×
  • প্রকাশিত : ২০২৪-০৫-১৫
  • ৫৫ বার পঠিত
বর্তমান প্রেক্ষাপটে আগামী বাজেট শিল্পোদ্যোক্তাদের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে করসংক্রান্ত পদক্ষেপ যেন ব্যবসার ওপর নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে, এ বিষয়ে লক্ষ রাখা জরুরি। পাশাপাশি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, করনীতির মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস করার পদক্ষেপ আশা করেন এফবিসিসিআই-এর সভাপতি মাহবুবুল আলম। একান্ত সাক্ষাৎকারে বাজেট সম্পর্কে প্রত্যাশার কথা জানান তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্টাফ রিপোর্টার-সাদ্দাম হোসেন ইমরান

মাহবুবুল আলম : প্রথমেই আমি প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাতে চাই। কারণ, তার দিকনির্দেশনা, দূরদর্শী ও বিচক্ষণ পরিকল্পনা এবং আন্তরিক প্রয়াস আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সুদৃঢ় করেছে। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ করেছে। বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। সে সঙ্গে আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট-উন্নত বাংলাদেশে উন্নীত হওয়ার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। বর্তমানে জাতীয় অর্থনীতি একটি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়ালেও করোনা-পরবর্তী দীর্ঘমেয়াদি বিরূপ প্রভাব, চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্য সংকট অর্থনীতিকে নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে। এর সঙ্গে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের চ্যালেঞ্জও আছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যসহায়ক পরিবেশকে আরও সুদৃঢ় ও জোরদার করা জরুরি। বর্তমান সরকার পরপর চারবার দায়িত্ব গ্রহণ করায় আগামী বাজেটকে ঘিরে ব্যবসায়ী সমাজ ও জনগণের ব্যাপক প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছে। সামগ্রিক বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে এবারও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে একটি জনমুখী ব্যবসাবান্ধব বাজেট প্রণীত হবে বলে আশা করি।

মাহবুবুল আলম : বর্তমান পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রেমিট্যান্স প্রবাহ, রপ্তানি বৃদ্ধি, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, সুদের হার এবং আর্থিক ও ব্যাংক খাতের সংস্কারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। এছড়া ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন কার্যক্রম জোরদার, কর-জিডিপি অনুপাত বাড়নো, রাজস্ব নীতির সংস্কার, মুদ্রা ও রাজস্ব নীতির মধ্যে সমন্বয়, সর্বস্তরে সুশাসন এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাই জাতীয় অর্থনীতিতে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে বলে আমি মনে করি। বিদ্যমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় নিয়ে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা সুদৃঢ় করতে বাজেটে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকবে বলে এফবিসিসিআই আশা করে।

মাহবুবুল আলম : বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানকে দৃঢ় করতে ব্যবসায়িক খরচ (কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস) কমিয়ে আনা জরুরি। বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি, সুষম বিনিয়োগসহায়ক মুদ্রা ও শুল্ক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা, শিপিং খরচসহ সব ধরনের পরিবহণ খরচ হ্রাস এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ স্থায়ী পরিকাঠামো উন্নয়নে স্বচ্ছতা ও সুশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে ব্যবসার খরচ কমিয়ে আনা সম্ভব। পাশাপাশি কর আদায়ের ক্ষেত্রে হয়রানি ও জটিলতা দূরীকরণের মাধ্যমে ব্যবসাবান্ধব কর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে আগামী বাজেটে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য আমরা আহ্বান জানাচ্ছি।

মাহবুবুল আলম : ব্যাংক ও আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংক খাতের সংস্কার বিষয়ে সরকার ইতোমধ্যে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যা ইতিবাচক ফল নিয়ে আসবে বলে বিশ্বাস করি। পাশাপাশি বিনিয়োগ বাড়াতে এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকার লক্ষ্যে সুদের হার স্থিতিশীল রাখতে হবে। বিনিয়োগের স্বার্থেই সুদের হার কমিয়ে আনতে হবে। এছাড়াও বৈদেশিক অর্থায়নে এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং অপ্রয়োজনীয় ও অনুৎপাদনশীল প্রকল্প গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে। ডলার সংকট কাটাতে অর্থ পাচার রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত, রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি করার পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি রপ্তানি আয় বাড়াতে ইকোনমিক ডিপ্লোম্যাসি তথা বাংলাদেশের বৈদেশিক মিশনগুলোকে দেশের রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখা এবং কমার্শিয়াল কাউন্সিলরদের দায়িত্ব পালনের বিষয়ে জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসা উচিত।

মাহবুবুল আলম : আগেও বলেছি, করোনা-পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্য সংকট বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি উসকে দিয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে। রপ্তানি আয় বাড়াতে বাংলাদেশের বৈদেশিক মিশনগুলোকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। এক্ষেত্রে কমার্শিয়াল কাউন্সিলরদের জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসা উচিত। কারও পরামর্শে ঢালাওভাবে কর অব্যাহতি কমিয়ে আনতে গিয়ে এ মুহূর্তে রপ্তানি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়-এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। বরং রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে নগদ সহায়তার বিকল্প সুবিধা নিশ্চিত করতে হয়। এক্ষেত্রে বিকল্প সহায়তা হিসাবে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও পরিবহণ খাতে প্রণোদনা বা বিশেষ সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব করেছি আমরা। অন্যদিকে রপ্তানি খাতের করসংক্রান্ত জটিলতা যেমন: উৎসে কর এক শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক ৫০ শতাংশ নির্ধারণ করে ৫ বছর বহাল রাখা, নগদ সহায়তার ওপর উৎসে কর ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ এবং বন্ড-কাস্টমসে হয়রানি দূর করতে মনোযোগী হতে হবে। কারণ, ডলার সংকটের এ মুহূর্তে কেবল রপ্তানি খাতই পারে অর্থনীতির ভারসাম্য স্থির রাখতে।

মাহবুবুল আলম : ১৫ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ৯০ বিলিয়ন ডলার থেকে ৪৭০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকলে এক ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত হতে বেশি সময় লাগবে না। তবে সেই অনুপাতে আমাদের সক্ষমতা হয়নি। এ মুহূর্তে এনবিআরসহ সব সরকারি দপ্তর এবং বাণিজ্য সংগঠনের সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে মনোযোগ দেওয়া; যাতে অর্থনীতির স্বার্থে ব্যবসা-বাণিজ্যসংশ্লিষ্ট সব মহল সরকারকে সঠিক পরামর্শ দিতে পারে। রাজস্ব খাত সংস্কারে বেশকিছু প্রস্তাব এনবিআরকে দেওয়া হয়েছে। কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে করহার কমিয়ে আয়কর ও ভ্যাটের আওতা সম্প্রসারণের বিকল্প নেই। কারণ, বিদ্যমান করদাতাদের চাপ দিয়ে ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হওয়া সম্ভব নয়। বর্তমানে যারা ট্যাক্স দিচ্ছেন, তাদের ওপরে বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এজন্য সবার আগে প্রয়োজন এনবিআরের সমন্বিত ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন সংস্কার।

মাহবুবুল আলম : হয়রানি কমাতে সর্বপ্রথম এনবিআরকে ডিজিটালাইজ করতে হবে। আমদানি পণ্য খালাসে বিদ্যমান অ্যাসাইকুডা সিস্টেমের উন্নয়নসহ বাংলাদেশ সিঙ্গেল উইন্ডো দ্রুত বাস্তবায়নে মনোযোগ দিতে হবে। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। অথরাইজড ইকোনমিক অপারেটর সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া যায়। এছাড়া এনবিআর-এর রাজস্ব আহরণ ও রাজস্ব পলিসি কার্যক্রম পৃথক করা এবং ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন বিভাগ নামে একটি বিভাগ গঠন করা যেতে পারে। এছাড়া সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাসহ বাজেট সমন্বয় নামে স্থায়ীভাবে পৃথক একটি অনুবিভাগ গঠন করার সময় এসেছে বলে আমি মনে করি। উপজেলায় আয়কর অফিস চালু করে সক্ষম করদাতাদের আয়করের আওতায় নিয়ে আসা, ন্যাশনাল ট্যারিফ পলিসি বাস্তবায়নের দায়িত্ব (স্থানীয় শিল্পের স্বার্থে) এনবিআর ও ট্যারিফ কমিশনকে দেওয়া উচিত। ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, নিরীক্ষা ও পরির্দশনসংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করতে বিধিগত পদ্ধতি যথাযথভাবে অনুসরণের প্রস্তাব করেছি আমরা।

মাহবুবুল আলম : প্রথমত, বর্তমান মূল্যস্ফীতি এবং নিম্ন-আয়ের মানুষের প্রকৃত আয় বিবেচনায় নিয়ে ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা এক লাখ টাকা বাড়িয়ে সাড়ে ৪ লাখ টাকা করা প্রয়োজন। এছাড়া আমদানি পর্যায়ে অগ্রিম আয়করের (এআইটি) হার ধাপে ধাপে কমিয়ে আনার প্রস্তাব করেছি। পাশাপাশি ক্ষুদ্র, মাঝারিসহ সব দেশীয় শিল্পে উৎপাদিত মোড়ক (প্যাকেজিং) পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে অগ্রিম আয়কর ৭ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ২ শতাংশ করা, নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যকে উৎসে কর কর্তনের আওতাবহির্ভূত রাখা, আপিলাত ট্রাইব্যুনাল নিরপেক্ষ করার জন্য কর বিভাগের বাইরে থেকে অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ অথবা প্রফেশনালদের নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। সর্বোপরি উৎসে কর কর্তনের হার নির্ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সমীক্ষা করার দাবি জানাই।

মাহবুবুল আলম : আমদানি পর্যায়ে ৩-৫ শতাংশ আগাম কর আদায় করা হয়, এটি প্রত্যাহার করা উচিত। আমি মনে করি, আদর্শ ভ্যাট পদ্ধতির সঙ্গে এ পদ্ধতি বৈষম্যমূলক। ভ্যাট আদায় বাড়াতে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সব সিটি করপোরেশন এলাকায় শপিংমলে ইএফডি মেশিন সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া যায়। বিশেষত অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জুয়েলারি খাত, রেস্টুরেন্ট এবং বিভিন্ন শপিংমলের দোকানে অতি দ্রুত ইএফডি মেশিন সরবরাহ করতে পারলে ভ্যাট আদায় বাড়বে। এছাড়া ভ্যাট আপিল দায়েরের ক্ষেত্রে দাবিকৃত করের ২০ শতাংশ বাধ্যতামূলকভাবে জমা করার বিধান হ্রাস করে ১০ শতাংশ করা এবং নিবন্ধিত বা তালিকাভুক্ত ব্যক্তি কর্তৃক উপকরণ-উৎপাদনসহ ঘোষণার বিধান বাতিল অথবা মূল্য ঘোষণার কলাম বাদ দিয়ে মূসক ফরম ৪.৩ সংশোধন করার প্রস্তাব করেছি।

মাহবুবুল আলম : প্রথমত, তৈরি পণ্যের সর্বোচ্চ শুল্কহার ২৫ শতাংশ থেকে ক্রমান্বয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে কমিয়ে আনা উচিত। দ্বিতীয়ত, দেশে উৎপাদিত যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ এবং মধ্যবর্তী কাঁচামালের শুল্ক ৫-৭ শতাংশ নির্ধারণ করার প্রস্তাব করেছি। তৃতীয়ত, শিল্পের যন্ত্রপাতি, তালিকাভুক্ত অত্যাবশ্যকীয় পণ্য, মৌলিক এবং দেশে উৎপাদিত হয় না-এমন কাঁচামালের শুল্ক ১-৩ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করেছি আমরা। শিল্পমালিকরা কাস্টমস সংক্রান্ত যে সমস্যাটিতে বেশি পড়েন, তা হলো মূলধনি যন্ত্রপাতির যন্ত্রাংশ আমদানি। মূলধনি যন্ত্রের খুচরা যন্ত্রাংশ শিল্প আইআরসির আওতায় পৃথকভাবে আমদানি করা হলে উচ্চ শুল্কে শুল্কায়ন করা হয়, যা বিনিয়োগ ও শিল্পের পরিপন্থি বলে আমি মনে করি। এজন্য মূলধনি যন্ত্রের প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ আমদানির ক্ষেত্রে রেয়াতি হারে অর্থাৎ ১ শতাংশ শুল্কায়ন করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় সংশোধনীর প্রস্তাব করেছি। সর্বোপরি উৎপাদনকারী, আমদানিকারক এবং ট্রেডার্সদের উদ্ভূত সমস্যা নিরসনে এনবিআর-এর আয়কর, মূসক ও শুল্ক বিভাগে প্রতি তিন মাস পর আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা খুবই জরুরি। এটি করা গেলে হয়রানি অনেকাংশে কমবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat