×
  • প্রকাশিত : ২০২৪-০৮-১০
  • ৩৪ বার পঠিত
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার পতনের পর গঠিত নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের সামনের দিনগুলো বেশ চ্যালেঞ্জের হবে বলে সর্বত্র আলোচনা চলছে। বিশ্লেষকদের ধারণা, আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে সার্বিকভাবে দেশে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে না।   

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন—এমন অভিজ্ঞজনরা বলছেন, শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর রাষ্ট্রক্ষমতায় কয়েক দিন ধরে শূন্যতা তৈরি চলছিল। প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের মাধ্যমে এখন এমন পরিস্থিতির অবসান ঘটেছে।

এখন সংকট কাটাতে অগ্রাধিকার ঠিক করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। অন্তত তিনটি বিষয় নিয়ে সরকারের কাজ শুরু করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তাঁরা। 
সরকার পতনের পর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি একেবারে ভেঙে পড়েছে। থানা ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েই উদ্বিগ্ন পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী।

এমন পরিস্থিতিতে প্রশাসন ও অন্যান্য সেক্টরেও চলছে চরম অস্থিরতা। আছে অর্থনৈতিক টানাপড়েনও। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়ে মানুষের বিপুল প্রত্যাশা।
বিশিষ্টজনরা প্রত্যাশা করছেন, দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময়, বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞদের মতামত নিয়ে সরকার কাজ করবে।

তাঁরা মনে করেন, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আস্থা নিয়ে কাজ করতে পারলে দেশে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের সমঝোতার বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন তাঁরা।
বিশ্লেষকরা বলেন, সরকারের ওপর দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সমর্থন রয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে যেসব অনিয়ম, অবিচার ও সংকট তৈরি হয়েছে, এসব  নিরসনে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সরকার সফল হবে বলে মনে করে সাধারণ মানুষ। তাদের এই প্রত্যাশার চাপ কিভাবে তিনি মেটাবেন, তার একটি কর্মপরিকল্পনা জনগণের সামনে উত্থাপন করা উচিত বলে মনে করেন তাঁরা।

বিশিষ্টজনরাও আশাবাদী, ড. ইউনূসের সরকার মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে।  
গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। গত বৃহস্পতিবার নতুন যে সরকার গঠিত হয়েছে, তার নেতৃত্বে রয়েছেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী ৮৪ বছর বয়সী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

ফ্রান্সভিত্তিক আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এএফপির এক বিশ্লেষণে বাংলাদেশ সরকারের সামনে পাঁচটি চ্যালেঞ্জের কথা উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার পরিচালিত হবে বেসামরিক নেতৃত্বে। তবে এই সরকারে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ কতটা থাকবে, সেটি এখনো স্পষ্ট নয়।

ওয়াশিংটনভিত্তিক চিন্তন প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যানের মতে, আনুষ্ঠানিকভাবে না থাকলেও এই সরকারে সামরিক নেতৃত্বের বড় প্রভাব থাকবে।

মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘বাংলাদেশের অনেকে আশঙ্কা করছেন, যদি অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ দীর্ঘ হয়, তাহলে তাতে সরকারে নিজেদের কর্তৃত্ব পাকাপোক্ত করার সুযোগ পাবে সেনাবাহিনী। তবে এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, সেনাবাহিনী সরকারে সক্রিয় ভূমিকা ও রাজনীতির কেন্দ্রে থাকার বিষয়ে অতটা আগ্রহী নয়, যেমনটা কয়েক দশক আগেও দেখা গিয়েছিল।’

এ ছাড়া আইন-শৃঙ্খলা, অর্থনীতি, নির্বাচন ও ন্যায়বিচার সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ বলে বিশ্লেষণে উঠে এসেছে।

বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা কালের কণ্ঠকে বলেন, অগ্রাধিকার নির্ধারণ করাটাই এখন গুরুত্বপূর্ণ কাজ। অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেও অগ্রাধিকার ঠিক করা যেতে পারে। তিনি বলেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে আনা, অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা ও রাষ্ট্র মেরামত—এই তিনটি বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ওপর অনাস্থা দীর্ঘদিনের। নানা কারণে জনমনে তাদের ওপর ক্ষোভ আছে, যার তীব্র বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এবারের আন্দোলনে। ফলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনাটা সময়সাপেক্ষ বিষয়। 

তবে প্রাথমিকভাবে সারা দেশে লুটপাট, হামলাসহ বিভিন্ন ধরনের অপ্রত্যাশিত ঘটনা থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় আসতেই হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসও এটিই এখন প্রধান কাজ বলে মন্তব্য করেছেন। গত বৃহস্পতিবার বিমানবন্দরে তিনি এই বিষয়টি অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা স্পষ্ট করেন। 

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরিয়ে আনাই প্রধান চ্যালেঞ্জ এবং এটিই সরকারের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।

২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশের গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ শতাংশের বেশি। ২০২১ সালে মাথাপিছু আয়ে ভারতকেও ছাড়িয়ে যায় বাংলাদেশ; কিন্তু এর পরও বাংলাদেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েছে। কারণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল সবাই সমানভাবে পায়নি।

সাম্প্রতিক অস্থিরতা দেশের পোশাক খাতকে বড় একটি নাড়া দিয়েছে। সহিংসতার সময় পোশাক কারখানাগুলো বন্ধ ছিল, হামলাও হয়েছে।

অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে হলে পোশাকশিল্পসহ উৎপাদন খাতে স্বাভাবিক কার্যক্রম ও স্থিতিশীলতা দরকার বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। আন্দোলনকালের ক্ষতি পোষাতে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে কর্মপরিকল্পনা ঠিক করার ওপর দৃষ্টি দেওয়া জরুরি বলে মন্তব্য করেন তাঁরা।

বিশ্বের শীর্ষ খুচরা পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক অস্থিরতার মধ্যে মার্কিন প্রতিষ্ঠান হুলা গ্লোবাল জানিয়েছে, কিছু ক্রয়াদেশ বাংলাদেশের বদলে অন্য দেশে দিয়েছে তারা।

আন্দোলনের সময় বাংলাদেশে যে বিষয়টি আলোচনা বেশি এসেছে, তা হলো রাষ্ট্র মেরামত। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে দলীয় লেজুড়বৃত্তি থেকে বের করে পেশাদারি ফিরিয়ে আনাটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।

তবে প্রশাসনিক সংস্কার স্বল্প মেয়াদে সম্ভব নয় বলে মনে করেন মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা। তিনি বলেন, সরকারের মেয়াদ কত হবে, তা স্পষ্ট নয়। লম্বা সময় পেলে দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করা যায়। প্রশাসন সংস্কারে একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি সরকারের উপদেষ্টা হলে সুবিধা হতো। তবে অভিজ্ঞদের পরামর্শ নিয়েও প্রশাসনে সংস্কার সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

গত জানুয়ারির যে নির্বাচনে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হন, সেই নির্বাচন ছিল বেশির ভাগ মানুষের কাছে অগ্রহণযোগ্য। প্রধান বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বর্জন করেছিল।

এএফপির বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক টমাস কিনের মতে, শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ যে ব্যাপক জনসমর্থন পেয়েছিল, তার একটি বড় কারণ এটি। কারণ গত ১৫ বছরে দেশটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক কোনো নির্বাচন হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকারকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফেরানোর জন্য দীর্ঘ মেয়াদে কাজ শুরু করা প্রয়োজন। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশটিতে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে।

প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি অতিদ্রুত এবং কখনো কখনো তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন দাবি করেছে। এ বিষয়ে দ্রুত ঘোষণা না এলে বিএনপি রাজনৈতিক চাপ তৈরি করতে পারে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

সবার জন্য আইন সমান—এই বিষয়টি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। আদালতের ওপর মানুষের যে আস্থাহীনতা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তা ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন তাঁরা।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী বলেন, বিপ্লবের মাধ্যমে সরকার গঠিত হলে তাকে বিপদে ফেলতে নানা পক্ষ ষড়যন্ত্র করে। এই ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করেন তিনি।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat