আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাঙালির প্রতিটি অর্জনই এসেছে আওয়ামী লীগের হাত ধরে। জন্ম থেকে দলটির প্রতিটি পদক্ষেপের কারণেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সুখে-দুঃখে সব সময় মানুষের পাশে ছিল এই দল। তিনি আরও বলেন, কিন্তু আওয়ামী লীগের ওপর বারবার আঘাত এসেছে।
খণ্ড-বিখণ্ড করা হয়েছে। বারবার এ দলকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা চলেছে। সেই আইয়ুব খানের মার্শাল ল’ থেকে শুরু, তবু এ সংগঠনের কেউ ক্ষতি করতে পারেনি। ফিনিক্স পাখির মতো, পুড়িয়ে ফেলার পরও ভস্ম থেকে যেমন জেগে ওঠে, আওয়ামী লীগও সেভাবেই জেগে উঠেছে। বঙ্গবন্ধুর সৈনিকরা কখনো পরাভব মানে না, মাথানত করে না। আগামীতেও করবে না।
রোববার বিকালে রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী (প্লাটিনাম জুবলি) উপলক্ষ্যে আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। শেখ হাসিনা সভাপতির বক্তব্য দিতে মাইকের সামনে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে।
তিনি নিজেও স্লোগান ধরেন। পরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনগণের শক্তি অপরিসীম। আওয়ামী লীগ জনগণের শক্তিতে বিশ্বাস করে। সংগঠন শক্তিশালী হলে আর জনসমর্থন থাকলে যতই ষড়যন্ত্র হোক কেউ কিছু করতে পারবে না। আর যে কোনো সময় মৃত্যু আসতে পারে, আমি মৃত্যুকে ভয় করি না। যতক্ষণ শ্বাস আছে ততক্ষণ দেশের জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনে কাজ করে যাব। বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে আমার বাবার যে চিন্তা-চেতনা তা বাস্তবায়ন করে এ দেশের মানুষকে একটা উন্নত জীবন দেব। এটাই আমাদের লক্ষ্য।
আলোচনা সভা বলা হলেও হাজার হাজার নেতাকর্মীর উপস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত তা বিশাল জনসভায় রূপ নেয়। ঢাকা ও আশপাশের এলাকার নানা প্রান্ত থেকে দলের নেতাকর্মীরা দুপুর ১টা থেকেই ঢাকঢোল, ব্যান্ড বাজিয়ে আনন্দ-উল্লাস করতে করতে সভাস্থলে আসতে শুরু করেন। বিভিন্ন নির্বাচনি এলাকা থেকে নেতাকর্মীরা বাসে আসেন। তারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সামনে জড়ো হয়ে নানা স্লোগান দেন। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। বিশেষ করে বেলা ৩টার পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশ ফটকের সামনে জনস্রোত তৈরি হয়।
আলোচনা সভায় দলের সভাপতি আওয়ামী লীগকে আরও শক্তিশালী ও সুসংগঠিত করে গড়ে তোলার জন্য নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমাদের সংগঠনের প্রতিটি নেতাকর্মীর কাছে আমার একটাই আবেদন, সংগঠনকে আরও সুসংগঠিত করতে হবে। একজন রাজনীতিবিদের জীবনে সংগঠনটা হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী। যদি সংগঠন শক্তিশালী হয় আর দেশের গণমানুষের সমর্থন পাওয়া যায়, তবে যতই ষড়যন্ত্র হোক, তারা (ষড়যন্ত্রকারীরা) সফল হতে পারবে না।
দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা ভাসানী ও সাধারণ সম্পাদক শামসুল হককে স্মরণ করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, প্রত্যেক নেতাকর্মীকে এ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বলব, আপনারা একবার চিন্তা করে দেখেন, এই আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা কত কষ্ট করেছেন। বারবার আঘাত এসেছে। পরিবারগুলো কষ্ট করেছে। কিন্তু এই সংগঠন ধরে রেখেছে। কাজেই যেমন সংগঠন করতে হবে, সেভাবে জনগণের আস্থা-বিশ্বাস, যেটা আমাদের মূল শক্তি সেই আস্থা-বিশ্বাসটা অর্জন করতে হবে।
বিশ্বে আজকে মাথা উঁচু করে চলার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে : শেখ হাসিনা বলেন, জনগণের সেই আস্থা-বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছি বলেই বারবার জনগণ আমাদের ভোট দিয়েছে। বারবার ক্ষমতায় এসে, দীর্ঘ সময় বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে। আর গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে বলেই আজ আর্থসামাজিকভাবে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশের উন্নতি হচ্ছে।
বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে রোল মডেল হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বিশ্বে মাথা উঁচু করে চলার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কাজেই এটাকে (আস্থা-বিশ্বাস) ধরে রেখেই আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
নবীনরা স্মার্ট বাংলাদেশের মূল সৈনিক হবে : স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ২১০০ সাল পর্যন্ত আমরা ডেল্টা প্ল্যান রূপকল্প ঘোষণা করেছি। অনেক বয়স হয়েছে, ততদিন হয়তো বেঁচে থাকব না। কিন্তু আজকে যারা নবীন, তারাই আমার স্মার্ট বাংলাদেশের মূল সৈনিক হবে। আমরা স্মার্ট জনগোষ্ঠী গড়ে তুলব, স্মার্ট সরকার, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সোসাইটি গড়ে তুলে, এই বাংলাদেশ বিশ্বে মাথা উঁচু করে এগিয়ে যাবে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর প্লাটিনাম জুবলিতে এটাই আমাদের প্রতিজ্ঞা।
আমি মৃত্যুকে পরোয়া করি না : প্রধানমন্ত্রী বলেন, মৃত্যু যে কোনো সময় সবার হতে পারে। যে কোনো সময় মৃত্যু আসতে পারে। তার জন্য আমি কোনো দিন ভীত না। কখনো ভয় পাইনি, পাব না। কিন্তু যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ। বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে আমার বাবার যে চিন্তা-চেতনা তা বাস্তবায়ন করে এ দেশের মানুষকে একটা উন্নত জীবন দেব। এটাই আমাদের লক্ষ্য।
এ দলকে বারবার নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা হয়েছে : আওয়ামী লীগ ছাড়া যারা ক্ষমতায় এসেছে তারা সন্ত্রাসবাদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্ত্রের ঝনঝনানি, দুর্নীতি করেছে বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, তারা জনগণের শক্তি ভুলে গিয়েছিল। আওয়ামী লীগ জনগণের শক্তিতে বিশ্বাস করে। শেখ হাসিনা আরও বলেন, আজ বাঙালির যতটুকু অর্জন, এ অর্জনগুলো আওয়ামী লীগের দ্বারাই হয়েছে। কিন্তু বারবার এ দলের ওপর আঘাত এসেছে। বারবার এ দলকে খণ্ড-বিখণ্ড করা হয়েছে। বারবার এ দলকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করা হয়েছে। ’৫৮ সালে সেই আইয়ুব খানের মার্শাল ল’ থেকে শুরু করে বারবার আঘাত এসেছে।
আওয়ামী লীগের মূল শক্তি হচ্ছে জনগণ : আওয়ামী লীগ জনগণের অধিকার আদায়ের সংগঠন। বেশি দিন আগের কথা নয়, ২০০৭ সালেও আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে নতুন কিংস পার্টি গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছিল। সেটাও সফল করতে পারেনি। এর মূল কারণ হচ্ছে, আওয়ামী লীগের মূল শক্তি হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণ, সাধারণ জনগণ, তৃণমূলের মানুষ, আওয়ামী লীগের অগণিত নেতাকর্মী, মুজিব আদর্শের সৈনিক। এ সৈনিকরা কখনো পরাভব মানে না, মাথানত করে না।
আ.লীগ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তারা আর জ্বলেনি : আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, হয়তো কখনো কখনো নেতারা ভুল করেছেন। দলের চেয়ে নিজেকে বড় মনে করেন, কেউ দল ছেড়ে গিয়ে অন্য দল করেছেন। তারা ভুল করেছেন।
তিনি আরও বলেন, আকাশে মিটিমিটি তারা জ্বলে, তারা আলোকিত হয় কার দ্বারা? সূর্যের আলোতে আলোকিত হয়। যেসব নেতা আওয়ামী লীগ ছেড়েছিলেন তারা ভুলে গিয়েছিলেন দলের কথা। অথচ তারা আলোকিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছিলেন বলেই। চলে যাওয়ার পর ওই তারা আর জ্বলেনি। অনেকেই নিভে গেছেন। কেউ ভুল বুঝে ফিরে এসেছেন, আমরা নিয়েছি। আবার কেউ কেউ এখনো আওয়ামী লীগ ও সরকারের পতন কল্পনা করে যাচ্ছেন।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরের ইতিহাসও তুলে ধরেন জাতির পিতার কন্যা। তিনি বলেন, এরপর ক্ষমতা পরিবর্তন হয় অস্ত্র বা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ছিল না। জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন তারা করতে পারেনি। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ছাড়া যারা ক্ষমতায় এসেছে তারা সন্ত্রাসবাদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্ত্রের ঝনঝনানি, দুর্নীতি করেছে। তারা জনগণের শক্তি ভুলে গিয়েছিল। আওয়ামী লীগ জনগণের শক্তিতে বিশ্বাস করে।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেলা ৩টা ৩৫ মিনিটে সভামঞ্চে আসেন। জাতীয় সংগীতের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে সভা শুরু হয়। এরপর বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে কর্মসূচির উদ্বোধন করা হয়। পরে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী চলে সাংস্কৃতিক আয়োজন। এতে গান, নৃত্য ও নানা পরিবেশনায় ১৯৪৮ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে দলটির নেতৃত্বে মহান স্বাধীনতা অর্জন, পঁচাত্তর পরবর্তী প্রেক্ষাপট, ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনার ফিরে আসা, দলকে সুসংগঠিত করা, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে দেশের উন্নয়ন-অর্জন তুলে ধরা হয়। আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক উপকমিটির আয়োজনে দলটির সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিলের সঞ্চালনায় সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় অংশ নেন দেশবরেণ্য শিল্পীরা।
দ্বিতীয় পর্বে আলোচনা সভা শুরু হওয়ার আগে পবিত্র কুরআনসহ বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করা হয়। সভায় সূচনা বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। আওয়ামী লীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাইকে ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের ভুল-ত্রুটি নেই, তা আমরা বলব না।
তবে যারা স্বাধীনতার আদর্শে বিশ্বাস করেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করেন, দেশের সব পর্যায়ের মানুষ, রাজনৈতিক নেতা, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি, সবার কাছে আমি আহ্বান জানাই-শেখ হাসিনাই বাংলাদেশের জনগণের একমাত্র আস্থার ঠিকানা। আসুন আমরা সবাই মিলে তার (শেখ হাসিনার) হাতকে শক্তিশালী করি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘পোয়েট অব পলিটিকস’ আখ্যায়িত করা হয়েছিল উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, আমাদের নেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যাকে আজ আমরা বলি, তিনি হচ্ছেন ‘ম্যাজিশিয়ান অব পলিটিকস’ (রাজনীতির জাদুকর)।
সভায় জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা জিএম কাদের, ১৪ দলের শরিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার, তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য, ইতালি, সৌদি আরব, ডেনমার্ক, আর্জেন্টিনা, ইন্দোনেশিয়া, স্পেন, মিয়ানমার, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস, ভিয়েতনাম, সুইডেন, ওমান, তুরস্কসহ ঢাকায় অবস্থানরত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা উপস্থিত ছিলেন।
সভামঞ্চে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির নেতাদের পাশাপাশি উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, ঢাকা সিটি মেয়র, ঢাকার দলীয় ও স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। আলোচনা পর্ব সঞ্চালনা করেন আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ এবং উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সৈয়দ আব্দুল আউয়াল শামীম।
এ জাতীয় আরো খবর..