×
  • প্রকাশিত : ২০২২-০৭-১৬
  • ৪৭ বার পঠিত
কয়েক দিন আগের ঘটনা। রাত প্রায় আড়াইটা। সেই গভীর রাতে খবর এলো কেরানীগঞ্জের একটি বাড়িতে বড় একটি সাপ ঢুকে পড়েছে। বাড়ির সবাই আতঙ্কিত।

কোনো মানুষকে বিপন্ন না করে সাপটিকে উদ্ধার করতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো, এত রাতে জাহাঙ্গীরনগর থেকে বেশ দূরের কেরানীগঞ্জে যাওয়ার যানবাহন কোথায় পাওয়া যাবে! উপায়ান্তর না পেয়ে মালবাহী ট্রাকে চড়েই রওনা দেন ‘ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশনের’ সদস্যরা। কেরানীগঞ্জ পৌঁছে উদ্ধারও করেন একটি মারাত্মক বিষাক্ত সাপ। এতে করে মানুষের প্রাণরক্ষা তো হলোই, একই সঙ্গে সাপটিও পিঠে লাঠির আঘাত পড়ার আগেই রেহাই পেল। উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা সাপটিকে বনে ছেড়ে দিলেন।
প্রায়ই সর্পদংশনের খবর আসে সাপ সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করা এই ফাউন্ডেশনের হটলাইনে। সাপে কাটলে এখনো বেশির ভাগ মানুষ মূলত আগে ওঝার খোঁজ করে। কিন্তু বিষধর সাপের দংশিত ব্যক্তিকে দ্রুত উপযুক্ত হাসপাতালে পৌঁছাতে না পারলে মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে। সাপে কাটার পর প্রথম ১০০ মিনিট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে ফাউন্ডেশনের সদস্যরা খোঁজ পেলে দ্রুত আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন বা পরামর্শ দেন।

সংগঠনটির উদ্ধার দলের পরিচালক সৈয়দা অনন্যা ফারিয়া জানালেন, এখন পর্যন্ত সাপে কাটা এক হাজার ২০০-এর বেশি মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছেন তাঁদের সদস্যরা। ফারিয়া আরো বললেন, দেশের সব হাসপাতালে এখনো সাপে কাটার ওষুধ অ্যান্টি ভেনম নেই। তারা তাই অ্যান্টি ভেনম আছে এমন হাসপাতালের খোঁজ দেন লোককে। ‘রোগী সুস্থ হওয়ার পর ফোন দিয়ে যখন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তখন খুব ভালো লাগে’, বললেন পরিচালক ফারিয়া।

ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাহফুজুর রহমান জানালেন, সারা দেশে সাড়ে পাঁচ শর বেশি উদ্ধারকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবী রয়েছে ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশনের। ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে সাংগঠনিকভাবে দেড় হাজারের বেশি সাপ তাঁরা উদ্ধার করেছেন। অন্যান্য বন্যপ্রাণী উদ্ধার করেছেন সাড়ে পাঁচ শর বেশি। রাজ গোখরা, পদ্ম গোখরা, খৈইয়া গোখরা, শঙ্খিনী, কেউটে, দাঁড়াশ, অজগর, ঘরগিন্নি, ঢোঁড়া, বেত আচরাসহ অনেক ধরনের বিষধর ও নির্বীষ সাপ তাঁরা উদ্ধার করে প্রকৃতিতে ছেড়ে দিয়েছেন। কিছুদিন আগে তাঁরা মুন্সীগঞ্জ থেকে উদ্ধার করেছেন কয়েকটি রাসেল ভাইপার সাপ, যা এমনিতে বাংলাদেশে দেখা যায় না।

