দায়িত্ব পাওয়ার দুই দিন পর রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.) বলেছেন, ‘এখন থেকে রাজনীতি করা কঠিন হবে। রাজনৈতিক দলের জন্য আইন করা হবে। রাজনৈতিক দলগুলো আইনের মধ্যে থেকে রাজনীতি করতে পারবে, নইলে পারবে না।’
পুলিশ সদস্যদের কর্মস্থলে যোগদানে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে তিনি বলেন, এই সময়ের মধ্যে না এলে তাঁরা পলাতক হিসেবে গণ্য হবেন।
তিনি জানান, পুলিশ চলবে ‘পুলিশ কমিশনের’ অধীনে।
গতকাল রবিবার রাজধানীতে পৃথক দুটি অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এসব কথা বলেন। সকালে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে গিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। পরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্যের মাধ্যমে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সরকারের কঠোর বার্তা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আইন-শৃঙ্খলার বিষয়টি স্বাভাবিক পর্যায়ে আনাই তাদের প্রধান কাজ।
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আমাদের দেশের অনেক সমস্যা আছে। এ দেশে রাজনীতি করতে হলে পলিটিক্যাল পার্টি অ্যাক্টের মধ্যে করতে হবে।
সেটা আপনাদের পছন্দ হলে হলো, না হলে আমি যত দিন পর্যন্ত আছি, এটা করে ছাড়ব। আপনারা জানেন যে আমি নির্বাচন কমিশনে ছিলাম। সেখানে অনেক কিছু করে ছেড়েছি। রাজনৈতিক দল আইনের মধ্যে যদি থাকেন, রাজনীতি করতে পারবেন। না হলে পারবেন না।
এ রকম স্বৈরাচারী জায়গায় চলে যাবেন, সেটা হবে না।’
এরই মধ্যে রাজনৈতিক দল আইন তৈরির জন্য অনুরোধ করা হয়েছে বলে জানান তিনি। সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আমার অভিজ্ঞতা আছে এ বিষয়ে। রাজনৈতিক দল করবেন, বাংলাদেশে আপনাকে নিবন্ধন করতে হবে। আইনে যা বলা আছে, তা মানতে হবে। শেয়ারবাজারে যখন যান, তখন নিবন্ধন করেন না? আপনি কম্পানি যখন খোলেন, তখন নিবন্ধন করেন না? ইচ্ছা হলে আপনি রাজনীতি করলেন আর চাঁদাবাজি শুরু করে দিলেন, এটা হবে না।’
সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগের পরিণতির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আজকে একটি দলের অবস্থা দেখুন; এত বড় একটি দল, এত ঐতিহ্যবাহী একটি দল, যার নামের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা জড়িত। আজকে তাদের সদস্যদের পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে।’
বিএনপির নাম উচ্চারণ না করে তিনি বলেন, ‘তাদের (আওয়ামী লীগ) জায়গায় যদি আপনি মনে করেন যে আমি এলাম, দখল করব। বাজার দখল করব, ঘাট দখল করব, চাঁদাবাজি করব। কিছুদিন করেন, কিন্তু আমি সেনাপ্রধানকে বলেছি, অনুরোধ করেছি পা ভেঙে দিতে আপনাদের। আই ডোন্ট কেয়ার (আমি পরোয়া করি না।’
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি শুনেছি কারওয়ান বাজারে গিয়ে চাঁদাবাজি করেন, এই কিছুক্ষণ আগে শুনেছি যে একটি ব্যাংকের মধ্যে দখল নেওয়ার জন্য মারামারি হচ্ছে। আমার কানে এলে ভালো হবে না। ভাই, আমি পাবলিকও না, আমি রাজনীতিবিদও না। আমার ব্যাকগ্রাউন্ড হচ্ছে ফৌজি মানুষ। যা বলব তাই করব। আমি এখানে এক দিন থাকি আর তিন দিন থাকি, যত দিন আছি...। জনগণকে বলব, যারা চাঁদাবাজি করবে, তাদের ওখানেই ধরেন, পেটাবেন না। কী করা লাগে আমরা করব।’
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘এই বাচ্চা বাচ্চা ছেলেপেলেরা আপনাদের জন্য এই একটা উন্মুক্ত পরিবেশ করে দিয়েছে। আপনার তো লজ্জা করে না; আপনারা তাদের রক্তের ওপরে রাজনীতি করবেন, চাঁদাবাজি করবেন। আমাকে আপনারা গালাগালি করেন, আমি কিছু মনে করব না। আমি রাজনৈতিক দলগুলোকে বিনীত অনুরোধ করছি, আপনারা আপনাদের লোক সামলান। আর না হলে দেখেছেন তো? ওপর থেকে পড়তে বেশি সময় লাগে না।’
রাজনীতিবিদদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘রাজনীতি করতে হলে চাটুকারিতা বাদ দিতে হবে। দেশটাকে বাঁচাতে হবে। একজন পিয়ন ৪০০ কোটি টাকা নিয়ে যায়। আমি জীবনে এক কোটি টাকার ওপরে চিন্তা করতে পারি না।’
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘একটা রাষ্ট্রের পলিটিকস (রাজনীতি) এভাবে হয় না। একজনের ইচ্ছামতো রাষ্ট্র চালানো যায় না। সেটা যাই হোক, যার অবদানই থাক। মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদান ছিল ঠিকই, কিন্তু হাজার হাজার লোক যুদ্ধ করে, ত্রিশ লাখ লোক জীবন দিয়ে রাষ্ট্র স্বাধীন করেছে। এই রাষ্ট্র কারো পারসোনাল প্রপার্টি (ব্যক্তিগত সম্পত্তি) না। কারো ফ্যামিলির প্রপার্টি (পরিবারের সম্পত্তি) না।’
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আমরা মনে করি, আওয়ামী লীগ অনেক পুরনো পার্টি, সেখানে নতুন নেতৃত্ব আসবে। তারা এ শিক্ষাটা গ্রহণ করবে। আমি চেষ্টা করব পলিটিক্যাল পার্টি অ্যাক্ট যাতে থাকে। সে অনুযায়ী দল চালাতে পারলে চালাবেন, নয়তো বন্ধ করে দেবেন।’
পুলিশ চলবে কমিশনের নিয়মে
রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে সাংবাদিকদের পুলিশের সংস্কার, তাদের যোগদান এবং অতীতে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয়েছে বলে মন্তব্য করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘পুলিশকে আর লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। এখন থেকে পুলিশ চলবে পুলিশ কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী। আপনি পুলিশ কমিশনকে অর্ডার (নির্দেশ) দেবেন, সেটা তারা ভালো হলে করবে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে পারবেন না।’
এম সাখাওয়াত বলেন, ‘আমি খুব স্পষ্টবাদী। পুলিশের হাতে প্রাণঘাতী অস্ত্র দেওয়া হয়েছে। পুলিশকে এই অস্ত্র দেওয়া ঠিক হয়নি। পুলিশের হাতে ৭.৬২ (রাইফেল) দেখে আশ্চর্য হয়েছি। এটা যাতে ভবিষ্যতে না হয়। আমি অত্যন্ত পরিষ্কার ভাষায় বলছি, রাজনীতিবিদরা আমাকে পছন্দ করুক আর নাই করুক, এখন এ দেশে রাজনীতি করা ডিফিকাল্ট (কঠিন) হবে।’
গুলি চালানোর হুকুমদাতাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া হবে জানিয়ে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘এখন আমাদের খুঁজে বের করতে হবে কারা পুলিশকে এভাবে ব্যবহার করেছে, তাদের উদ্দেশ্যটা কী? যেটা হয়েছে, আন্তর্জাতিক তদন্ত হবে, দেশি তদন্ত হবে। হুকুমদাতাদের বেশি ধরা হবে। খুঁজে বের করা হবে, উদ্দেশ্য কী ছিল এবং কার ভূমিকা কী ছিল।’
তিনি বলেন, ‘আপনাদের অনেকের হয়তো মনে আছে, আমরা কতিপয় ব্যক্তি ৪ আগস্ট সেনাবাহিনী সম্পর্কে কী বলেছি। আমাদের আর্মির জওয়ানরা বাইরে ঠিকই আছে, আমরা অনুরোধ করেছি আপনারা এ দেশের আর্মি, আপনারা একটা গুলি চালাবেন না। আর্মিকে দিয়ে যদি এই কাজ করানো হতো, তাহলে আরো রক্তপাত হয়ে যেত। আর্মি বলেছে—আর না, আপনি এখন চলে যান।’
পুলিশকে সময় বেঁধে দেওয়া হলো
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আমরা একটি তারিখ ঘোষণা করব। ওই তারিখের মধ্যে কোনো পুলিশ সদস্য কর্মস্থলে না এলে আমরা ধরে নেব তিনি পলাতক। আমার কাছে অনেক মেকানিজম (প্রক্রিয়া) আছে। তাৎক্ষণিকভাবে ঘাটতি পূরণের অনেক মেকানিজম আছে। আমি তা উল্লেখ করতে চাই না। সাত দিনের ভেতর আপনারা দেখবেন ট্রেনিং ম্যানপাওয়ার পুলিশে চলে আসবে।’
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘পুলিশ ফোর্স, তারাও যে কিছু করেনি—তা আমি বলব না। পুলিশের ওপর যে হামলা হয়েছে, তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। কারণ একজনকে গুলি করে মারা আর মাথার চামড়া তুলে ফেলা, পা টুকরো টুকরো করা, মাথা থেঁতলে দেওয়া—এটা তো আপনি কাউকে করতে পারেন না। আমরা যুদ্ধের সময়ও একজন মৃত সৈনিককে এভাবে থেঁতলে দিই না। এটাও দুঃখজনক। হাজার তরুণ মারা গেছে পুলিশ ও অন্যদের গুলিতে। এটাও দুঃখজনক।’
আইন নিজের হাতে না তুলে নিতে সবার প্রতি অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বিচার করার প্রক্রিয়াটা আমরা করব। বিচার বিভাগ বিচার করবে। ঢালাওভাবে কাউকে দোষারোপ করা যাবে না। জনগণকে আমি এটুকু বলতে চাই, আপনারা পুলিশের গায়ে হাত ওঠাবেন না।’
আনসারের বিক্ষোভ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সবারই দাবিদাওয়া আছে। আমারও দাবিদাওয়া আছে। আমার দাবিদাওয়া হলো যে আপনারা ফিরে যান, আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে এটা আমার দায়িত্ব। আপনাদের কাছে আসা, আপনাদের কথা শোনা এবং যত দূর সম্ভব আমার পক্ষে ইমিডিয়েট ( দ্রুততার সঙ্গে) যা করার করব।’
ছাত্ররা প্রশংসা সনদ পাবে
ছাত্ররা ভালো কাজ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ট্রাফিকের কাজ করছে, তাদের প্রত্যেককে একটি করে সার্টিফিকেট বা প্রশংসাপত্র দেওয়া হবে। এই সার্টিফিকেট তাদের শিক্ষাজীবনের বিভিন্ন স্তরে তথা শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে যাতে মূল্যায়ন হয়। তারা (ছাত্র) নিজের টাকা খরচ করে ভালো ভালো কাজ করছে। সরকারি প্রজেক্ট হলে শত শত কোটি টাকা খরচ হতো। তারা সড়ক পরিষ্কার করছে, দেয়ালে আলপনা করে দেশ সাজাচ্ছে—তাদের মূল্যায়ন করতে হবে।’
গণভবন ভাঙচুর প্রসঙ্গ
গণভবন ও ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে ভাঙচুর প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কোনো ধ্বংসাত্মক র্কমকাণ্ডই ভালো নয়। এগুলো কোনো ব্যক্তিগত সম্পদ নয়। এটা রাষ্ট্রীয় সম্পদ। এটার আমি নিন্দা করি, যারা করেছে আমি আশা করব, আমাদের ছাত্ররা যারা আছে এখনো রাস্তায়, তারা এটি করতে দেবে না।’
তিনি এও বলেন, সারা বিশ্বে যখন কোনো গণ-অভ্যুত্থান হয়, গণ-অভ্যুত্থান কোনো সীমাবদ্ধতা, কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে হয় না। এটা শুধু বাংলাদেশে নয়। কিছুদিন আগে একটা দেশে এমন হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে আরব বসন্ত দেখা গেছে। রাশিয়ায় হয়েছে।
সংখ্যালঘুদের রক্ষা করা সবার দায়িত্ব
সারা দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হচ্ছে—এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের গায়ে হাত যেন না পড়ে। সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের যারা আছে, এটা তাদের একান্ত কর্তব্য। আপনারা যদি না করেন, মসজিদে গিয়ে সারাক্ষণ নামাজ পড়েন, এটার হিসাব আপনাকেও দিতে হবে যে আপনি কেন প্রটেক্ট (রক্ষা) করতে পারলেন না; যারা আপনার কাছে প্রটেকশন (সুরক্ষা) চেয়েছে। এটা আমাদের ধর্মেই আছে।’
এ জাতীয় আরো খবর..