নবম শ্রেণি পাস। অথচ তিনি এখন স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানির (এসএওসিএল) জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। আরেক ব্যক্তি চাকরি পেয়েছেন কোম্পানির মহাব্যবস্থাপকের (জিএম) খালাতো ভাই পরিচয়ে। বয়স নেই, তাতে কী? আত্মীয় তো আছে। আত্মীয়করণে ঢুকে গেছেন কোম্পানির বড় পদে। শুধু তাই নয়, মন্ত্রণালয়ের তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ২০০৪ সালে চাকুরি হারানো ব্যক্তিকে জামাই আদরে ডেকে এনে আবারও চাকুরি দেয়া হয়েছে। অসম্ভব মনে হলেও তা-ই ঘটেছে রাষ্ট্রীয় অংশীদারি এই প্রতিষ্ঠানে।
এসএওসিএলের এমন ১৪ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিয়োগে অনিয়ম নিয়ে বাণিজ্যিক অডিটে অভিযোগ ওঠার দুই বছরেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিদের অবহেলা ও যোগসাজশে এখনও বহাল তবিয়তে চাকরি করে যাচ্ছেন অনিয়মে নিয়োগ পাওয়া ওই ১৪ কর্মকর্তা।
তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক মো. শাহেদ এবং পরিচালক মো. মাঈনুদ্দিন এর প্রভাবে ২০১২ সালের পর থেকে প্রায় সাত বছর নিরীক্ষা কার্যক্রম চালাতে পারেনি সরকারি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অডিট অধিদফতর। তবে শাহেদের মৃত্যুর পর এসএসওসিএলের ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত এবং ২০১২-১৩ অর্থবছরের অংশ বিশেষের ওপর নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। ২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর থেকে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত মাঠপর্যায়ে নিরীক্ষা কাজ শেষ করে প্রতিবেদন জমা দেন নিরীক্ষা দলের প্রধান অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের প্রধান হিসাবরক্ষণ ও অর্থ কর্মকর্তা নারায়ণ চন্দ্র সাহা। বাণিজ্যিক ওই অডিটে কোনো ধরনের বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই ইচ্ছামতো সরাসরি আবেদনের মাধ্যমে ১৪ জন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেয়ার গুরুতর অনিয়ম পাওয়া যায়।
যাদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে, তারা হলেন— সিনিয়র অফিসার (মেইনটেনেন্স) মো. শহিদুল ইসলাম, জুনিয়র অফিসার (টেকনিক্যাল) দুর্জয় দে, অফিসার (হিসাব) মো. ফখরুল ইসলাম, টেকনিক্যাল অফিসার মো. আনোয়ার জাহিদ, সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রকৌশল) প্রলয় চক্রবর্তী, জুনিয়র সেলস অফিসার মো. শাহাদাত হোসেন, উপ-ব্যবস্থাপক (প্রকৌশল ও অপারেশন) মো. মোকাররম হোসেন, উপ-ব্যবস্থাপক (হিসাব) মো. মাহমুদুল হক, জুনিয়র অফিসার (অপারেশন) মো. শামীম সহিদ, টেকনিক্যাল অফিসার মো. আনিসুর রহমান, অফিসার (এইচআর) আবদুল্লাহ আল মামুন, অফিসার (সেলস) মীর হোসেন, ম্যানেজার (প্রোডাকশন ও অপারেশন) মো. ছিদ্দিকুর রহমান ও অফিস সহকারী মো. আশরাফ উদ্দিন।
অডিট আপত্তিতে উল্লেখ করা হয়, সিনিয়র অফিসার (মেইনটেনেন্স) শহিদুল ইসলামকে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিজ্ঞপ্তি ও পরীক্ষা ছাড়াই নিয়োগ দেয়া হয়। তার কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। নিয়োগের সময় তার বয়স ছিল ৩০ বছরের বেশি। এক্ষেত্রে অস্থায়ী নিয়োগের শর্তভঙ্গ করা হয়েছে বলে আপত্তিতে উল্লেখ করা হয়।
জুনিয়র অফিসার (টেকনিক্যাল) দুর্জয় দে-কে আবেদনের তারিখের আগেই নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাকে একাধিকবার ক্যাজুয়াল নিয়োগ দেয়া হয় বলে প্রমাণ পান অডিট অধিদফতরের নিরীক্ষকরা। অফিসার (হিসাব) ফখরুল ইসলাম ভুঁইয়াকে স্থায়ী করার ক্ষেত্রে ৮৯ দিনের শর্তভঙ্গ করা হয়েছে। অভিজ্ঞতা ছাড়াই তাকে প্রকল্পে নিয়োগ করা হয়। তিনি তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক শাহেদের জেলা ফেনীর বাসিন্দা এবং তার চাচাতো বোনের জামাই— নিরীক্ষকরা মৌখিকভাবে এমনটিই জেনেছেন বলে আপত্তিতে উল্লেখ করা হয়।
টেকনিক্যাল অফিসার আনোয়ার জাহিদকে শুধু আবেদনের ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়। এছাড়া কমিটির সুপারিশ ছাড়া কেবল আবেদনের ভিত্তিতে ম্যানেজারের সুপারিশে পদোন্নতিও দেয়া হয়। পাশাপাশি মেডিকেল রিপোর্টে কোলেস্টেরল, এলডিএল, এইচডিএল ও টিজি রেফারেন্স ভ্যালু অপেক্ষা কমবেশি ছিল বলে অডিট আপত্তিতে ওঠে আসে।
সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রকৌশল) প্রলয় চক্রবর্তীকেও নিয়োগ দেয়া হয়েছে শুধু আবেদনের ভিত্তিতে। তাকে অফিসের কাজের বাইরে কনসালটেন্সি করার অনুমতি দেয়া হয়। তারও মেডিকেল রিপোর্টে কোলেস্টেরল, এলডিএল, এইচডিএল ও টিজি রেফারেন্স ভ্যালুর চেয়ে কমবেশি ছিল। এছাড়া তিনি আগে যে অফিসে চাকরি করতেন, সে প্রতিষ্ঠানকে কোম্পানির নির্মাণকাজ পাইয়ে দিতে ভূমিকা রেখেছেন বলে আপত্তিতে উল্লেখ করা হয়। একইভাবে মেডিকেল প্রতিবেদনে কোলেস্টেরল, এলডিএল, এইচডিএল ও টিজি রেফারেন্স ভ্যালুর চেয়ে কম থাকার পরও জুনিয়র সেলস অফিসার শাহাদাত হোসেনকে নিয়োগ দেয়া হয় বলে আপত্তিতে বলা হয়।
অন্যদিকে মোকাররম হোসেনকে আবেদনের ভিত্তিতে কোনো ধরনের পরীক্ষা ছাড়াই সরাসরি উপ-ব্যবস্থাপক (প্রকৌ. ও অপা.) পদে নিয়োগ দেয়া হয়। মোকাররম প্রয়াত মহাব্যবস্থাপক শাহেদের ভাগনে বলে আপত্তিতে জানানো হয়।
একই কায়দায় নিয়োগ পান উপ-ব্যবস্থাপক (হিসাব) মো. মাহমুদুল হকও। তার নিয়োগেও ছিল না পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট। চাকরি স্থায়ীকরণের এক বছর পর পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য অনুরোধপত্র পাঠানো হয়েছে। পদোন্নতি কমিটি গঠন ছাড়াই সিনিয়র অফিসার থেকে সহকারী ব্যবস্থাপক ও উপ-ব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। বিধিতে চার বছর পর পদোন্নতি দেয়ার বিধান থাকলেও দুই বছরেই এসব পদোন্নতি দেয়া হয় বলে আপত্তিতে উল্লেখ করা হয়। এই মাহমুদুল হক তুষার তৎকালীন জিএম শাহেদের আপন খালাতো ভাই।
জুনিয়র অফিসার অপারেশন শামীম সহিদকে বিজ্ঞপ্তি ও পরীক্ষা ছাড়া নিয়োগ দেয়া হয়। বারবার অসদাচরণ করা সত্ত্বেও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ২০১৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন গায়েব করা হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে অডিট আপত্তিতে।
টেকনিক্যাল অফিসার আনিসুর রহমানকে একই কায়দায় সরাসরি এম-৭ গ্রেডে নিয়োগ দেয়া হয়। অফিসার (এইচআর) আবদুল্লাহ আল মামুনকে পূর্ব অভিজ্ঞতা এবং পরীক্ষা ছাড়াই সরাসরি এম-৭ গ্রেডে নিয়োগ দেয়া হয়। অফিসার (সেলস) মীর হোসেনও নিয়োগ পান সরাসরি। তিনি মহাব্যবস্থাপক শাহেদের শ্যালক হিসেবে জনশ্রুতি আছে বলে আপত্তিতে উল্লেখ করা হয়।
অফিস সহকারী আশরাফ উদ্দীনকেও নিয়োগ দেয়া হয়েছে পরীক্ষা ছাড়া। তাকে অপারেটর পদ থেকে অফিস সহকারী পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। তিনি মহাব্যবস্থাপক শাহেদের চাচাতো ভাই বলে অডিট আপত্তিতে উল্লেখ করা হয়।
সবচেয়ে বড় অনিয়ম হয়েছে ম্যানেজার (প্রোডাকশন অ্যান্ড অপারেশন) মো. সিদ্দিকুর রহমানের নিয়োগে। শুধু আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরাসরি উপ-ব্যবস্থাপক হিসেবে এম-৪ গ্রেডে নিয়োগ দেয়া হয় তাকে। ২০০৪ সালেও তিনি প্রতিষ্ঠানটিতে চাকরি করেছিলেন। তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় চাকরি থেকে বরখাস্ত হন। তাকে আবারও আবেদনের ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয় বলে আপত্তিতে উল্লেখ করা হয়। তিনি প্রথমে ২০০৩ সালে এসএওসিএলে যোগ দেন। পরে মন্ত্রণালয়ের তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় ২০০৪ সালে চাকরিচ্যুত হন। ২০১৫ সালে আবারও সরাসরি নিয়োগ পান। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির কোম্পানি সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন সিদ্দিকুর রহমান!
নিয়োগে অনিয়মের পাশাপাশি কর্মকালীন সময়েও নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন এসব কর্মকর্তা। অনুমোদনহীনভাবে ৫০ কোটি টাকার এফডিআর ভাঙিয়ে ৯৪ লাখ টাকা তছরূপ, বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই এসএসসি পাস না করা লোককে সিনিয়র অফিসার হিসেবে নিয়োগ, এসএওসিএলের টাকায় আমদানি করা দুইটি লিফট সাবেক কর্মকর্তার পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে স্থাপন, মেশিন আমদানির নামে বিদেশ সফর, অনুমোদনহীন গাড়ি ব্যবহার করে অর্থ অপচয়সহ নানা অভিযোগ রয়েছে এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে মোবাইল টেলিফোনে এবং সরাসরি যোগাযোগের চেষ্টা করে যমুনা টেলিভিশন। বেশিরভাগ কর্মকর্তার জবাব, ঊধ্বর্তন কর্মকর্তার অনুমতি ছাড়া তাদের কথা বলা নিষেধ।
তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ-আপত্তি থাকার পরও কেন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, তা জানতে প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মণি লাল দাস এর সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছ। প্রথমে মুঠোফোনে এই কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, তিনি অসুস্থ। চিকিৎসার জন্য ভারত যাচ্ছেন। ফিরে এসে কথা বলবেন।
কিন্তু ফিরে আসার পর তিনি এই প্রতিবেদকের আর ফোন ধরেননি। সরাসরি কথা বলার জন্য চট্টগ্রামে এসএওসিএল অফিসে, নগরীর নন্দকানন আবাসিক এলাকায় তার বাসায় যান এই প্রতিবেদক। তবে তিনি দেখা দেননি।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হটলাইনে আসা এক অভিযোগের সূত্র ধরে ঢাকা ও চট্টগ্রামের প্রায় সাতটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখায় অভিযান চালিয়ে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মঈনুদ্দিন আহমেদ ও তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মোহাম্মদ শাহেদের বিরুদ্ধে ৫৭ কোটি টাকা অবৈধভাবে স্থানান্তরের তথ্য পায়। এ ঘটনায় ওই বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি এসএওসিএলের ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের আয়-ব্যয় ও অডিটসহ সার্বিক আর্থিক কর্মকাণ্ড পর্যালোচনার জন্য চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে বিপিসি।
পরে তদন্ত কমিটি এসএওসিএলের অসহযোগিতার অভিযোগ এনে বিপিসিতে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়। ২০১২-১৩ ও ২০১৩-১৪ অর্থবছরের শুধু নমুনাভিত্তিক কিছু আর্থিক কার্যক্রমের অনুসন্ধান করে প্রায় তিনশ কোটি টাকার অনিয়মের সত্যতা পায় কমিটি। পরে তদন্ত প্রতিবেদনটি দুদকে পাঠায় বিপিসি। ২০২০ সালের ১৮ আগস্ট করোনা উপসর্গ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির জিএম মোহাম্মদ শাহেদ মারা যান।
এ জাতীয় আরো খবর..