কোরবানির ঈদ সামনে রেখে দেশে এবার জীবিত গরু মেপে ৩৯০ থেকে ৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হচ্ছে। সেখানে সাদিক অ্যাগ্রো নামের একটি প্রতিষ্ঠান ব্রাহামা জাতের গরু প্রতি কেজি বিক্রি করছে সাত হাজার টাকারও বেশি দামে। হিসাব করে দেখা গেছে, কোরবানির জন্য প্রতিষ্ঠানটির ব্রাহামা জাতের গরু প্রতি কেজি বিক্রি করা হচ্ছে অন্য গরুর চেয়ে অন্তত ১৫ গুণ বেশি দামে। এই অস্বাভাবিক দাম বাজারে কোরবানির পশুর উচ্চমূল্যকে উৎসাহিত করছে।
ফলে সাধারণ ক্রেতাদের জন্য কোরবানের গরু কেনা সামর্থ্যের বাইরে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সম্প্রতি রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ব্রাহামা জাতের তিনটি গরু দুই কোটি ৬০ লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন সাদিক অ্যাগ্রো ফার্মের স্বত্বাধিকারী ইমরান হোসেন। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এ বিষয়ে কালের কণ্ঠ’র পক্ষ থেকে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, উন্নত জাত ও বংশমর্যাদার ধুয়া তুলে বেশি মূল্যে পশু বিক্রি করছেন সাদিক অ্যাগ্রোর স্বত্বাধিকারী ইমরান হোসেন।
এসব পশু কিনে অবৈধ কালো টাকা সাদা করছেন কিছু ব্যক্তি। সাধারণ পশু ক্রেতাদের অভিযোগ, সাদিক অ্যাগ্রো বিদেশ থেকে আমদানি নিষিদ্ধ গরু এনে বংশমর্যাদা ও জাতের ধুয়া তুলে অতি উচ্চ মূল্যে বিক্রি করছে। এতে কোরবানির পশুর বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার পাশাপাশি চড়ামূল্যে সাধারণ গরু কিনতে হচ্ছে ক্রেতা সাধারণকে।
মোহাম্মদপুরের বসিলায় কোরবানির গরুর হাটে আসা ক্রেতা শহিদুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘সাদিক অ্যাগ্রো কর্তৃপক্ষ কোরবানির পশুর বাজারে অস্থিরতা তৈরি করেছে।
তারা একেকটি গরু কোটি টাকায় বিক্রি করে সোশ্যাল মিডিয়ায় বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে কোরবানির পশুর হাটে। কোরবানির গরু কিনতে আমরা এখন হিমশিম খাচ্ছি। সাদিক অ্যাগ্রোর মালিক ইমরান হোসেন এক হাজার ৪০০ কেজি ওজনের একটি গরু এক কোটি টাকায় বিক্রয় করেছেন। এতে প্রতি কেজি মাংসের দাম পড়েছে সাত হাজার টাকার বেশি।
যেখানে বাজারে প্রতি কেজি গরুর মাংস ৭৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়। সাদিক অ্যাগ্রোর এই কাণ্ড অন্যায়। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী ইমরানকে আইনের আওতায় আনা উচিত।’
এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মোহাম্মদ রেয়াজুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একটি গরুর এত উচ্চমূল্য অস্বাভাবিক। বর্তমান সরকার যেখানে ভোগ্য পণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখার চেষ্টা করছে, সেখানে গরুর এই দাম স্বাভাবিক বাজারমূল্যের মধ্যে পড়ে না। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর মাংসের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরও কম মূল্যে ভ্রাম্যমাণ মাংস বিক্রি করে। সাধারণ মানুষ যাতে সুলভ মূল্যে মাংস কিনতে পারে, এ জন্য সরকারের সব ধরনের উদ্যোগ রয়েছে। আর সেখানে সাদিক অ্যাগ্রোর এত চড়ামূল্যে গরু বিক্রি কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।’
জানা গেছে, ২০২১ সালের ৬ জুন টার্কিশ এয়ারলাইনসের একটি বিমানে ১৮টি ব্রাহামা জাতের গরু রাজধানীর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায়। তাত্ক্ষণিকভাবে সেখানে গরুগুলো গ্রহণ করার জন্য কেউ ছিল না। আবার আমদানি নিষিদ্ধ হওয়ায় ঢাকা কাস্টমস হাউস গরুগুলো জব্দ করে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কাছে হস্তান্তর করে। পরে ওই গরুগুলো রাখা হয় সাভারের কেন্দ্রীয় গো প্রজনন ও দুগ্ধ খামারে। ওই গরুগুলো সাদিক অ্যাগ্রো কিভাবে পেয়েছে সে বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ডা. মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকা শহরে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের নির্ধারিত ২৫টি স্থানে সুলভ মূল্যে মাংস বিক্রির জন্য আমরা প্রশাসনিক একটি নির্দেশনা পেয়ে গরুগুলো হস্তান্তর করেছি। পরে এই গরুগুলো জবাই করা হয়েছে কি না সেটি মনিটর করার দায়িত্ব আমাদের না। এটি মনিটর করার দায়িত্ব প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের।’
জবাই করে মাংস বিক্রির জন্য যে গরুগুলো হস্তান্তর করা হয়েছে সেই গরু সাদিক অ্যাগ্রো কর্তৃপক্ষ কোরবানির বাজারে বিক্রি করছে কিভাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা আমরা বলতে পারব না।’
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে সরেজমিনে সাদিক অ্যাগ্রোতে গেলে খামারটিতে নিয়োজিত একাধিক কর্মী জানান, বিমানবন্দরে আটকের পর একটি গরু মারা গেলে ব্রাহামা জাতের বাকি ১৭টি গরু সরকারের কেন্দ্রীয় গো প্রজনন ও দুগ্ধ খামারে রাখা হয়েছিল। পরে সেখান থেকে মোহাম্মদপুরের সাদিক অ্যাগ্রোতে আনা হয়।
সাদিক অ্যাগ্রোয় তিন বছর ধরে নিয়োজিত এক কর্মী জানান, বিমানবন্দরে আটক হওয়া ব্রাহামা জাতের ১৭টি গরু সাভারে ছিল। সেখান থেকে মোহাম্মাদপুরের এই খামারে আনা হয়েছে। বছরখানেক আগে গরুগুলো ঢাকার আমিনবাজার ১৬ নামের এলাকায় সাদিক অ্যাগ্রোর আরেকটি খামারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তিনটি গরু বিক্রির পর এখনো ১৪টি গরু বিক্রির জন্য রাখা আছে। এর মধ্যে সাত-আটটি গরু সাইজে ছোট ও পাঁচ-ছয়টি গরু বড়। বর্তমানে এসব গরু চড়ামূল্যে বিক্রির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে সাদির অ্যাগ্রো।
এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মাংসের এ ধরনের অস্বাভাবিক দাম সাধারণ বাজারে প্রভাব ফেলে। এতে অস্বাভাবিকভাবে গরুর দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে সাধারণ ক্রেতারা ক্ষতির শিকার হয়।’
এসব পশু যাঁরা কিনেছেন তাঁদের আয়ের উৎস এবং কারা কিনছেন সেটি দেখা প্রয়োজন বলে মনে করেন কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান।
কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘যে দামে পশু বিক্রির তথ্য জানলাম, সেটি অস্বাভাবিক। কারা এসব পশু এত চড়ামূল্যে কিনছেন সেটিও খতিয়ে দেখতে হবে। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এসব ক্রেতার তথ্য যাচাই-বাছাই করতে পারে।’
২০২১ সালে বিমানবন্দরে কাস্টমস যে গরুগুলো আটক করেছিল, সেগুলো কিভাবে ইমরানের নিজস্ব খামারে গেল, এমন প্রশ্নের জবাবে সরকারি কেন্দ্রীয় গো প্রজনন ও দুগ্ধ খামারের কৃত্রিম প্রজনন বিভাগের উপপরিচালক এ জেড এম সালাউদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সাদিক অ্যাগ্রো কর্তৃপক্ষ গরুগুলো অনেক আগেই নিয়ে গেছে, এটা ঠিক।’ তবে কিভাবে এসব গরু নিয়ে গেছে সেটি জানতে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এভাবে আমদানি নিষিদ্ধ জাতের পশু আটকের পর পুনরায় আমদানিকারকের হাতে তুলে দিলে অপরাধীরা উৎসাহিত হবে। বেসরকারি পর্যায়ে গবাদি পশুর কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম পরিচালনার সংশোধিত নীতিমালা ২০১৬ সালের আওতায় দেশে বেসরকারি পর্যায়ে ব্রাহামা গরু আমদানি, প্রজনন ও লালন-পালন নিষিদ্ধ রয়েছে। এই আইনে কেউ এ ধরনের অপরাধ করলে সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
জানা গেছে, আমদানি করা ১৮টি ব্রাহামা গরুর বিল অব এন্ট্রিতে মূল্য ধরা হয়েছিল ৪০ হাজার ডলার। তখনকার টাকায় প্রতিটি গরুর গড় মূল্য পড়েছিল প্রায় দুই লাখ ৩৩ হাজার টাকা। সেই গরু প্রতিটি এক থেকে দেড় কোটি টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে কেন, এ নিয়ে তৈরি হয়েছে ধূম্রজাল।
এদিকে রংপুর মহানগরীর মাহিগঞ্জের দেওয়ানটুলি এলাকায় ‘জমজম ক্যাটল ফার্ম’ নামে একটি গরুর খামারে ওজনে বেচাকেনা হচ্ছে কোরবানির পশু। সেখানে মাত্র ৪৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হচ্ছে গরু। দুই বছর ধরে এই পদ্ধতিতে গরু বিক্রি হচ্ছে ওই খামারে। আর সেখানে সাদিক অ্যাগ্রোতে কোটি টাকায় বিক্রি হওয়া গরুর প্রতি কেজির মূল্য পড়ছে সাত হাজার ১৪৩ টাকা।
কোটি টাকায় গরু বিক্রির ঘটনায় এর নেতিবাচক প্রভাব সাধারণ ক্রেতাদের ওপর পড়বে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে সাদিক অ্যাগ্রোর স্বত্বাধিকারী ইমরান হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রশ্নই ওঠে না। সাধারণ ক্রেতাদের ওপর এর কোনো প্রভাব পড়বে না। শুধু সামর্থ্যবানরা এ ধরনের গরু কিনবেন।’
ব্রাহামা জাতের গরু আমদানি নিষিদ্ধ হওয়ায় ২০২১ সালে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১৮টি গরু ঢাকা কাস্টমস আটক করে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরকে হস্তান্তর করে। সেই গরু আবার আপনাদের ফার্মে এনে কোটি টাকায় বিক্রি করলেন কিভাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সেখান থেকে আমরা কিছু গরু নিলামে কিনেছি।’
এ জাতীয় আরো খবর..