×
  • প্রকাশিত : ২০২৪-০৭-১৭
  • ১৫০ বার পঠিত
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনে রক্তাক্ত একটি দিন দেখলেন দেশবাসী। মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও পুলিশের সংঘর্ষে উত্তাল হয়ে ওঠে সারা দেশ। এ সময় ছয়জন নিহত ও কয়েকশ আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় ২ যুবক, চট্টগ্রামে দুই শিক্ষার্থী ও এক পথচারীসহ ৩ জন এবং রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। 
দফায় দফায় হামলা, ধাওয়া-পালটাধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, ককটেল বিস্ফোরণ, পুলিশের গুলিবর্ষণ ও রাবার বুলেট নিক্ষেপে রাজধানীর ঢাকা কলেজ ও সায়েন্স ল্যাব এলাকা, চট্টগ্রাম নগরী, রংপুর, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। মোড়ে মোড়ে ব্লকেডে রাজধানী অচল হয়ে পড়ে। গাজীপুর, চট্টগ্রাম, ফেনী, ময়মনসিংহ, রংপুরে রেলপথ অবরোধের খবর পাওয়া গেছে। এতে দূরপাল্লার যাত্রীরা চরম দুর্ভোগে পড়েন। 

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, রাজশাহী ও রংপুরে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণার পর রাত ১২টার দিকে ঢাবির বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হল, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেসা ও সুফিয়া কামাল হলের শিক্ষার্থীরা মোমবাতি জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন। 

ঢাকায় নিহত দুই, লাঠি-রডের মহড়া : কোটা বাতিলের একদফা দাবিতে ঢাকা কলেজের সামনে ও সায়েন্সল্যাব এলাকায় দিনভর সংঘর্ষে দুজন নিহত হয়েছেন। মঙ্গলবার দুপুরের পর ঢাকার বেশ কয়েকটি এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে আরও কয়েকশ মানুষ আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১২৯ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। 

এছাড়া ৮ জন ভর্তি রয়েছেন। এরা হলেন- রাজু, শুভ, ফেরদৌস, অনিক, বাবুল, রাজু (৩৫), পলাশ ও রুবেল। কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের মধ্যে এসব সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। 

রাজধানীর ঢাকা কলেজের সামনে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে দুই যুবক নিহত হন। তাদের একজনের নাম মো. শাহজাহান (২৫)। তিনি নিউমার্কেটের ফুটপাতে হকারি করতেন। রাত সাড়ে ১২টায় নিউমার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, নিহত যুবকের নাম সবুজ আলী (২৫)। মঙ্গলবার রাতে সিআইডি ফরেনসিক টিম ফিঙ্গার প্রিন্টের মাধ্যমে নিহতের পরিচয় নিশ্চিত করে। ওসি জানান, সবুজ আলীর বাড়ি নীলফামারীর সদর উপজেলার বাদশা আলীর ছেলে। তার মায়ের নাম সূর্য বানু। 

মঙ্গলবার প্রকাশ্যে লাঠি, রড ও পাইপ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মুখোমুখি অবস্থান নেয় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। দুই পক্ষই ক্যাম্পাসের দুই অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মঙ্গলবার দিনভর অবস্থান করে। ঢাকা মহানগর ও আশপাশের জেলা থেকে বিপুলসংখ্যক বহিরাগত নেতাকর্মী ক্যাম্পাসে জড়ো করে ছাত্রলীগ। দুই পক্ষই পৃথক পৃথক মিছিল ও সমাবেশ করে। উভয়পক্ষের মধ্যে তীব্র উত্তেজনাও ছিল। 

ক্যাম্পাস এলাকায় বড় ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। তবে চানখাঁরপুল এলাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষের সময়ে প্রতিপক্ষের গুলিতে অন্তত চারজন শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এছাড়া আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের হামলায় আহত হয়েছেন সহকারী প্রক্টর অধ্যাপক ড. আব্দুল মুহিতসহ পাঁচজন। সহকারী প্রক্টরকেও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সরেজমিন এসব চিত্র দেখা গেছে।

এর আগের দিন সোমবার কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালান ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। ওই দিন অনেক নারী শিক্ষার্থীদের বেধড়ক মারধর করা হয়। এর রেশ ধরে মঙ্গলবার ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণের মহড়া চালায় ছাত্রলীগ ও কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা। ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি), রাজু ভাস্কর্য, ভিসি চত্বর, শাহবাগ ও নীলক্ষেত পর্যন্ত এলাকায় অবস্থান নেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এসব এলাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকার দুই মহানগর ও আশপাশ জেলার ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা লাঠি, রড, জিআই পাইপ, বাঁশসহ দেশীয় অস্ত্রসহ অবস্থান নেন। 

মাথায় হেলমেট পরে এসব লাঠিসোঁটা নিয়ে মহড়াও দেন তারা। অপরদিকে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হল, অমর একুশে হল, চানখাঁরপুল মোড় ও পলাশী এলাকার নিয়ন্ত্রণে রাখে আন্দোলনকারীরা। তাদের হাতেও ছিল বাঁশ, গাছের ডাল, লাঠি ও ইটের টুকরো। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর মাথায় ছিল জাতীয় পতাকা ও কোটাবিরোধী স্লোগান সংবলিত কাপড়। এসব এলাকা দিয়ে আসার সময়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মী বহনকারী অন্তত চারটি বাস ভাঙচুর এবং দুটি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করেছেন আন্দোলনকারীরা। দিনভর ক্যাম্পাসে এমন পরিস্থিতি বিরাজ করলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তেমন তৎপরতা দেখা যায়নি। সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা কারও বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়নি। 

কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগের এমন মুখোমুখি অবস্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যান চলাচল এক প্রকার বন্ধ হয়ে যায়। 

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। চানখাঁরপুল এলাকায় পরিচয় নিশ্চিত হওয়া ছাড়া যাত্রী চলাচলে বাধা দেওয়া হয়। এদিকে আন্দোলনকারী দুই পক্ষকে সংযত আচরণ করার আহ্বান জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল। সন্ধ্যায় তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমাদের শিক্ষকেরা লাঠিসোঁটা হাতে যারা আন্দোলন করছেন তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। 

আন্দোলনকারী দুই পক্ষ যাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করে তা তদারকি করছিলেন। এ সময়ে কিছু বহিরাগত আন্দোলনকারী লাঠিসোঁটা নিয়ে সহকারী প্রক্টরসহ শিক্ষকদের ওপর হামলা চালায়। বহিরাগতরা যাতে ক্যাম্পাসে শান্তি বিনষ্ট না করতে পারে সে বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। 

সরেজমিন দেখা যায়, পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী মঙ্গলবার বিকালে রাজু ভাস্কর্যের সামনে সমাবেশ করে ছাত্রলীগ। সমাবেশে ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসাইন তার বক্তব্যে সোমবারের সংঘর্ষের সূত্রপাতের ঘটনা তুলে ধরেন। আন্দোলনকারীদের হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, আন্দোলন যাবে, আন্দোলন আসবে, ছাত্রলীগ থেকে যাবে। আমরা সবকিছু দেখছি, খোঁজ রাখছি এবং সবকিছু মনে রাখছি। সবকিছুরই জবাব দেওয়া হবে। কত ধানে কত চাল হয় তা ছাত্রলীগ দেখে নেবে বলেও জানান তিনি।

এর আগে এদিন সকাল থেকে রাজু ভাস্কর্য, টিএসসি ও আশপাশ এলাকায় অবস্থান নেয় দলটির নেতাকর্মীরা। ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাসে চড়ে ঢাবিতে আসেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বহন করা দুটি বাস (ঢাকা মেট্রো-ব ১৩-১৪৩৬ এবং ঢাকা মেট্রো-জ ১১-০৩১৫) ভিসি চত্বরে পার্কিং করা অবস্থায় কে বা কারা ভাঙচুর চালায়। 

তখন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা তাদের লাঠিসোঁটা নিয়ে ধাওয়া দেয়। সেখানে কর্মরত পুলিশও ধাওয়া দেয়। ওই সময়ে সেখানে একটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। এছাড়া ছাত্রলীগের নেতাকর্মী বহনকারী আরেকটি গাড়ি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে ভাঙচুর করা হয়। শহিদ মিনার থেকে পলাশী যাতায়াতের সড়কে কামরাঙ্গীর চর ছাত্রলীগের দুই নেতার মোটরসাইকেলে অংগ্নিসংযোগ করে আন্দোলনকারীরা। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলা থেকে আসা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী বহনকারী অন্তত তিনটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। 

হামলার শিকার রূপগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক খন্দকার তারেক আহসান যুগান্তরকে বলেন, ছাত্রলীগের সমাবেশে যোগ দিতে রূপগঞ্জ উপজেলা থেকে আটটি বাসে তিন শতাধিক নেতাকর্মী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছেন। এর মধ্যে তিনটি বাস শহিদ মিনারের সামনে দিয়ে আসার সময়ে গাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয়েছে। এতে আমাদের কয়েকজন আহত হয়েছেন। তিনি জানান, রূপগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে তারা সমাবেশে আসেন।

চানখাঁরপুলে দফায় দফায় সংঘর্ষ : পুরান ঢাকার চানখাঁরপুল এলাকায় স্থানীয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এতে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্তত চারজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল ও চানখাঁরপুল এলাকায় অবস্থান নেয় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা। অপরদিকে বিপরীত দিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ওমর বিন আবদাল আজিজের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীরা চানখাঁরপুল মোড়ে অবস্থা নেন। দুই পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় ইট ছোড়াছুড়ি ও ধাওয়া-পালটাধাওয়া হয়। 

সহকারী প্রক্টরের ওপর হামলা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর ড. মো. আবদুল মুহিতের ওপর চড়াও হয় আন্দোলনকারীরা। পরিস্থিতি অস্থিতিশীল দেখে তিনি দৌড় দিলে তাকে লক্ষ্য করে লাঠিসোঁটা দিয়ে আঘাত করতে থাকে বেশ কয়েকজন। একপর্যায়ে তিনি পড়ে গিয়ে আহত হন। উঠে দৌড় দিলে তাকে ধাওয়া দিয়ে হামলা চালায় আন্দোলনকারীরা। বিকাল সোয়া ৪টায় শহিদ মিনার এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। এ সময় সহকারী প্রক্টরকে রক্ষা করতে গিয়ে হাতে কিছুটা আঘাতপ্রাপ্ত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সদস্য মোতাহার হোসেন।

পরে প্রক্টরকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান আরেক সহকারী প্রক্টর মাইনুদ্দিন মোলা। সাংবাদিক মোতাহারকে নেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে বহিরাগতদের চলে যেতে দুপুরে মাইকিং করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরিয়াল বডি। তবে তাদের মাইকিংয়ে কর্ণপাত করেনি ছাত্রলীগের সমাবেশে আসা নেতাকর্মীরা। এ সময় প্রক্টরিয়াল টিম ছাত্রলীগের কয়েকজনের হাত থেকে ৫ থেকে ৬টি লাঠি, স্টাম্প ও রড নিয়ে যান। 

রাজধানীতে দুই বাসে আগুন : রাজধানীতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে দুটি বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার রাত ৮টা ২৫ মিনিটের দিকে এ ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নেভায়।

জানা গেছে, হাইকোর্ট থেকে পল্টনের দিকে যাওয়ার পথে সচিবালয় এলাকায় মেট্রোরেল স্টেশনের সামনে বাস দুটিতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় বাসের ভেতরে কাউকে দেখা যায়নি। আগুন লাগার কিছুক্ষণ পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। তবে এ ঘটনায় কাউকে আটক করতে পারেনি তারা। পথচারীরা জানান, কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে। এদিকে ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের ডিউটি অফিসার মো. শাহজাহান যুগান্তরকে জানান, রাত ৮টা ৪৫ মিনিটে আগুন নির্বাপণ করা হয়েছে। তবে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

জবির কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ ৪ শিক্ষার্থী : কোটা সংস্কারের দাবিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর গুলির ঘটনা ঘটেছে। এতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ জন ও সরকারি কবি নজরুল কলেজের ১ জন শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কয়েক হাজার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা লাঠিসোঁটা হাতে নিয়ে রায় সাহেব বাজার অতিক্রম করার সময় এ ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শী ও আন্দোলনকারীরা জানান, পুরান ঢাকার আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা এ গুলি বর্ষণ করেছে। 

গুলিবিদ্ধ হওয়া ৪ জন হলেন-জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭ ব্যাচের মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী অনিক, ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ১৬ ব্যাচের শিক্ষার্থী ফেরদৌস জামান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ১৬ ব্যাচের এইচএম নাসিম ও কবি নজরুল কলেজের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ২০২১-২২ সেশনের শিক্ষার্থী হাসিব। তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। 

এছাড়া ছুরিকাঘাতে আহত তায়াফ নামে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং বিভাগের এক শিক্ষার্থী আহত হয়ে ন্যাশনাল মেডিকেলে ভর্তি রয়েছেন। শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে বিকাল ৪টা ৪৫ মিনিটে তাঁতীবাজার মোড়ে অবস্থান নেয়। পরে ৫টা ২৫ এর দিকে তাঁতীবাজার মোড় ত্যাগ করে জবি ক্যাম্পাসের সামনে অবস্থান নেয় শিক্ষার্থীরা। পরে সন্ধ্যা ৭টায় শিক্ষার্থীরা কর্মসূচি শেষ করে চলে যায়।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (জবি) আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সভা করেছেন জবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টায় উপাচার্যের সভাকক্ষে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় উপাচার্য বলেন, আমাদের সেসব শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ ও আহত হয়েছে, তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। আমরা তোমাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। সহিংসতা দিয়ে আন্দোলন সফলতা অর্জন হয় না। সবার জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। তিনি আরও বলেন, আহত শিক্ষার্থীদের সব চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহ করবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। নারী হলের সব শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করব। যুগান্তর ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর- 

চট্টগ্রামে দুই শিক্ষার্থী ও এক পথচারীসহ নিহত ৩, আহত ৬০ : চট্টগ্রামে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের দফায় দফায় সংঘর্ষ, হামলা-পালটা হামলায় দুই শিক্ষার্থী এবং এক পথচারীসহ তিনজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ৬০ জন। এর মধ্যে রক্তাক্ত অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৪০ জন চিকিৎসাধীন আছেন। 

মঙ্গলবার দুপুর ১২টা থেকে সড়কে অবস্থান ও দখল-বেদখল নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা শুরু হয়। বেলা ৩টায় ধাওয়া-পালটাধাওয়া এবং পাঁচটার দিকে গুলি, ককটেল বিস্ফোরণ ইট-পাটকেল নিক্ষেপের মধ্যদিয়ে ষোলশহর রেল স্টেশন, দুই নম্বর গেট থেকে মুরাদপুর পর্যন্ত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এ সময় ওই সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও তারা কোনো পক্ষকেই থামাতে পারেনি। ঘটনার সময় মুরাদপুর এলাকায় অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে একাধিক যুবককে সড়কে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণ করতে দেখা গেছে।

সংঘর্ষে নিহতদের মধ্যে একজন চট্টগ্রাম কলেজে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক। তার নাম ওয়াসিম আকরাম (২২)। তার বাড়ি কক্সবাজারের পেকুয়ায়। নিহত অপর শিক্ষার্থীর নাম ফয়সাল আহমদ শান্ত (২০) তিনি এমইএস কলেজের অনার্স প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থী। তার বাড়ি বরিশালে। নিহত পথচারীর নাম মোহাম্মদ ফারুক। তিনি শুলকবহরে শাহজালাল ফার্নিচার নামে একটি দোকানের কর্মচারী। বহদ্দার হাট থেকে দোকানে যাওয়ার পথে হামলাকারীদের মুখে পড়েন। এর মধ্যে দুই শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। পথচারী ফারুককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের পাশাপাশি চট্টগ্রামে দুই প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় যুগান্তরকে বলেন, ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমরা চার প্লাটুন বিজিবি চেয়েছিলাম। দুই প্লাটুন বিজিবি মোতায়েনের বিষয়ে কনফার্ম করা হয়েছে। আন্দোলনকারীরা ঘটনাস্থল ছেড়ে চলে গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। সংঘর্ষে তিনজন নিহত ও অন্তত ৬০ জন আহত হয়েছেন।’

চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সংঘর্ষে আহত অন্তত ৬০ জন চমেক হাসপাতালে এসেছে। এর মধ্যে গুলিবিদ্ধ, ছুরিকাহত হয়ে আহতের সংখ্যা বেশি। আহতদের মধ্যে কারও কারও অবস্থা আশঙ্কাজনক। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি (পিআর) তারেক আজিজ যুগন্তরকে বলেছেন, ‘সংঘর্ষে তিনজন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে দুজন ছাত্র ও একজন পথচারী। তাদের মরদেহ উদ্ধার করে চমেক হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করা হয়েছে।’

চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তসলিম উদ্দীন যুগান্তরকে বলেন, ‘সংঘর্ষে গুরুতর আহত অবস্থায় আনা তিনজনকে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেছেন। এর মধ্যে দুজন গুলিবিদ্ধ এবং একজন ফিজিক্যাল অ্যাসল্ট হয়ে মারা গেছেন। আহত ৩০-৪০ জনের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। তাদের হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটি ও নিউরো মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন। এর মধ্যে দুইজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।’ 

সরেজমিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে নগরের ষোলশহর রেল স্টেশন এলাকায় লাঠিসোঁটা ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। অন্যদিকে পূর্বঘোষণা অনুযায়ী আন্দোলনকারীরা ষোলশহর স্টেশনে এসে জড়ো হলে ছাত্রলীগ কর্মীরা তাদের লাঠিসোঁটা নিয়ে ধাওয়া করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ধাওয়া খেয়ে আবারও সংগঠিত হয় আন্দোলনকারীরা। 

বেলা ৩টার দিকে তারা মুরাদপুরে জড়ো হয় তারা। এ সময় ষোলশহর রেল স্টেশনে থাকা ছাত্রলীগ কর্মীরা মুরাদপুর এসে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালানোর চেষ্টা করলে আন্দোলনকারীরা পালটা হামলা করে। তারা বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ওপর। আন্দোলনকারীদের ধাওয়া খেয়ে ছাত্রলীগ পিছু হটে। তারা নগরীর বহদ্দারহাট ও দুই নম্বর গেটের দিকে চলে যায়। 

এরপর মুরাদপুর মোড় দখলে নিয়ে কোটাবিরোধী স্লোগানে পুরো এলাকা প্রকম্পিত করে তারা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম কলেজ, মহসিন কলেজ, এমইএস ওমরগনি কলেজ, চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ চট্টগ্রামের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হাজার-হাজার শিক্ষার্থী এতে অংশ নেয়। ছাত্রদল এই আন্দোলনে নৈতিক সমর্থন ঘোষণা দেওয়ার পর মঙ্গলবার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রদলের অনেক নেতাকর্মী এবং ছাত্রদল সমর্থিত শিক্ষার্থীদেরও অংশ নিতে দেখা গেছে।

আন্দোলনকারী চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থী মো. ইরফান বলেন, ‘আমরা সকালে ষোলশহরে জড়ো হতে চাইলেও ছাত্রলীগ আমাদেরকে ধাওয়া দেয়। পরে আমরা মুরাদপুর মোড়ে অবস্থান নিই। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করলেও ছাত্রলীগ অস্ত্র ও চাপাতি নিয়ে আমাদের ওপর হামলা করে। একাধিক অস্ত্রধারী আন্দোলনকারীদের লক্ষ করে গুলিবর্ষণ করে। মুরাদপুর এলাকায় আন্দোলকারী কয়েকজনকে ঘিরে ধরে হেলমেট পরিহিত ছাত্রলীগ কর্মীরা লাঠিসোঁটা দিয়ে আঘাতের পাশপাশি চাপাতি দিয়ে কোপাতে থাকে। কাউকে আবার ছুরিকাঘাতও করে।’ 

তবে তার অভিযোগ, এ সময় হামলায় রক্তাক্ত হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়া আন্দোলনকারীদের অনেকে তাদের বাঁচানোর তীব্র আকুতি জানালেও ছাত্রলীগ কর্মীরা ক্ষান্ত হয়নি। এমনকি তাদের উদ্ধারে পুলিশকেও এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। হামলায় ঘটনাস্থলেই একজনের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। রেডক্রিসেন্টের কর্মীরা এসে গাড়িতে হতাহত অনেককে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সহকর্মীরাও রক্তাক্ত আন্দোলনকারীদের রিকশা ও ভ্যানগাড়িতে হাসপাতালে নিয়ে যেতে দেখা গেছে। আন্দোলনকারীদের ছোড়া ইট-পাটকেল নিক্ষেপ ও হামলায় ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মীও আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। এর মধ্যে এক ছাত্রলীগ কর্মীর চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

রংপুরে পুলিশের গুলিবর্ষণে নিহত ১, আহত অর্ধশতাধিক : কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের ত্রিমুখী সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদ নামে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন সাংবাদিক ও শিক্ষার্থীসহ অর্ধশতাধিক। নিহত শিক্ষার্থীর লাশ হাসপাতাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিয়ে আসার পথে পুলিশ ছিনিয়ে নেয়। এর প্রতিবাদে সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুলিশের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। পুলিশের হামলায় একজন শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনার প্রতিবাদে বেরোবির ছাত্রলীগ নেতা পিয়াস আহমেদ পদত্যাগ করেছেন। 

এর পরপরই নগরীতে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ নগরীর কারমাইকেল কলেজ, রংপুর পলিটেকনিক্যাল ইনিস্টিটিউট, রংপুর সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আন্দোলকারীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, কারমাইকেল কলেজের সামনে লালবাগ, খামার মোড়, চকবাজার, পার্শ্ববর্তী রংপুর ঢাকা মাহসড়ক ও নগরীর পুলিশ কমিশনারের অফিসের সামনে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিয়েছে। এ সময় সন্ধ্যায় কাম্পাসে ভিসির প্রটোকলে থাকা পুলিশের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে আন্দোলনকারীরা। 

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রংপুরে পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি চার প্লাটুন মোতায়েন করা হয়েছে। পরিস্থিতি যে কোনো মুহূর্তে আরও সংঘাতপূর্ণ হয়ে ওঠার আশঙ্কা করা হচ্ছে। নিহত শিক্ষার্থীর মরদেহ রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (রমেক) মর্গে রাখা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা যাতে ওই মরদেহ নিতে না পারে সেজন্য রমেক হাসপাতালের তিনটি গেটে ব্যাপক সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। 

নিহত সহপাঠীর লাশ রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে স্ট্রেচারে করে মিছিল নিয়ে আসার পথে পুলিশ লাইনস এর সামনে তাদের গতিরোধ করে। এ সময় পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে পুলিশের গাড়ির সামনে শুইয়ে পড়ে প্রতিরোধ গড়ে তুললে পুলিশ লাশ ছিনিয়ে নিয়ে গাড়িতে করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হিমঘরে নিয়ে যায় এবং সেখানে রাখে। 

নিহত শিক্ষার্থী আবু সাঈদ বেরোবির ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। তার বাবার নাম মকবুল হোসেন। তার গ্রামের বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার জাফরপাড়া বাবনপুরে বলে জানা গেছে। তিনি এই আন্দোলনে বেরোবি শাখার সমন্বয়ক ছিলেন।

প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্যমতে ও সরেজমিন দেখা গেছে, মঙ্গলবার দুপুরে বেরোবির কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে শহরের লালবাগ এলাকা থেকে ক্যাম্পাসের দিকে যায়। এরপর ক্যাম্পাসে প্রবেশের চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাধে। ঘটনার সময় ওই শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের বিপরীতে পুলিশের সামনে বুক পেতে পুলিশের গুলির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। 
তখন পুলিশের একটি দল বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে থেকে ওই শিক্ষার্থীকে লক্ষ্য করে সরাসরি গুলি ছোড়ে। পরপর কয়েকটি গুলি ছুড়লে সে ঘটনাস্থলে লুটিয়ে পড়লে তার সহাপাঠীরা তাকে রিকশা করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক আশিক আরিফিন তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ওই চিকিৎসক জানিয়েছেন তার বুকের একাধিক বুলেট ইনজুরি রয়েছে। 

ময়নাতদন্ত রিপোর্টে জানা যাবে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ। ঘটনা সময় দেখা গেছে পুলিশের একটি অতি উৎসাহী দল বিনা উসকানিতে ছাত্রদের ওপর বেপরোয়া হয়ে ওঠে। প্রায় শতাধিক রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর। আহতদের ২৪ জনের নাম পাওয়া গেছে। এছাড়া আহত হয়েছেন রংপুর সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজের শিক্ষার্থী মেফতাহুল জান্নাত (১৯)। তার চোখের নিচে রাবার বুলেটের ছররা লেগেছে। 

খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে আহত হয়েছেন সময় টিভির সাংবাদিক আব্দুর রশিদ জীবন, এশিয়ান টিভির সাংবাদিক বাদশা ওসমানি, দৈনিক পরিবেশের সাংবাদিক শাকিল হোসেন, যুগান্তরের উদয় চন্দ্র বর্মণ, বাংলাভিশন টিভির ক্যামেরা পারসন শাহ নেওয়াজ জনি। এদের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে যারা আহত হয়েছেন তাদের বেশিরভাগই বুলেট, টিয়ারশেল ও ইট ও লাঠির আঘাতে আহত হয়েছেন। 

অন্যদিকে কোটা বাতিল আন্দোলনের নামে জাতীয় পতাকার অবমাননা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বিকৃত করে মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে সাংবাদিক সম্মেলেন করেছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড। মঙ্গলবার বেলা ১১টায় রংপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন থেকে কোটা আন্দোলনের নামে অরাজকতা, নৈরাজ্য সৃষ্টি ও প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তি করার প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা। 

এদিকে, রংপুরের কারমাইকেল কলেজ ক্যাম্পাসের ক্যান্টিনে হামলার ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার দুপুরে এ ঘটনা ঘটিয়েছে একদল বহিরাগত। এতে কেউ আহত না হলেও ক্যান্টিনের আসবাবপত্র ভাঙচুর হয়েছে। এ ঘটনায় ক্যাম্পাসে উত্তেজনা বিরাজ করছে।

ছাত্রলীগ নেতার পদত্যাগ : কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ-ছাত্রলীগের হামলা ও শিক্ষার্থীদের অবমাননা করার প্রতিবাদে রংপুরের রাজপথ উত্তাল হয়ে উঠেছে। এ ঘটনায় ক্ষোভে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পিয়াস আহমেদ নামের এক ছাত্রলীগ নেতা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন।

তালা ভেঙে কুবিতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ, গুলিতে আহত ১ : কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আটকাতে ছাত্রলীগের দেওয়া তালা ভেঙে মঙ্গলবার বিক্ষোভ মিছিল করেছেন শিক্ষার্থীরা। পরে মহাসড়কে অবস্থান করছিলেন তারা। মিছিল চলাকালে পুলিশ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দিকে গুলি করলে এক শিক্ষার্থীর বুকে তিনটি রাবার বুলেট লাগে। পরে শিক্ষার্থীরা উত্তেজিত হয়ে পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর করেন। এসময় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ, কুমিল্লা সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী যোগ দেন।

পুলিশের গুলিতে জাবি অধ্যাপক আহত : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারী-পুলিশ-ছাত্রলীগ ত্রিমুখী সংঘর্ষে দুই অধ্যাপকসহ শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। সোমবার রাত পৌনে তিনটায় আন্দোলনকারীদের দমাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের ভেতরে পুলিশ গুলি চালালে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. খো. লুৎফুল ই এলাহী মারাত্মকভাবে আহত হন। সন্ধ্যায় আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষ থামাতে গেলে রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আওলাদ হোসেন আহত হন। 

এছাড়া রাতভর সংঘর্ষে পুলিশসহ উভয় পক্ষের অন্তত শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তিন প্লাটুন পুলিশ কাজ করছে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. নুরুল আলমের বাসভবনে আশ্রয় নিলে তাদের ওপর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। প্রথমে পুলিশ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হল থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা এসে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগ দিলে পুলিশও সংঘর্ষে জড়ায়। 

এদিকে সোমবার রাত নয়টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. নুরুল আলমের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। রাত সোয়া ১০টায় শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন। এর আগে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। 

মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের সামনে এলে অতর্কিত হামলা করে ছাত্রলীগ। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক এবং নারী শিক্ষার্থীসহ অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। হামলার প্রতিবাদে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ মিনারের পাদদেশে জড়ো হতে থাকেন। এরপর একটি মিছিল নিয়ে উপাচার্যের বাসভবন ঘেরাও করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনরত শিক্ষার্থী হাসিব জামান বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিল করছিলাম। 

মিছিলে ছাত্রলীগ আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা করে। ছাত্রলীগের এই হামলায় আমাদের একজন শিক্ষক পর্যন্ত আহত হন। এদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনায় ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে জরুরি সিন্ডিকেট সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এদিকে ১৫ জুলাই রাতে সংঘটিত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় আহত শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা এবং সব চিকিৎসা ব্যয় বহন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

কক্সবাজারে ছাত্রলীগের বাধা, ধাওয়া-পালটা ধাওয়া, ভাঙচুর : মঙ্গলবার সকাল এগারোটার দিকে কক্সবাজার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রাম কক্সবাজার সড়কের লিংকরোড এলাকায় অবস্থান করে। দুপুর বারোটার দিকে তারা মিছিল নিয়ে কক্সবাজার সরকারি কলেজের দিকে অগ্রসর হয়। এ সময় কলেজে আগে থেকে অবস্থান করা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের বহিরাগত দাবি করে ধাওয়া করে। 
১০-১৫ মিনিট পর আন্দোলনকারীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে কক্সবাজার কলেজের ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগকে ধাওয়া দিলে ধাওয়া-পালটা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। উভয় পক্ষের মধ্যে ইট-পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এ সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে আন্দোলনকারীরা।

ফেনীতে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা : ফেনীতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার দুপুরে ফেনী শহরের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে এ ঘটনা ঘটে। তাৎক্ষণিক পুলিশ দুই পক্ষকে নিবৃত্ত করলে হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি।

বগুড়ায় ককটেল হামলা, চার শিক্ষার্থী আহত : বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর ককটেল হামলা হয়েছে। এতে কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের চার শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়েছেন। তাদের বগুড়া শহিদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। 

বগুড়া সদর থানার সেকেন্ড অফিসার এসআই রহিম উদ্দিন এ তথ্য দিয়েছেন। আহত শিক্ষার্থীরা হলেন-বগুড়ার ধুনট উপজেলার বথুয়াবাড়ির বাদশার ছেলে কলেজের অর্থনীতি তৃতীয় বর্ষের ছাত্র সুমন রানা (২৩), একই উপজেলার বেলকুচি গ্রামের গোলাম রব্বানীর ছেলে কলেজের ফিন্যান্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মামুন (২২), আনারপুর গ্রামের বেলালের ছেলে ফিন্যান্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র তাফসির (২০) ও চালাপাড়া গ্রামের মোহাম্মদ আলীর ছেলে অর্থনীতি তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মিলন (২০)।

রাঙামাটিতে বিক্ষোভে ছাত্রলীগের বাধা : মঙ্গলবার দুপুরে রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ এবং কাপ্তাইয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ সুইডেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট (বিএসপিআই) ক্যাম্পাসে পৃথক বিক্ষোভ মিছিল বের করেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুটির সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ সময় পুলিশ ও ছাত্রলীগ বাধা দিলে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পালটাপালটি ধাওয়ায় রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে উত্তেজনা তৈরি হয়। এতে ছাত্রলীগের হামলায় দীপ্ত দে নামে মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের এক ছাত্র আহত হন। অন্যদিকে সকাল ১০টার দিকে রাঙামাটির কাপ্তাইয়ের বিএসপিআই ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল প্রদর্শন করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ সময় ছাত্রলীগের ধাওয়ায় বিক্ষোভকারী সাধারণ শিক্ষার্থীদের ৪ জন আহত হন।

কিশোরগঞ্জে ধাওয়া-পালটা ধাওয়া, সংঘর্ষ : কিশোরগঞ্জে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের ধাওয়া-পালটা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় দুই পক্ষের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। মঙ্গলববার বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে গুরুদয়াল সরকারি কলেজের সামনের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। 

ফরিদপুরে ছাত্রলীগের হামলা, আহত ৫ : ফরিদপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এতে অন্তত পাঁচজন আন্দোলনকারী আহত হয়েছেন। মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে ফরিদপুর শহরের ব্রাহ্মসমাজ সড়কের সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে আন্দোলনকারীদের ওপর এ হামলার ঘটনা ঘটে। এদিকে জেলা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, কোটা আন্দোলনকারীদের হাতে শহর ছাত্রলীগের নেতা শাহিন আহম্মেদ আহত হয়েছেন।
 
গুরুতর আহতরা হলেন গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রিক বিভাগের সাবেক ছাত্র ও শহরের ঝিলটুলী এলাকার বিল্লাল কাজীর ছেলে কাজী নিশাত আহমেদ (২৫) ও সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের মাস্টার্সে অধ্যয়নরত আবরার নাদিম ইতু (২৬)। আহতদের ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। 

রাবিতে হলে ভাঙচুর, বাইকে আগুন, ৪ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন : সারা দেশে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ ও পুলিশের হামলার প্রতিবাদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলে ছাত্রলীগের অবস্থান জানতে পেরে আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে সেখানে যান। 
মঙ্গলবার বিকাল পৌনে তিনটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনোদপুর গেট থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক হয়ে প্রধান ফটকের ভেতর দিয়ে প্যারিস রোডে যায়। সেখান থেকে মিছিলটি বিভিন্ন আবাসিক হলের সামনে দিয়ে প্রদক্ষিণ করে। এর মধ্যে আন্দোলনকারীরা আবাসিক হলে তালা দেওয়ার কথা শুনে একপর্যায়ে তারা বঙ্গবন্ধু হলের গেট ও জানালা ভাঙচুর করেন। পরে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সম্পাদকের রুমসহ অন্তত দশটি কক্ষ ভাঙচুর করে আন্দোলনকারীরা। এছাড়া কয়েকটি বাইকে আগুন লাগিয়ে দেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। 

আন্দোলনকারীদের ভাঙচুরের পর সরেজমিন দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবুর ২৩০ নাম্বার কক্ষে পিস্তল, পাসপোর্ট, একাধিক খালি মদের বোতল পাওয়া গেছে। এছাড়া সম্পাদক আসাদুল্লাহ হিল গালিবের ২২৮ নাম্বার কক্ষে ১৫ থেকে ২০টা ফেনসিডিলের খালি বোতল, দেশীয় অস্ত্র হাঁসুয়া, জিআই পাইপ পাওয়া যায়। হলের তৃতীয়তলায় শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আলফাত সায়েম জেমসের ৩৩১ নাম্বার কক্ষে তিনটি রামদা, একটি রড পাওয়া যায়।

এর আগে বিকাল ৩টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাদার বখস হলের সামনে থেকে আন্দোলনরত বিক্ষোভকারীদের ধাওয়া খেয়ে মোটরসাইকেলে করে ক্যাম্পাস থেকে পালিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লা-হিল-গালিব। বিক্ষোভ চলাকালে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবুকে ক্যাম্পাসে কোথাও দেখা যায়নি। রাজশাহী-১ বিজিবি অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মতিউল ইসলাম মন্ডল জানান, কোটা আন্দোলনে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় চার প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। প্রয়োজনে আরও বাড়ানো হবে। 

বগুড়ায় ছাত্রলীগের ককটেল হামলা, সাতমাথা রণক্ষেত্র : বগুড়ায় কোটাবিরোধী জেলা স্কুলের শিক্ষার্থীদের ওপর ‘ছাত্রলীগ’-এর ককটেল হামলার প্রতিবাদে শহরের সাতমাথা রণক্ষেত্র পরিণত হয়। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের সংঘবদ্ধ মোকাবিলায় হামলাকারীরা পালিয়ে যান। পরে কোটাবিরোধীরা টেম্পল রোডে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয় ভাঙচুরের পর দাহ্য পদার্থ ঢেলে অগ্নিসংযোগ করে। তার পাশেই মুজিব মঞ্চ ভাঙচুর ও পাশে পুলিশ বক্স, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের অস্থায়ী কার্যালয় ভাঙচুরের পর আগুন ধরিয়ে দেয়। তারা পোস্ট অফিস, জাসদ অফিস, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভাঙচুর করে। সেখানে ৪-৫টি মোটরসাইকেল আগুনে পুড়ে যায়। সেখানে জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সুলতান মাহমুদ খান রনির ব্যক্তিগত দুটি কার্যালয়ে ভাঙচুরের পর লুটপাট করা হয়।

আন্দোলনকারীদের ইটপাটকেল ও লাঠিপেটায় যমুনা টেলিভিশনের ব্যুরো প্রধান মেহেরুল সুজন, দৈনিক করতোয়ার স্টাফ ফাটোগ্রাফার শফিকুল ইসলামসহ ৪-৫ জন সাংবাদিক আহত হন। তাদের তাড়া খেয়ে সাংবাদিক ও পুলিশ নিরাপদ দূরত্বে সরে যান। প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করেন, শিবির ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা আসার পর সাধারণ শিক্ষার্থীরা মারমুখী হয়ে ওঠেন ও তারা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ শুরু করেন। সেখানে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন থাকলেও তারা হামলাকারীদের প্রতিহত করেনি। এতে জনগণের মাঝে নানা আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়।

বরিশালে ছাত্রলীগের হামলায় ২৫ শিক্ষার্থী আহত : বরিশাল ব্যুরো জানায়, বরিশালে ব্যাপক বিক্ষোভ করেছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এ সময় একটি পুলিশ বক্স ভাঙচুর, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের গাড়ি ধাওয়া ও লাগাতার সড়ক অবরোধ করে তারা। আন্দোলনে ছাত্রলীগের হামলায় বিএম কলেজের ২৫ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এ সময় ছাত্রদের প্রতিরোধর মুখে পড়ে ১০-১২ জন ছাত্রলীগ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। বিক্ষোভকালে বিএম কলেজ শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ ৫-৬ রাউন্ড টিয়ার শেল নিক্ষেপ করেছে বলে জানিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। 

হাবিপ্রবিতে সংঘর্ষে আহত ৩০ : দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) সামনে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। দুপক্ষের পালটাপালটি আক্রমণে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মুখ সড়ক। এতে দুপক্ষের অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন। এ সময় তারা দিনাজপুর-রংপুর মহাসড়ক অবরোধ করলে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। 

সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক অবরোধ : সিলেট ব্যুরো জানায়, সিলেটে ছাত্রলীগ ও কোটাবিরোধীদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিলেও বড় ধরনের কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তবে দু’পক্ষই ছিল সক্রিয়। এর মধ্যে নগরীর রাজপথ দখলে ছিল ছাত্রলীগের আর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছিল কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীদের দখলে। সন্ধ্যা অবধি সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক অবরোধ করে রাখেন শিক্ষার্থীরা। 

সিরাজগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে আহত ২০ : সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সিরাজগঞ্জে কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে পাঁচজন পুলিশ সদস্য রয়েছেন। মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে সিরাজগঞ্জ শহরের গোশালা রেলগেট এলাকায় সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়।

ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়ক অবরোধ : স্টাফ রিপোর্টার টাঙ্গাইল জানান, ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থী। মঙ্গলবার আন্দোলনকারীরা মহাসড়কের আশেকপুর বাইপাস এলাকা অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করেন। এর আগে তারা দুপুর ১টার দিকে পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে এ সড়কে অবরোধ শুরু করেন। 

ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ বিক্ষোভ : স্টাফ রিপোর্টার ঢাকা উত্তর জানান, অবরোধের ফলে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের উভয় পাশে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। গণবিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মহাসড়ক অবরোধ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অভিমুখে পদযাত্রা শুরু করে। বিকাল পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের অবরোধ কর্মসূচি চলে। 

ময়মনসিংহে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ : ময়মনসিংহ ব্যুরো জানায়, বিক্ষোভ মিছিল ও সড়ক অবরোধ করেছেন নগরীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার দুপুর ১২টা থেকে আনন্দমোহন সরকারি কলেজ, নাসিরাবাদ কলেজ, নটর ডেম কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা নগরীর টাউন হল মোড়ে জড়ো হতে শুরু করে। পরে সেখান থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়ে নগরীর প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে পাটগুদাম ব্রিজ মোড়ে সড়ক অবরোধ করে অবস্থান নেন। এদিকে, বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বিভিন্ন সংগঠন। নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে শো-ডাউন করেছে জেলা ছাত্রলীগ। 

খুলনায় শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ : খুলনা ব্যুরো জানায়, খুলনায় শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করেছেন। এদিকে, বিএল কলেজের অনার্স তৃতীয়বর্ষের শিক্ষার্থী সাজেদুল ইসলাম বাপ্পী নামে এক শিক্ষার্থীকে সাদা পোশাকধারী ব্যক্তিরা তুলে নিয়ে গেছে বলে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছে। তবে পুলিশ এ ঘটনাকে গুজব বলে দাবি করেছে। 

নরসিংদীতে ককটেল বিস্ফোরণ : নরসিংদী প্রতিনিধি জানান, নরসিংদীতে কোটা আন্দোলনকারীরা ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করেছেন। এ সময় তারা মহাসড়কে অগ্নিসংযোগ ও ব্যারিকেড দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেন। এতে ঢাকার সঙ্গে সিলেটের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের জেলখানার মোড়ে জড়ো হতে চাইলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেন। এ সময় ছাত্রলীগ ও কোটা আন্দোলনকারীদের মধ্যে ধাওয়া-পালটাধাওয়া হয়। এ সময় বেশ কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। 

ঠাকুরগাঁওয়ে সড়ক অবরোধ, সংঘর্ষ আহত ৫০ : ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি জানান, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে একদল যুবকের হামলার জেরে উত্তেজনা দেখা দেয়। এসময় আগুন জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করেছেন আন্দোলনকারীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ছুড়ে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে পুলিশ। দফায় দফায় ধাওয়া-পালটাধাওয়া সংঘর্ষে পুলিশ, শিক্ষার্থী ও সাংবাদিকসহ কমপক্ষে ৫০ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে ১৩ জনকে সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। 

চাঁদপুরে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ : চাঁদপুর প্রতিনিধি জানান, চাঁদপুরে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা। মঙ্গলবার বিকালে শহরের হাসান আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ থেকে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। এক পর্যায়ে মিছিলটি শহরের বাসস্ট্যান্ড এলাকায় গেলে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা বাধা দেয়। এরপর শুরু হয় ধাওয়া-পালটাধাওয়া।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat