সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘রাজাকার’ বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবিতে গতকাল সোমবার পূর্বঘোষিত কর্মসূচি পালন করেছেন দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এ সময় বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এই আন্দোলনে যোগ দেন।
একই দিন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে ভুলভাবে উপস্থাপন করাসহ মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করার প্রতিবাদে ভিন্ন কর্মসূচিতে নামেন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। পৃথক কর্মসূচি নিয়ে উভয় পক্ষ মুখোমুখি হলে এক পর্যায়ে তা সংঘর্ষে রূপ নেয়।
এরপর দিনব্যাপী দফায় দফায় এই সংঘর্ষ চলতে থাকে।
এ সময় সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সন্ধ্যার পর সেখানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে সতর্ক অবস্থান নিতে দেখা যায়।
সরকার বলছে, কোটার বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন।
এ বিষয়ে সরকারের হস্তক্ষেপ করার কোনো সুযোগ নেই। শিক্ষার্থীদের আদালতে গিয়ে নিজেদের দাবি উপস্থাপনের সুযোগ রয়েছে।
এদিকে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। এই কর্মসূচি অনুযায়ী, আজ মঙ্গলবার সারা দেশে বিকেল ৩টায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ হবে।
গতকাল রাত সাড়ে ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল গেট প্রাঙ্গণে এক সংবাদ সম্মেলনে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
এদিকে নেতাকর্মীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে আজ দুপুর দেড়টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দিয়েছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। গতকাল সোমবার রাতে রাজু ভাস্কর্যের সামনে ব্রিফিংয়ে এই কর্মসূচির ঘোষণা দেন সংগঠনটির সভাপতি সাদ্দাম হোসেন।
ছাত্রলীগ সভাপতি জানান, কোটা সংস্কারের দাবিতে গতকাল আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় সংগঠনটির ৫০০ জনের বেশি আহত হয়েছেন। বিভিন্ন হলের ১০০টির বেশি রুম ভাঙচুর করা হয়েছে।
যারা কোটা আন্দোলনকে ইস্যু করে নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করছে, তাদের প্রতিহত না করা পর্যন্ত ছাত্রলীগ মাঠ ছাড়বে না।
ঢাকাসহ সারা দেশের প্রতিটি ক্যাম্পাসে একই সময়ে ছাত্রলীগের প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে বলেও জানান সাদ্দাম হোসেন। ব্রিফিংয়ের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সেখানে জড়ো হন।
বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন
পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী গতকাল দুপুর ১২টা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্যে জড়ো হতে থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবিতে ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’সহ বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে তাঁরা বিক্ষোভ করেন। কোটা সংস্কারের আন্দোলনে নামেন বুয়েট শিক্ষার্থীরাও।
রাজশাহীতে দুপুর সাড়ে ১২টায় প্যারিস রোডে বিক্ষোভ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ সময় রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) শিক্ষার্থীরা তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন।
চট্টগ্রামে বিকেল ৩টা থেকে বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু হওয়ার কথা থাকলেও দুপুর ২টা থেকে শহরে অবস্থান করা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, অন্তর্ভুক্ত সাত কলেজ ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা নগরের ষোলশহর স্টেশনে জড়ো হতে থাকেন। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) শিক্ষার্থীরা দুপুর ১২টায় পালবাড়ী থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও যোগ দেন
কোটাবিরোধী আন্দোলনে একাত্মতা জানিয়ে গতকাল রাস্তায় নেমেছেন বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দুপুর থেকে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা রাজধানীর নতুনবাজার এলাকায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন তাঁরা। বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি ও গ্রিন ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনে তাঁরা প্রায় পাঁচ ঘণ্টা সড়ক অবরোধের পাশাপাশি বিভিন্ন স্লোগান ও প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন।
ঢামেকে ভর্তি ২৯৭ জন শিক্ষার্থী
বিকেল ৩টার পর থেকে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থীর আহত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, বিকেল ৪টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ২৯৭ জন শিক্ষার্থী আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগের মধ্যে বিকেল ৩টার পর থেকে কয়েক দফায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। বিকেলে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে রাজু ভাস্কর্য থেকে উপাচার্য ভবন পর্যন্ত সড়ক দখল করে নেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
সংঘর্ষে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট ইডেন কলেজ শাখার সভাপতি শাহিনুর সুমি, সায়েমা, তামান্না, ফাহমিদা, সানজিদা, মিমসহ অন্তত সাতজন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে সুমিসহ চারজনকে গুরুতর অবস্থায় ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, কর্মসূচি পালনে দুপুরে রাজু ভাস্কর্যে আসার সময় সংশ্লিষ্ট কলেজ ছাত্রলীগের হামলায় এ ঘটনা ঘটে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। অন্যদিকে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিলে হামলাসহ সরকারি এমএম কলেজ থেকে আসা মাসুম নামের এক সংগঠককে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ জানিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
দুই পক্ষের সংঘর্ষে বাঁশ, রড, এসএস পাইপ, হকিস্টিক ও হেলমেট ব্যবহার করতে দেখা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেমে থেমে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটে।
হামলা নিয়ে দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ
গতকালের সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নয়—এমন বহিরাগতদের হস্তক্ষেপের অভিযোগ আসে দুই পক্ষ থেকে। আন্দোলনকারীরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের পাশাপাশি ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ ছাত্রলীগের কর্মীরা এই হামলায় অংশ নেন।
ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের ভাষ্য, হলে ঢুকে ছাত্রলীগের ওপর হামলা চালিয়েছেন শিবির-ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। ছাত্রলীগের অন্তত ২৫ জন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন।
ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন বলেন, ‘তারা সূর্য সেন হলে হামলা করেছে, বিজয় একাত্তর হলে আক্রমণ করেছে, বঙ্গবন্ধু হলে হামলা করেছে, তারা তো মেয়ে না, তারা শিবির-ছাত্রদলের ক্যাডার। আন্দোলনকারী শিবির-ছাত্রদলের সঙ্গে আদর্শিক লড়াইয়ের অংশ হিসেবে আমরা দাঁড়িয়েছি।’
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বলেন, ছাত্রলীগের কর্মীরা কারো ওপর হামলার জন্য রাস্তায় নামেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষার স্বার্থে রাস্তায় নেমেছে।
দিনব্যাপী দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষের এমন খবর পাওয়া যায়। তবে সন্ধ্যার পর সংঘর্ষের মূল কেন্দ্রস্থল হয়ে দাঁড়ায় ঢাবির ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল। হলে ভাঙচুর, ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও দুই পক্ষের মুখোমুখি অবস্থান তৈরি হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সাঁজোয়া যানসহ পুলিশের একটি বিশাল বহর সেখানে অবস্থান নেয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর উপস্থিতিতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসে ঢাবি প্রশাসন।
এদিন রাত ৮টার পর ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামালের সভাপতিত্বে প্রভোস্ট কমিটির জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তিপূর্ণ শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখার জন্য পাঁচটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো—১. শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ হলে শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করবে; ২. প্রাধ্যক্ষ ও আবাসিক শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিধানে সার্বক্ষণিকভাবে হলে অবস্থান করবেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন; ৩. হলসমূহে কোনো বহিরাগত অবস্থান করতে পারবে না; ৪. যেকোনো ধরনের গুজব ও অপপ্রচার থেকে বিরত থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে আহ্বান জানানো হচ্ছে; ৫. সবাইকে নাশকতামূলক কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য বলা যাচ্ছে। কেউ নাশতকতামূলক কাজে জড়িত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আন্দোলনকারীদের ভাষ্য, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলের ছাত্রলীগের শিক্ষার্থীরা বহিরাগতদের নিয়ে রাত ৩টার দিকে বৈঠক করে। এরপর রোকেয়া হলের সামনে গিয়ে হলের শিক্ষার্থীদের নানা বিরূপ মন্তব্য করতে থাকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভোররাত থেকে রোকেয়া হলের শিক্ষার্থীসহ দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ শুরু হয়।
শহীদুল্লাহ হলের ছাত্রলীগের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম জাহিদ বলেন, ‘কিছুদিন থেকে আমি কোটা সংস্কারের বিরুদ্ধে ফেসবুকে লিখছি। এতে অনেকে আমাকে হুমকি দিয়ে মেসেজ দেন। সোমবার দুপুরের পর হলের একজন কর্মচারী আমাকে জানান, আমার অনুপস্থিতিতে আমার হল ৩০২ নম্বর রুমে কিছু অছাত্র প্রবেশ করেছে। এ সময় তারা আমার আসবাব ভাঙচুর করে এবং সার্টিফিকেট নষ্ট করে। এই ছবি তুলতে গেলে শিক্ষার্থীদের বাধা দেওয়া হয়।’
এ জাতীয় আরো খবর..