বন্য প্রাণী সংরক্ষণে অবদানের জন্য ‘বঙ্গবন্ধু অ্যাওয়ার্ড ফর ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন ২০২৪’ পেয়েছে জবই বিল জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও সমাজ কল্যাণ সংস্থা। বন্য প্রাণী সংরক্ষণে কাজ করা সংগঠন শ্রেণিতে পুরস্কৃত হয়েছে নওগাঁর সংগঠনটি। গত ৫ জুন ঢাকায় সংগঠনটির সভাপতি সোহানুর রহমান সবুজের হাতে পুরস্কার তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জবই বিল অঞ্চলে একটি সংরক্ষিত এলাকা গড়ে জবই বিলের সবুজ যোদ্ধাতোলার বিষয়টি খতিয়ে দেখার মৌখিক আশ্বাসও দিয়েছেন তিনি।
জবই বিলের সবুজ যোদ্ধা
জাতীয় পর্যায়ের স্বীকৃতি মফস্বলের একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য সহজ কথা নয়। এই প্রাপ্তির পেছনে রয়েছে অনেক দিনের অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিষ্ঠা। নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ অজস্র খাল-বিল ও হাওর-বাঁওড়। এসব জলাভূমির অনেকই নদীর সঙ্গে যুক্ত।
মাছ ও পাখির পাশাপাশি বহু জলজ উদ্ভিদ, প্রাণীসহ জীববৈচিত্র্যের অনন্য আধার বাংলার একেকটি বিল-হাওর। সোহানুর রহমান সবুজের সংগঠন ‘জবই বিল জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও সমাজ কল্যাণ সংস্থা’ নওগাঁর এই বিলটির পাখিদের রক্ষায় অনন্য অবদান রেখেছে।
পরিবেশে আগ্রহ অনেক দিনের
সোহানুর রহমান সবুজ নিজে নওগাঁর জবই বিলের জল-হাওয়ায় বেড়ে উঠেছেন। বিল তীরবর্তী আশড়ন্দ গ্রামে তাঁর জন্ম।
ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকার তিতুমীর কলেজ থেকে। ছাত্র অবস্থায়ই পরিবেশ সুরক্ষায় নানা ধরনের কাজে সম্পৃক্ত আছেন সবুজ। কলেজে সহপাঠী নাজমুল হকের সঙ্গে মিলে গঠন করেছিলেন ‘টিম ফর এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট রিসার্চ’ নামে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। পরিচ্ছন্নতা অভিযানের পাশাপাশি ক্যাম্পাসকে পলিথিনমুক্ত করতে প্রচারণা চালিয়েছে তাঁদের সংগঠনটি।
পড়াশোনা শেষে সবুজ শিক্ষক হিসেবে পেশা জীবন শুরু করেন ২০১৬ সালে। এখন তিনি কর্মরত জবই বিল তীরবর্তী আইহাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
গুরুত্বপূর্ণ জলাধার জবই বিল
ওগাঁর সাপাহার উপজেলায় বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে এক প্রাকৃতিক জলাভূমি জবই বিল। আয়তন ৪০৩ হেক্টর। ডুমরইল, বোরা মির্জাপুর, ভূতকুড়ি, মাহিল, কালিন্দা, কুচুন্দরী ও কাঞ্চনতলা—মূলত এই সাতটি বিলের সমন্বয়েই জবই বিল। অন্য বিলগুলো শীতে শুকিয়ে গেলেও ডুমরইল, মাহিল ও কালিন্দা বিলে পানি থাকে সারা বছর। তাই নানা রকম মাছের আধার জবই বিল। পাশের জবই গ্রাম থেকেই লোকমুখে বিলের এই নামকরণ হয়েছে বলে স্থানীয়দের ধারণা। দেশের আরো কিছু বড় বিলের মতোই জবই বিল দেশীয় নানা জাতের মাছে ভরপুর। এখানে বর্ষায় পানকৌড়ি, বক, মাছরাঙা, শামুকখোলসহ হরেক রকম পাখির সমারোহ ঘটে। শীতে এদের পাশাপাশি নানা প্রজাতির অতিথি পাখির ডাক আর উড়াউড়িতে প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে পুরো বিল।
নাড়া দেয় পাখিদের বিপন্নতা
ছোটবেলা থেকে স্কুলে যাওয়া-আসার পথে অতিথি পাখিদের এই বিচরণ দেখে মন ভালো হয়ে যেত সবুজের। কিন্তু একটু বড় হয়ে খেয়াল করেন শিকারিদের উৎপাতে বিলের পাখিরা তিষ্ঠাতে পারছে না। তার ওপর শীতের শেষ দিকে পানি কমলে নৌকা নিয়ে মাছ শিকারে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্থানীয় জেলেসহ অন্যরা। ফলে প্রাণ ভয়ে পালিয়ে যায় পাখিরা। সবুজ এ বিষয়ে বললেন, ‘অতীতে নানা রকম অতিথি পাখি এলেও জনসচেতনতা ও অনুকূল পরিবেশের অভাবে বিলটির জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হতে চলেছিল।’
সবুজ কর্মজীবনে প্রবেশ করার বছর দুয়েক পর জবই বিল নিয়ে সক্রিয় হলেন। স্থানীয় শিক্ষিত কয়েকজন তরুণের সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ করলেন। সবাই এক বাক্যে সায় দিলেন। তাঁদের নিয়েই ২০১৮ সালে গড়ে তুললেন ‘জবই বিল জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও সমাজ কল্যাণ সংস্থা’ নামের সংগঠনটি। এই সংগঠন পাখির নিরাপদ বিচরণ নিশ্চিত করতে বিলের আশপাশের গ্রামগুলোতে স্থানীয় প্রশাসন এবং বন বিভাগের সহায়তায় প্রচারণা চালায়। সবুজরা বিলের ওপর নির্ভরশীল এলাকার ৭৯৯ জন জেলেকেও সচেতন করে তুলেছেন।
পাখি শিকার বন্ধ হয়েছে
১৯৯০ সালের আগে জবই বিলে কেউ কিছু করেনি। কচুরিপানায় ভরে থাকত পুরো এলাকা। প্রতিবছর হাজার হাজার অতিথি পাখি আসত। বিলে মাছ চাষ শুরু হওয়ার পর থেকে পাখি আসা কমতে থাকে। এর সঙ্গে যোগ হয় শিকারিদের উৎপাত। স্থানীয়দের অনেকে পাখি শিকার করে এলাকার বাজারে, রেস্তোরাঁয় বিক্রি করত। সবুজের সংগঠন এলাকার মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে পেরেছে। বিলে এখন পাখি শিকারির সংখ্যা প্রায় শূন্যের কোঠায় বলেই তাদের দাবি।
পরিবেশ সংরক্ষণে কার্যক্রম
বিলে পাখিদের প্রাকৃতিক খাবারের তেমন অভাব নেই। কিন্তু বাড়তি খাবার ও নিরাপদ আবাসস্থল জোগাতে বিলের চেলাঘাটের খালপার এলাকায় সাড়ে তিন হাজার ফলজ ও বনজ গাছের চারা রোপণ করেছেন সবুজরা। বন বিভাগ এতে সহায়তা করেছে। ১০ জন তরুণকে নিয়ে শুরু হলেও জবই বিল সংরক্ষণ সংগঠনের সদস্য এখন ১৬১ জন। সবুজ নিজের বেতনের একটা অংশ সংরক্ষণের কাজে ব্যয় করেন। বাকি অর্থ আসে সদস্যদের মাসিক চাঁদা থেকে।
লোকালয়ে প্রবেশ করা দলছুট বানর ও হনুমানের নিরাপত্তা ও অবাধ চলাচলের জন্যও প্রচারণা চালান তাঁরা। আড়শন্দ বাজারে বরেন্দ্র বাতিঘর নামে একটি পাঠাগারও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে প্রতিবছর বিলের পাখিদের ওপর জরিপ চালানো হচ্ছে।
সরকারের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সহযোগিতায় এই জরিপ করা হয়। মাস চারেক ধরে চলে এই জরিপ। প্রথম বছর ২০১৯ সালে ১৭ প্রজাতির প্রায় পাঁচ হাজার ৬৯৩টি পাখির উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছিল। সেই থেকে এ পর্যন্ত প্রতিবছর মোটের ওপর প্রজাতি ও পাখির সংখ্যা বেড়েছে। ২০২৩ সালে ৩২ প্রজাতির ১১ হাজার ২৩০টি পাখি চিহ্নিত করা হয়েছে। জবই বিল সংরক্ষণ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, ‘এই জরিপ প্রমাণ করে প্রতিবছর বিলে পাখির উপস্থিতি বাড়ছে। এখন দরকার বিলের পরিবেশ সংরক্ষণের মাধ্যমে এদের নিরাপদ বিচরণ নিশ্চিত করা।’
ঈদের ছুটিসহ বিভিন্ন উপলক্ষে অনেক পর্যটকের ভিড় হয় জবই বিলে। তাঁদের সুবিধার জন্য বিলের মাঝ দিয়ে রাস্তা ও সেতু, দুই পাশে কংক্রিটের বেঞ্চ এবং সেলফি ও ভিউ পয়েন্ট নির্মাণ করেছে উপজেলা প্রশাসন। কিন্তু উচ্চশব্দে ইঞ্জিনচালিত নৌকা ও স্পিড বোট চলাচলের কারণে বিলের পাখিদের সমস্যা হয় বলে জানালেন সবুজ। পর্যটকদের অনেকে চানাচুর, চিপসের প্যাকেট, পলিথিন, কোমল পানীয়ের বোতল ইত্যাদি ফেলে পরিবেশ দূষণ করছেন। সবুজদের সংগঠন বিলের পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করছে। তারা উপজেলা প্রশাসনের কাছ থেকে কয়েকটি ডাস্টবিন চেয়েছে। জনসচেতনতা তৈরির জন্য বিল এলাকার স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের নিয়ে পরিবেশ কমিটি গঠন করেছে। আশপাশের দোকানদারদেরও এ কাজে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।
সবুজদের ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’র কাজটি শুরুর দিকে অনেকেই ভালোভাবে নেয়নি। একবার বিলের খাসজমিতে তাদের রোপণ করা গাছের চারার অনেকগুলো উপড়ে ফেলা হয়েছিল। বিলের ওপর নির্ভরশীল জেলেরাও প্রথমে তাঁদের জীবিকার ওপর হুমকি মনে করেছিলেন। কিন্তু সবুজরা তাঁদের বোঝাতে সক্ষম হন যে, বিল বাঁচলে সবাই বাঁচবে। এখন তাঁরাও সবুজদের সহযোগিতা করেন।
প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে আশাবাদী
এখন আড়শন্দ বাজারে ভাড়া ঘরে কার্যক্রম চালান সবুজরা। ‘স্থায়ী একটা ঠিকানা পেলে কার্যক্রম চালাতে অনেক সুবিধা হতো’, বললেন সোহানুর রহমান সবুজ। তাঁদের আরেকটি চাওয়া, বিলের একটি অংশকে ‘বিশেষ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ অঞ্চল’ হিসেবে ঘোষণা করা হোক। এতে পাখিরা নিরাপদে বিচরণের সুযোগ পাবে। মাছ ধরার সময় এদের দূরে পালিয়ে যেতে হবে না। মা মাছেরও নিরাপদ আশ্রয় হবে। এ প্রসঙ্গে সবুজ জানালেন, বিলের উত্তরেও সীমান্তবর্তী এলাকায় কিছু বড় জলাশয় আছে। পুনর্ভবা নদীও সেদিকেই। স্থানীয় ও পরিযায়ী পাখিরা এই বিস্তৃত এলাকাজুড়ে চলাচল করে। সবুজ বললেন, ‘জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধিদের কাছে ধরনা দিয়ে আসছেন তাঁরা। পুরস্কার গ্রহণের দিন সুযোগ পেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছেও বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন সবুজ। তিনি বলেছেন, ‘দেখবেন’। সবুজ তাই আশায় বুক বেঁধেছেন কাঙ্ক্ষিত সেই ঘোষণাটির জন্য।
সার্বিক বিষয়ে কথা বলা হলে সাপাহার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুদ হোসেন কালের কণ্ঠকে গতকাল জানান, অচিরেই বিলের পর্যটন এলাকায় ডাস্টবিন বসানো হবে। এ ছাড়া ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে জবই বিল খনন প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে। খননের পর বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শক্রমে সবার মতামতের ভিত্তিতে বিলের কোনো এক অংশে পাখির অভয়াশ্রম গড়ে তোলা হবে।
এ জাতীয় আরো খবর..