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্ত করবে। স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা ও তাদের অধীন অঙ্গপ্রতিষ্ঠান মিলে প্রায় ৪০০ সংস্থা রয়েছে। যেখানে কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন ৪ লাখের বেশি। এ ধরনের সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়।
রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন ফটকে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির ঘোষণা দেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. নিজামুল হক ভূঁইয়া। এরপর সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা একে একে কর্মবিরতির ঘোষণা দেন।
এক প্রশ্নের জবাবে সোমবার অধ্যাপক ড. নিজামুল হক ভূঁইয়া যুগান্তরকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের সঙ্গে এখন পর্যন্ত কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। বৈষম্যমূলক ও মর্যাদাহানিকর প্রত্যয় স্কিম থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি প্রত্যাহার, শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতনস্কেল প্রবর্তন এবং প্রতিশ্রুত সুপার গ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তির দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব।
ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকলে শিক্ষার্থীদের সেশনজটে পড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, শিক্ষক হিসাবে অবশ্যই শিক্ষার্থীদের কথা আমাদের বিবেচনায় রয়েছে। আন্দোলনের কারণে শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি হচ্ছে তা অনলাইন ক্লাস ও বিশেষ ক্লাস নিয়ে পুষিয়ে নেব।
তবে শিক্ষকদের এই আন্দোলনে ক্ষোভ জানিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। মাইনুল ইসলাম নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনের সময় শিক্ষকদের পাশে পাওয়া যায় না। তখন তারা জোর করে শিক্ষার্থীদের ক্লাস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করেন। আর যখন তাদের স্বার্থে আঘাত লাগল তারা ক্লাস পরীক্ষা সব বন্ধ করে দিয়েছে। এতে করে আমরা বড় ধরনের সেশনজটে পড়ার আশঙ্কা করছি।
বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সোমবার শিক্ষক আন্দোলনের খবর পাঠিয়েছেন ব্যুরো ও প্রতিনিধিরা-
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : সকালে ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস ও পরীক্ষা হচ্ছে না। শিক্ষক সমিতির কর্মসূচি ক্যাম্পাসজুড়ে পালিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারও বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে কর্তৃপক্ষের কর্মসূচিতে শিক্ষকদের অংশ না নেওয়ার যে ঘোষণা অধ্যাপক জিনাত হুদা দিয়েছিলেন, তা কার্যকর হয়নি। শিক্ষক সমিতির নেতাসহ শিক্ষকদের অনেকেই টিএসসিতে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজনে অংশ নেন। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. নিজামুল হক ভূইয়া ও সাধারণ সম্পাদক জিনাত হুদা অনুষ্ঠানে ছিলেন না। কলা ভবনের গেটে আয়োজিত অবস্থান কর্মসূচিতে অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বলেন, আধুনিক ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে প্রধানমন্ত্রীর হাতকে শক্তিশালী করার জন্যই আমাদের এই আন্দোলন। এই আন্দোলন ততক্ষণ পর্যন্ত চলমান থাকবে যতক্ষণ না ওই বৈষম্যমূলক প্রত্যয় স্কিম প্রত্যাহার না করা হবে। সেই সঙ্গে ২০১৫ সালে আমাদের যে সুপার গ্রেড দেওয়ার কথা ছিল সেটা চালু করতে হবে। আমাদের জন্য স্বতন্ত্র পে-স্কেল চালু করতে হবে। তিনি বলেন, আজকের এই সর্বাত্মক আন্দোলন শুধু আমাদের জন্য নয়, এটা শিক্ষার্থীদের জন্য, আগামী প্রজন্মের জন্য, শিক্ষাব্যবস্থার জন্য।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় : বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নেতৃত্বে কর্মবিরতি পালন করেন শিক্ষকরা। দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত ক্যাম্পাসে অবস্থান কর্মসূচিও পালন করেন তারা। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. শেখ মাশরিক হাসান বলেন, পেনশন স্কিম বাতিলে আমাদের যে আন্দোলন, এটা আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্যই। কারণ নতুন পেনশন স্কিমে বর্তমান শিক্ষকদের কোনো ক্ষতি হবে না, যেসব মেধাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতা পেশায় আসবে তাদেরই ক্ষতি হবে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন অ্যাকাডেমিক ভবনের সামনে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় : বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির উদ্যোগে বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাউন্ড ফ্লোরে কর্মবিরতি আন্দোলন শুরু হয়ে চলে দুপুর ১টা পর্যন্ত। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলে জানিয়েছেন সমিতির সভাপতি ড. মোহাম্মদ আবদুল বাতেন চৌধুরী।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় : প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। এতে সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবু তাহের বলেন, শিক্ষক সমিতি শিক্ষকদের সার্বিক মঙ্গলের জন্য আন্দোলন করছে, কারও ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য নয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় : সকাল ৯টা থেকে সর্বাত্মক কর্মবিরতি শুরু করেন শিক্ষকরা। এ বিষয়ে জাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মোতাহার হোসেন বলেন, আমাদের তিন দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সর্বাত্মক কর্মবিরতি চালিয়ে যাব।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় : বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি কার্যালয়ে বেলা ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষকরা। বৃষ্টির কারণে তারা বাইরে আন্দোলন করতে পারেননি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় : কর্মবিরতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের ভর্তি কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। সোমবার বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক অধ্যাপক প্রণব কুমার পান্ডে স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় : বেলা ১২ থেকে ১টা পর্যন্ত প্রথমে শিক্ষক কমপ্লেক্সে এবং পরে প্রশাসনিক ভবন সংলগ্ন করিডোরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষকরা। কর্মবিরতি ও প্রতিবাদসভা করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩য় শ্রেণি কর্মচারী পরিষদ ও কারিগরি কর্মচারী পরিষদ। এদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ক্লাস-পরীক্ষা হয়নি। লাইব্রেরি ও ল্যাবরেটরিও বন্ধ ছিল।
এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নেত্রকোনা শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহের ত্রিশালে কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইলে মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, কিশোরগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন করেন।
এ জাতীয় আরো খবর..