সাপ উদ্ধারকারী দলে প্রথম নারী হিসেবে কাজ শুরু করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্রী সৈয়দা অনন্যা ফারিয়া। বর্তমানে তিনি সংগঠনটির প্রচার সম্পাদক ও উদ্ধার শাখার পরিচালক। ফারিয়া জানালেন, শুরুতে এই কাজে নারীদের সম্পৃক্ততা না থাকলেও বর্তমানে তাঁদের দলে আরো পাঁচজন নারী কর্মী কাজ করছেন। প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন আরো ২০ জন। শিগগিরই তাঁরাও উদ্ধারকর্মী হিসেবে সংগঠনে দায়িত্ব পালন করবেন।

শুরুতে অনন্যা যখন উদ্ধারকাজে যেতেন তখন তাঁকে দেখে লোকে সংশয় প্রকাশ করত। একটি মেয়ে আদৌ সাপ উদ্ধার করতে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতেন অনেকেই। এমনও হয়েছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাঁকে বসে থাকতে বলে কোনো পুরুষকে ভেতরে যেতে অনুরোধ করেছেন। কিন্তু তাঁর সহকর্মীরা জানাতেন অনন্যাই তাঁদের উদ্ধার দলের নেত্রী। গণমাধ্যমে এ নিয়ে প্রচারের ফলে এখন এই মনোভাবে পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন অনন্যা।

বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ অনুযায়ী, সাপসহ যেকোনো বন্য প্রাণী সরকারের নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ ছাড়া ধরা বা বহন করা দণ্ডনীয় অপরাধ। সাপ উদ্ধারের আগে তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে নেন তাঁরা। ম্যানহোলে পড়ে যাওয়া কুকুর-বেড়াল বা অন্য কোনো বন্য প্রাণী জরুরিভাবে উদ্ধারে ৯৯৯ নম্বরে ফোন গেলেও অনেক সময় তাঁদের ডাক পড়ে।

‘ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশন’-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহফুজুর রহমান। কালের কণ্ঠকে তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক হলে সাপ ঢুকলে তাঁকে শিক্ষার্থীরা সাধারণত পিটিয়ে মেরে ফেলতেন। তা দেখেই ২০১৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সাপ না মেরে তাঁকে উদ্ধার করে প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা জাগে তাঁর মনে। এর পর সমমনা কয়েকজনকে নিয়ে ফাউন্ডেশনের শুরু হয়।  

মাহফুজুর রহমান বলেন, খুব দ্রুতই বাইরে থেকেও সাপ উদ্ধারের জন্য অনুরোধ আসতে শুরু করে। তখন তারা সারা দেশে সাংগঠনিকভাবে সাপসহ বন্য প্রাণী উদ্ধারের জন্য ভাবতে শুরু করেন। বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর ছাড়াও ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী ও কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংগঠনিকভাবে বন্য প্রাণী উদ্ধার করে প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়ার কাজ করছেন তাঁদের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থীরা।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধরে রাখার জন্য প্রকৃতির সব প্রাণীই কমবেশি প্রয়োজনীয়। প্রত্যেকের বাঁচার অধিকারও আছে। আপাতভাবে সাপকে ভয়ংকর মনে হলেও প্রকৃতিতে তারও অবদান রয়েছে। এ বিষয়টিকে সবার সামনে তুলে ধরতেই বিশ্বে প্রতিবছর ১৬ জুলাই আন্তর্জাতিকভাবে ‘সাপ দিবস’ পালন করা হয়ে থাকে। মাহফুজুর রহমান বললেন, ‘লোকালয় থেকে সাপ উদ্ধার করা কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। আমরা বন্য প্রাণীর আবাসস্থল রক্ষা করতে না পারলে তারা জনবসতিতে এসে মানুষের হাতে মারা পড়বেই। সাপসহ বন্য প্রাণীর আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত না করলে তারা মানুষের ক্ষতি করতে আসবে না। এ জন্য আমাদের সচেতন হতে হবে। ’ আর সাপে কাটলে ওঝার কাছে ঝাড়ফুঁকের জন্য না গিয়ে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার কথাও আবার মনে করিয়ে দিলেন মাহফুজুর রহমান।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat