×
  • প্রকাশিত : ২০২৪-০৮-১৫
  • ৫৯ বার পঠিত
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় সারা দেশে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি, হত্যার নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারী হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মামলা হয়েছে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত বাগেরহাটের আরিফ আহমেদ সিয়ামের বাবা মো. বুলবুল কবির গতকাল বুধবার দুপুরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় লিখিত অভিযোগ করেন। তদন্ত সংস্থার উপপরিচালক (প্রশাসন) ও তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগটি গ্রহণ করেন। পরে তা অভিযোগ নিবন্ধন বইয়ে নিবন্ধন করা হয়।

কোনো অভিযোগ নিবন্ধনের পর তা মামলা হিসেবে গণ্য করা হয়। 
হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যার তদন্ত শুরুতদন্ত সংস্থার উপপরিচালক (প্রশাসন) ও তদন্ত কর্মকর্তা মো. আতাউর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দুপুর দেড়টায় আমরা অভিযোগটি গ্রহণ করেছি। অভিযোগটি নিবন্ধন বইয়ে নিবন্ধনভুক্ত করা হয়েছে। এই নিবন্ধনের মানে মামলা হয়েছে।

আমরা তদন্তকাজও শুরু করে দিয়েছি। আপাতত পেপারওয়ার্ক করছি।’
একই অপরাধে ব্যক্তির পাশাপাশি দল ও সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। শেখ হাসিনার সঙ্গে অন্য যাঁদের আসামি করা হয়েছে, তাঁরা হলেন সাবেক সেতু মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত।

এ ছাড়া রয়েছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক মো. হারুন অর রশিদ, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ও ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক গোয়েন্দাপ্রধান হারুন অর রশীদ। এসব আসামির পাশাপাশি আবেদনে নাম উল্লেখ না করে শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং ঢাকা মহানগর পুলিশের কর্মকর্তা ও সদস্যদের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা চাওয়া হয়েছে।
এদিকে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তার বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। গতকাল সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, গত ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলোর বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করা হবে। এসব ঘটনার তদন্ত জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণের আলাদা দুটি অভিযোগ নিয়মিত এজাহার হিসেবে গ্রহণ করতে রাজধানীর কাফরুল ও উত্তরা পশ্চিম থানার ওসিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গতকাল ঢাকা মহানগরের মুখ্য বিচারিক হাকিম (সিএমএম) আদালত এই নির্দেশ দেন।

হত্যা মামলাটির বাদী ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার বাসিন্দা মো. রাজিব (৩২)। তাঁর ছোট ভাই ফয়জুল ইসলাম রাজন (১৮) কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় গত ১৯ জুলাই মিরপুর-১০ গোলচত্বর এলাকার ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। নিহত রাজন কাফরুল থানা এলাকার ঢাকা মডেল ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। এই মামলায় শেখ হাসিনাসহ ২৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। অন্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত ও যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান।

এই মামলার আইনজীবী তাজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আন্দোলন চলা অবস্থায় মামলা করা সম্ভব ছিল না। নিহতের বড় ভাই মো. রাজিব আজ (বুধবার) সিএমএম আদালতে অভিযোগ উল্লেখ করে মামলার আবেদন করেন। শুনানির পর আদালত এটি নিয়মিত এজাহার হিসেবে গ্রহণ করে আসামিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে কাফরুল থানার ওসিকে নির্দেশ দিয়েছেন।’  

অপহরণ মামলায় পাঁচজনকে আসামি করা হয়েছে। এই মামলা করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. সোহেল রানা। অন্য আসামিরা হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক ও বেনজীর আহমেদ। মামলায় র‌্যাবের অজ্ঞাতনামা ২০ থেকে ২৫ জন সদস্যকে আসামি করা হয়েছে।

এই মামলার বাদী সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সোহেল রানা দাবি করেন, ২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টার দিকে উত্তরা এলাকা থেকে তাঁকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে আটক করা হয়। পরে তাঁকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নানা নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন।

গণহত্যার অভিযোগে যা বলা হয়েছে

গত ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে উল্লেখ করে আবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনাসহ উল্লিখিত ব্যক্তিদের পরিকল্পনা ও নির্দেশে আন্দোলনকারী নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে তাদের সমূলে বা আংশিকভাবে নির্মূল করার উদ্দেশ্যে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটানো হয়েছে।

আবেদনে বলা হয়, সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের পাশাপাশি পুলিশ-র‌্যাবের সদস্যরা এই ঘটনায় জড়িত। নির্বিচার গুলিতে কমপক্ষে ৪৩৯ জন আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় কমপক্ষে ১০ হাজার আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয় এবং এক হাজার লোক চিরতরে অন্ধত্ব ও পঙ্গুত্ব বরণ করে। কয়েক হাজার ছাত্র-জনতা শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

কমপক্ষে ৩২ শিশু নির্মম গণহত্যার শিকার হয়েছে উল্লেখ করে আবেদনে বলা হয়, আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে নির্মূল করতে র‌্যাব সদস্যরা হেলিকপ্টার ব্যবহার করে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ও বোমা নিক্ষেপ করে গণহত্যা চালান।

সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং তথ্য ও সম্প্র্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাতের বিষয়ে আবেদনে বলা হয়েছে, তাঁদের নির্দেশে দেশব্যাপী ইন্টারনেটসেবা বন্ধ করে গণহত্যা চালানো হয়। গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের তথ্য গোপন করতেই ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছে।

আসামিদের নির্দেশ ও পরিকল্পনায় সারা দেশে ২৮৬টি মিথ্যা মামলায় সাড়ে চার লাখ আন্দোলনকারীকে আসামি করা হয়। তাদের মধ্যে ১২ হাজার আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। এসব কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন, ১৯৭৩-এর ৩(২), ৪(১)(২) ধারা অনুযায়ী গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ। অভিযোগটি নিবন্ধনভুক্ত করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, দল-সংগঠন সত্তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানানো হয়।

অভিযোগকারীর আইনজীবী গাজী এম এইচ তামিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তা বিচ্ছিন্ন কোনো অপরাধ নয় যে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে। পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনাগতভাবে অপরাধ ঘটানো হয়েছে।’

আইনজীবী বলেন, ‘এই আদালতে মামলা করার ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় অভিযোগ করতে হয়। সংস্থা অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার পর ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ আমলে নিয়ে বিচারিক কাজ শুরু করেন।’

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে বিচারের সুযোগ আছে কি না, জানতে চাইলে আইনজীবী তামিম বলেন, ‘আমাদের সাধারণ মানুষের ধারণা যে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত অপরাধ ছাড়া এই ট্রাইব্যুনালে বিচার হয় না। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন, ১৯৭৩-এ বলা আছে, আইন প্রণয়নের আগে-পরের সব অপরাধের বিচার এই ট্রাইব্যুনাল করতে পারেন।’

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত চারটি মামলা হয়েছে।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন। বর্তমানে তিনি ভারতে অবস্থান করছেন।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat