আর্থিক সংকটে ভুগছে আইসিবি ইসলামী ব্যাংক। আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না ব্যাংকটির মৌলভীবাজার শাখা। আরো একাধিক ব্যাংক রয়েছে, যারা পাঁচ লাখ টাকার বেশি তুলতে চাইলে দিতে পারছে না। গত সপ্তাহে গ্রাহকের চাপে আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের মৌলভীবাজার শাখা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়।
কর্মকর্তারা বলেন, ‘অফিস খুলে গ্রাহকদের মার খাব নাকি?’
দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে ব্যাংকে আসা গ্রাহকরা টাকা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন। এতে দুশ্চিন্তায় হতাশা বাড়ছে প্রবাসী ও পর্যটন অধ্যুষিত এই জেলার গ্রাহকদের। ব্যাংকের কর্মকর্তারা নানাভাবে গ্রাহককে বোঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছেন। কোনো কোনো গ্রাহককে চেকের অঙ্ক বুঝে কম করে হলেও কিছুটা অর্থ দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
ব্যাংকের ওই শাখায় টাকা জমা নিলেও তুলতে যত ঝামেলা। পর্যাপ্ত টাকা নেই বলে চেক ফিরিয়ে দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। দু-চার দিন ব্যাংকে আসা-যাওয়া করেও টাকা উত্তোলনের কোনো সুরাহা হচ্ছে না। প্রতিদিনই ভিড় বাড়ছে টাকা উত্তোলনকারী গ্রাহকের।
ব্যাংক থেকে আমানত ফেরত না পাওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। ছোট অঙ্কের আমানত ফেরত দিলেও বড় অঙ্কের আমানত এখনো ফেরত দিতে পারছে না কয়েকটি ব্যাংক। এদিকে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ ফেরত দিতে পারছে না বেসিক ব্যাংক। এসব প্রতিষ্ঠানকে আমানত ফেরত না নেওয়ার জন্য অনুরোধও করেছেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে মার্জারের খবরে আমানত হারাতে শুরু করেছে উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক।
আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালে গড়ে ওঠে শরিয়াভিত্তিক আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। কয়েক বছর ধরে ব্যাংকটি লোকসানে আছে এবং ২০২৩ সাল শেষে ব্যাংকটির এক হাজার ৮২৩ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে ৭৯০ কোটি চার লাখ টাকা বিতরণ করা ঋণের (বিনিয়োগ) ৮৭ শতাংশই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একীভূতকরণের তালিকায় রয়েছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, কারণ তারল্য সংকটে ধুঁকছে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকটি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পিপলস লিজিংয়ের পর আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ফনিক্স ফাইন্যান্স। প্রতিদিনই জমানো টাকা তুলতে এসে ঘুরে যাচ্ছেন গ্রাহক। প্রতিষ্ঠানটি এতটাই চাপে আছে যে ২৫ থেকে ৩০ জন কর্মকর্তাকে চাকরি ছাড়ার মৌখিক নির্দেশ দিয়েছে কম্পানিটির হিউম্যান রিসোর্স ডিপার্টমেন্ট। শেষ বয়সে চাকরি চলে গেলে কী হবে, সেই আতঙ্কে বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ করেছেন ওই কর্মকর্তারা।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পিপলস লিজিংয়ের অবসায়ন বা বিলুপ্তির ঘোষণা জানাজানি হওয়ার পর থেকেই পুরো আর্থিক খাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ খাতের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেগুলো দীর্ঘদিন ধরে গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, নানা অনিয়ম-অব্যবস্থাপনায় চলছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপও বেড়েছে অনেক। ফলে বাড়ছে নানা রকম জাল-জালিয়াতি, অর্থপাচার ও আত্মসাতের মতো ঘটনা। এতে নাজুক অবস্থায় পড়েছে পুরো আর্থিক খাত। এ অবস্থা থেকে ফেরাতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত করে সুশাসন নিশ্চিত জরুরি। পাশাপাশি ঋণ কেলেঙ্কারির নেপথ্যে যাঁরা তাঁদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।
ফনিক্স ফাইন্যান্স
লোকসান কমাতে এখন কর্মী ছাঁটাইয়ের পথ বেছে নিয়েছে ফনিক্স ফাইন্যান্স। যাঁরা চাকরি ছাড়ার মৌখিক নির্দেশ পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে একজন বলেন, ‘এই বয়সে আমরা কোথায় যাব? কী করব? ছেলেমেয়েদের কী খাওয়াব?’
নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আস্থা হারানো একটি কম্পানির নাম ফনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে ৫৮ শতাংশই খেলাপি।
ফনিক্স ফাইন্যান্সের কম্পানি সচিব (চলতি দায়িত্ব) সাব্বিরুল হক চৌধুরী বলেন, ‘আমানতকারীদের টাকা ফেরত না দিতে পারার বিষয়টা সত্য। প্রতিদিন অনেক গ্রাহক আসেন, যাঁদের টাকা আমরা ফেরত দিতে পারছি না। যখনই কোনো টাকা আদায় হচ্ছে, গ্রাহকের চাহিদা পূরণ করার চেষ্টা করছি।’
আর্থিক খাত
বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত ৩৫ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্ধেকই এখন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে। এর মধ্যে সংকটে আছে অন্তত ১০টি। পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে বারবার।
২০২০ সালের জুনভিত্তিক বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ স্ট্রেস টেস্টিং রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশের ৩৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র চারটির আর্থিক স্বাস্থ্য ভালো ছিল। বাকি ২৯টির অবস্থা ছিল নাজুক। ক্যাটাগরি অনুযায়ী ওই সময় ১৮টি প্রতিষ্ঠান ছিল ইয়োলো এবং ১১টি প্রতিষ্ঠান ছিল রেড জোনে। এর পর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক আর স্ট্রেস টেস্ট রিপোর্ট প্রকাশ করেনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, বর্তমানে ১৭টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ৫০ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে সাতটি প্রতিষ্ঠানের বিতরণ করা মোট ঋণের ৯০ শতাংশই খেলাপি হয়ে গেছে।
যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি সেগুলো হলো—পিপলস লিজিং ৯৯.০২ শতাংশ, বিআইএফসি ৯৬.৮৫ শতাংশ, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ৯৪.৭৬ শতাংশ, ফারইস্ট ফাইন্যান্স ৯৪.৪১ শতাংশ, জিএসপি ফাইন্যান্স ৯২.৩৭ শতাংশ, এফএএস ফাইন্যান্স ৮৯.৫৬ শতাংশ, ফার্স্ট ফাইন্যান্স ৮৯.৪১ শতাংশ, আভিভা ফাইন্যান্স ৭১.৭২ শতাংশ, প্রিমিয়ার লিজিং ৬৬.৭৪ শতাংশ, সিভিসি ফাইন্যান্স ৫৯.৩৯ শতাংশ, মেরিডিয়ান ফাইন্যান্স ৫৯.১৭ শতাংশ, আইআইডিএফসি ৫৮.৬৪ শতাংশ, হজ্জ ফাইন্যান্স ৫৭.৭৯ শতাংশ, ফনিক্স ফাইন্যান্স ৫৭.৭৭ শতাংশ, ন্যাশনাল ফাইন্যান্স ৫৬.৮৬ শতাংশ, বে লিজিং ৫২.৮২ শতাংশ এবং উত্তরা ফাইন্যান্স ৫০.৮২ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৭টির খেলাপি ঋণের হার ৫০ শতাংশের ওপরে। সবগুলো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মোট খেলাপি ২১ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা হলেও এই ১৭টি প্রতিষ্ঠানের সামষ্টিক খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৭ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
গত কয়েক বছর সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদারের নাম। পরিচালনা পর্ষদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে একাই চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্থ লোপাটের অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে। এগুলো হলো পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যানশিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স করপোরেশন লিমিটেড (বিআইএফসি), ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যানশিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড ও এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও এফএএস ফাইন্যান্সের স্বতন্ত্র পরিচালক ও চেয়ারম্যান নূরুল আমিন বলেন, ‘অন্যান্য খাতের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। এর প্রধান কারণ ব্যাংক যে ব্যবসা করে তার বাইরে বিশেষ কোনো কাজ করে না আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। ব্যাংকে যারা ঋণ পায় না তারা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে আসে। এখান থেকে ঋণ নেয়। একটা সময় খেলাপি হয়ে পড়ে। কিন্তু এদের মার্চেন্ট ব্যাংক, সাবসিডিয়ারি ও পুঁজিবাজারের সঙ্গে যুক্ত হওয়া উচিত ছিল। এগুলো না করার কারণে খাতটি খেলাপি সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত হয়ে গেছে। তা ছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মনিটরিং সিস্টেম দুর্বল, দক্ষ কর্মীর অভাবসহ বিভিন্ন কারণে তারা বিতরণ করা ঋণ আদায় করতে পারে না।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের ৯ শতাংশ। ২০২২ সাল শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮.১৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ছাড়নীতির কারণে গত কয়েক বছর ব্যাংক খাতে লাগামহীন খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এর ফলে সরাসরি প্রভাব পড়েছে ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনায়। ছাড়ের কারণে অনেকে ভাবছে ঋণের টাকা না দিলেও চলবে। তাই যাদের অবস্থা ভালো তারাও টাকা ফেরত দিচ্ছে না। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভালো গ্রাহক। যারা প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত তাদের বেছে বেছে এ সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। তবে এভাবে ঢালাওভাবে ছাড় দেওয়া ব্যাংক খাতের জন্য খুবই খারাপ চর্চা। এর ফলে ভালো গ্রাহকরাও দেখা যাবে খেলাপি হয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, খেলাপি ঋণের যে চিত্র, এটা প্রকৃত চিত্র নয়। খেলাপি ঋণের সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। মূলত এটি একটি গাণিতিক হিসাব। শেষ প্রান্তিকে খেলাপি কমা মূলত ব্যালান্সশিট ভালো দেখানোর জন্য। এটা যদি সব সময় কমতে থাকে, তাহলে এ খাতের জন্যই ভালো। এসব সমস্যা সমাধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্ত ভূমিকা পালন করার পরামর্শ এই অর্থনীতিবিদের।
এ জাতীয় আরো খবর..