×
  • প্রকাশিত : ২০২৪-০৬-২৭
  • ৭৩ বার পঠিত
ছাগলকাণ্ড বা অন্য কোনো মাধ্যমে দুর্নীতিবাজরা চিহ্নিত হওয়ার আগেই তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসার দাবি জানিয়েছেন সরকারি ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা। একই সঙ্গে বিশেষ কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর তার পক্ষে কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে দায় নেওয়ার সংস্কৃতির সমালোচনা করে তা থেকে বেরিয়ে আসারও আহ্বান জানানো হয়েছে সংসদে।

দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করার দাবি সংসদেগতকাল বুধবার জাতীয় সংসদের অধিবেশনে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে সংসদ সদস্যরা এসব দাবি জানান।

ঢাকা-৮ আসনের সংসদ সদস্য এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে থাকা এনবিআরের মতিউর রহমানের মতো দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করতে সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘যাঁরা রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে থাকেন, যেমন—মতিউরকে দুর্নীতি দমন কমিশন, গণমাধ্যম এমনকি আমরা যারা রাজনীতিবিদ আছি, তারা চিহ্নিত করতে পারিনি। তাঁকে একটি বোবা প্রাণী ছাগল চিহ্নিত করেছে। এমন মতিউর আরো আছে কি না, ভবিষ্যতে ছাগল বা অন্য কোনো বোবা প্রাণী চিহ্নিত করার আগেই তাদের চিহ্নিত করার প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সংস্থার।’
এবার কোরবানির ঈদে ঢাকার আলোচিত খামার সাদিক অ্যাগ্রো থেকে ১২ লাখ টাকায় একটি ছাগল কেনার বায়না করে আলোচনায় আসেন ১৯ বছরের তরুণ মুশফিকুর রহমান ইফাত।

জানা যায়, এই তরুণ আরো ৫০ লাখ টাকায় বেশ কয়েকটি গরু কিনেছেন। পরে প্রকাশ পায়, তিনি এনবিআর সদস্য মতিউর রহমানের ছেলে, যদিও মতিউর গণমাধ্যমে এসে তাঁর পিতৃপরিচয় অস্বীকার করেন। কিন্তু গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে তাঁর এই অসত্য দাবির বিষয়টি উঠে আসে। ফেনী সদর আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী জানান, মতিউর ও ইফাতের সম্পর্ক বাবা-ছেলের।

ইফাতের মা মতিউরের দ্বিতীয় স্ত্রী এবং সেই নারী নিজাম হাজারীর মামাতো বোন।
এরপর মতিউর ও তাঁর দুই স্ত্রী ও সন্তানদের নামে থাকা বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশ পেতে থাকে। জানা যায়, এনবিআরের সদস্য হয়ে পুঁজিবাজারে আসার আগে কম্পানির প্লেসমেন্ট শেয়ার নিতেন মতিউর। এভাবে তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করেন। দুর্নীতির বিষয়গুলো গণমাধ্যমে আসার পর মতিউর এনবিআরের সদস্যের পাশাপাশি সোনালী ব্যাংকের পরিচালকের পদ হারান।

তাঁর ও স্বজনদের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। তবে এর আগেই মতিউর দেশের বাইরে চলে গেছেন বলে জানা গেছে।
মতিউর ছাড়াও এই মুহূর্তে আলোচনায় আছেন পুলিশের সাবেক প্রধান বেনজীর আহমেদ, যাঁর নিজের ও স্বজনদের নামে দেশের বেশ কিছু জেলায় বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির সন্ধান মিলেছে। বেনজীরও সপরিবারে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। বেনজীর আহমেদসহ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার দুর্নীতি নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর সংবাদমাধ্যমকে সতর্কভাবে প্রতিবেদন করার আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দেয় পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন।

এ বিষয়ে ইঙ্গিত করে সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘কোনো রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে যখন দুর্নীতি বা অপকর্মের অভিযোগ আসে তখন রাজনীতিবিদরা পদক্ষেপ নেন বা পক্ষ নেন না। বরং রাজনৈতিক পদক্ষেপ ও আইনি বিচারে সোচ্চার হন। এটাই হলো সৎ রাজনীতিবিদদের মহত্ত্ব। কিন্তু কখনো আমরা দেখতে পাই, যখন কোনো সরকারি বা বেসরকারি, আধাসরকারি সংস্থা বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিশেষ কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আসে, তখন ওই গোষ্ঠী বা অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে দুর্নীতিবাজের পক্ষে সাফাই বত্তৃদ্ধতা-বিবৃতি প্রদান করে। প্রকারান্তরে বিশেষ ব্যক্তির ‍বিরুদ্ধে অভিযোগের দায় কিন্তু ওই সংস্থাগুলো গ্রহণ করে। পুরো সংস্থার ওপর চলে আসে এ দায়। এখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।’

সরকারি দলের এই সংসদ সদস্য বলেন, দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান সরকারি বা বেসরকারি যেকোনো দলের বা সংস্থার হোক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিতে হবে।

ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে ভবিষ্যতে ঋণখেলাপি কমাতে হবে বলে উল্লেখ করেন বাহাউদ্দিন নাছিম। তিনি বলেন, ঋণখেলাপি, অর্থ পাচারকারী, ব্যাংক লুটেরা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সিন্ডিকেট যারা করে তাদের চিহ্নিত করতে হবে। তাদের তালিকা প্রণয়ন করে জাতির সামনে প্রকাশ করতে হবে। বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করে এই দুষ্টচক্র, সর্বগ্রাসী, স্বার্থান্বেষী চক্রের হাত থেকে দেশের জনগণকে রক্ষা করতে হবে।

দুর্নীতি বন্ধে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠনের আহ্বান

দুর্নীতি বন্ধে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে। দুর্নীতির অভিযোগ হাজার হাজার কোটি টাকার। উনারা এয়ারপোর্ট দিয়ে চলে গেছেন। কত লোককে এয়ারপোর্টে থামানো হয়েছে, যেতে দেওয়া হয়নি, পরে কোর্টের পারমিশন নিয়ে যেতে হয়েছে। কেন আপনারা এয়ারপোর্টে আটকাতে পারেননি? এ অবস্থায় একটি দেশ চলতে পারে না। বছরের পর বছর তারা এগুলো করেছে, এই সংস্থাগুলোর সামনে দুর্নীতির ছাপ পড়েছে। আজকে সময় এসেছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি পর্যালোচনার।’

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, ‘যারা দুর্নীতি করেছে তাদের শাস্তি দিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে যে ব্যবস্থায় এ রকম দুর্নীতি হতে পারে সেই ব্যবস্থার একটা পর্যালোচনা দরকার। এ জন্য একটা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন করা উচিত। যাঁরা বিশেষ করে সরকারি কর্মকর্তা আছেন এবং আমরা যাঁরা সংসদে আছি, আমাদের একটা স্টেটমেন্ট দিয়ে আসি। ভোটের আগে নির্বাচন কমিশনকে সম্পদের বিবরণী আমাদের দিতে হয়। ঠিক সেই রকম আজকে যাঁরা সরকারি চাকরিতে আসবেন, তাঁদের সেই স্টেটমেন্ট নিয়ে সরকারি চাকরিতে আসা উচিত। তিনি যখন বের হয়ে যাবেন, তখন সেই স্টেটমেন্ট পর্যালোচনা করে দেখতে পাবেন।’

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, নিবন্ধিত হয়েও ১৭ হাজার লোক মালয়েশিয়ায় যেতে পারেনি। ১০০ মিলিয়ন ডলার দিতে হয়েছে। এটা নিয়ে কোনো কথা নেই। এই লোকগুলো, যারা জমি বিক্রি করে টাকা দিয়েছে, তাদের টাকা কোথায় গেছে? এভাবে একটা দেশ চলতে পারে না, এভাবে একটা দেশের উন্নয়ন আসতে পারে না। দুর্নীতির কারণে এটা হচ্ছে। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজরা উৎসাহিত হবে বলেও মন্তব্য করে ওই প্রস্তাব বাতিলের দাবি জানান তিনি।

ছোটরা ধরা পড়লেও রাঘব বোয়ালরা ধরা পড়ে না

দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ছোটরা ধরা পড়লেও রাঘব বোয়ালরা ধরা পড়ে না। এখন সামনে এসেছে পুলিশের বড় কর্মকর্তা, এনবিআরের বড় কর্মকর্তা—তাঁরা দুর্নীতি করেন। কথায় আছে, চোরের ১০ দিন মালিকের এক দিন।

শেখ হাসিনার জন্য প্রাচীর গড়ে তোলার আহ্বান

আলোচনায় অংশ নিয়ে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সম্পদ নন, তিনি জাতীয় সম্পদ। জাতিকে শেখ হাসিনার জন্য প্রাচীর গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, অনিশ্চয়তার অন্ধকার ও দিশাহারার আবর্তে যখন বাংলাদেশ আবর্তিত, তখনই শেখ হাসিনার আগমন। অনেক সংগ্রাম, অনেক রক্ত বিসর্জন, অনেক আত্মদান, কালবৈশাখী, মরুঝড় মোকাবেলা করে তাঁর আজকের অবস্থান। গভীর দুঃখ, বেদনা, যন্ত্রণা নিয়ে বলতেই হচ্ছে—তাঁর কৃতি ম্লান করছে কিছু লোভী, স্বার্থপর ও সুযোগসন্ধানী। শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সম্পদ নন, বরং জাতীয় সম্পদ। সম্মান, গৌরব, অহংকার বাঙালির পরিচয়। তাঁকে প্রলয়াবর্তে নিক্ষেপ করলে জাতি আবার অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হবে। দিশাহারা ও পথহারা হয়ে পড়বে। তাই জাতীয় প্রয়োজনে দেশরত্ন শেখ হাসিনার জন্য প্রাচীর গড়ে তুলতে হবে।

সাবেক মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী বলেন, ‘টেকসই উন্নয়নের নামে আমরা যেসব কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছি, তার জন্য আমাদের জনপরিষদ প্রস্তুত নয়। সে জন্য এসব কর্মকাণ্ড টেকসই নয়, দেশের এসব উন্নয়ন জনদুর্গতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেও সে কারণে আজ জনদুর্ভোগ মেটানো যাচ্ছে না। কারণ খুব স্পষ্ট, যাদের জনগণের সেবার দায়িত্ব দেওয়া হয়, তারা ব্যক্তিস্বার্থ ও দুর্নীতিতে দুষ্ট। রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধির চরিত্র এক ও অভিন্ন হয়ে দেখা যাচ্ছে।’

তিনি আরো বলেন, রাজনীতিতে ব্যক্তিপূজা নিশ্চিতভাবে স্বৈরতন্ত্রের রাজপথ ধরে হাঁটার শামিল। রাজনীতি আজ অর্থশক্তি, পেশিশক্তির কবলে। জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরাই বিপুলসংখ্যক। আর পেশিশক্তি ও অর্থশক্তি ব্যবসায়ীদের করায়ত্ত।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat