×
  • প্রকাশিত : ২০২৪-০৬-২৪
  • ৭০ বার পঠিত
ভারতীয় কম্পানি টাটা সন্সের শেয়ার সাধারণ মানুষ কিনতে পারেন না। কম্পানিটির মালিকানা কেবল টাটা পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কয়েক বছর আগে যখন এর মালিকানাসংক্রান্ত করপোরেট মামলা চলছিল, তখন একটি অদ্ভুত তথ্য প্রকাশ্যে আসে। তাদের শেয়ারের একটি হিসাব প্রকাশ করা হয়।

তাতে দেখা যায়, টাটা ট্রাস্টের হাতে রয়েছে দুই লাখ ৬৬ হাজার ৬১০টি শেয়ার। শাপুরজি পালোনজি পরিবারের হাতে রয়েছে ৭৪ হাজার ৩৫২টি শেয়ার, বিভিন্ন টাটা সংস্থার অধীনে রয়েছে ৪৯ হাজার ৩৬৫টি শেয়ার, টাটা পরিবারের সদস্যদের নামে রয়েছে আট হাজার ২৩৫টি শেয়ার। আর একটি মাত্র শেয়ার রয়েছে গুজরাট রাজ্যের ছোটা উদয়পুরের কোনো এক বীরেন্দ্র সিং চৌহানের নামে।
এই তথ্য প্রকাশ্যে আসার পরই রহস্য ঘনিয়ে ওঠে বীরেন্দ্র সিংকে নিয়ে।

প্রশ্ন উঠতে শুরু করে বীরেন্দ্র সিং আসলে কে? তিনি টাটা সন্সের শেয়ারই বা পেলেন কী করে? যে সংস্থা শেয়ারবাজারের তালিকাভুক্ত নয়, তার শেয়ার টাটা পরিবারের বাইরে কোনো ব্যক্তির হাতে গেল কী করে? বিশেষ করে যেখানে টাটাদের ‘কুটুম্ব’ তথা রতন টাটার ভাই নোয়েল টাটার শ্বশুরবাড়ি সাপুরজি পালোনজি পরিবারকেই বহিরাগত বলে মনে করে টাটারা, সেখানে পরিবারের বাইরের একজন এই শেয়ার পান কিভাবে? এর পাশাপাশি আরো একটি প্রশ্ন ওঠে—ওই ব্যক্তির কাছে টাটা সন্সের কেবল একটি শেয়ারই বা রয়েছে কেন?
ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম স্ক্রোল বীরেন্দ্রের ছেলে জয়প্রতাপ সিংজির সঙ্গে কথা বলে এই রহস্যমোচন করে। জানা যায়, বীরেন্দ্রের আসল নাম মহারাওয়াল বীরেন্দ্র সিংজি নটবর সিংজি চৌহান। তিনি ছিলেন ছোটা উদয়পুরের মহারাওয়াল বা মহারাজা। ব্রিটিশ শাসনেরও আগে গুজরাটের একটি দেশীয় রাজ্য ছিল ছোটা উদয়পুর।

রাজস্থানের সম্রাট ও বীর যোদ্ধা পৃথ্বীরাজ চৌহানের বংশধররা ছিলেন সেই রাজ্যের শাসক। তার বংশে রাজারা শিল্প ও স্থাপত্যে উৎসাহী ছিলেন। উৎসাহী ছিলেন আধুনিক প্রযুক্তিকে আপন করে নেওয়ার ক্ষেত্রেও। তিরিশের দশকে এই বংশের রাজা ছিলেন মহারাওয়াল নটবর সিংজি। শোনা যায়, তিনি ১৯৩৭ সালে নিজের জন্য একটি বিশেষভাবে নির্মিত রোলস রয়েস ফ্যান্টম মডেলের গাড়ি আনিয়েছিলেন ব্রিটেন থেকে।

আরো জানা যায়, সেই গাড়ির ভেতরটা তৈরি করা হয়েছিল রেলের বিলাসবহুল সেলুন কারের মতো করে। যাতে গাড়িতে বসেই ট্রেনে চাপার অভিজ্ঞতা পেতে পারেন তিনি। বিশেষভাবে তৈরি সেই রোলস রয়েসের পেছনের বসার আসনের জন্যও ছিল একটি ড্যাশবোর্ড। যাতে যাত্রীরা পেছনে বসেও গাড়ির গতি দেখতে পারেন।

এই নটবর সিংজি ১৯৪৬ সালে লিসবনে ছুটি কাটাতে গিয়ে হঠাৎই মারা যান। তারপর রাজ্য শাসনের দায়িত্ব এসে পড়ে বীরেন্দ্র সিংয়ের কাঁধে, যিনি তখন মাত্র ১১ বছরের বালক। তবু সেই বয়সেই রাজা হন বীরেন্দ্র। এক বছর পরে যখন ব্রিটিশ শাসন থেকে দেশ মুক্ত হয় এবং বহু স্বাশাসিত দেশীয় রাজ্য স্বাধীন ভারতের অঙ্গ হয়ে যায়, তখনো ছোট্ট রাজা বীরেন্দ্রের সে সব বোঝার ক্ষমতা ছিল না। ছোটা উদয়পুরে কুসুমবিলাস প্রাসাদই ছিল তার জগৎ। পরে ইন্দোরের ডালি কলেজে পড়াশোনা করেন তিনি। এই কলেজ ছিল ভারতের বিভিন্ন রাজ পরিবারের সন্তানদের পড়াশোনার জায়গা।

বীরেন্দ্র রাজা হলেও কলেজে পড়তে পড়তে তার মধ্যে ব্যবসায়িক বুদ্ধির স্ফুরণ দেখা যায়। পরে রাজা হিসেবে তিনি যত না পরিচিত হন, তার থেকে অনেক বেশি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন একজন শিল্পদ্যোগী হিসেবে। ১৯৬২ সালের ইকোনমিক উইকলি নামের একটি অর্থনীতিসংক্রান্ত পত্রিকায় দেথা যায় বীরেন্দ্রকে একজন শিল্পপতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ওই পত্রিকায় এ-ও জানানো হয়েছে, তিনি টাটা গোষ্ঠীর রেডিও প্রস্তুতকারী সংস্থা ন্যাশনাল একসোর ডিরেক্টর। হিসাব বলছে, তখন বীরেন্দ্র সবে ২৬ বছরের এক তরতাজা যুবক। আর তার প্রায় সমবয়সী রতন টাটা, যিনি ভবিষ্যতে টাটা গোষ্ঠীর সর্বেসর্বা হবেন, তখন সবে টাটা স্টিলে একজন শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করতে শুরু করেছেন।

বীরেন্দ্র তখন এগিয়েই চলেছেন। একের পর এক সংস্থায় কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে তাকে। কয়েক বছরের মধ্যেই দেশের নামিদামি কেম্পানির ডিরেক্টরদের সঙ্গে এক টেবিলে বসে পড়েছেন। কাজ করেছেন আজিম প্রেমজির বাবা হাসাম প্রেমজি, এস এস কিরলোস্কার, বি এম ঘিয়া, নবরোজ বি ভাকিল, বরোদার মহারাজার মতো শিল্প জগতের বিখ্যাত সব ব্যক্তিত্বের সঙ্গে। তিরিশের কোঠায় তাকে আবার ডিরেক্টর পদে নিয়োগ করে টাটা। এবার তিনি দায়িত্ব নেন টাটা মিলসের, যে সংস্থা তখন টাটার মূল সংস্থাগুলোর একটি। যার মাথায় ছিলেন রতনের বাবা নওল টাটা।

পরে টাটা পরিবারের সঙ্গে টাটাদের বোর্ড সদস্যও হন বীরেন্দ্র। ক্রমেই টাটা পরিবারের ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত একজন হয়ে ওঠেন বীরেন্দ্র।

রাজকীয়তা ছিল বীরেন্দ্রর রক্তে। তবে তিনি নিজের কাজ দিয়ে আলাদা পরিচয়ও তৈরি করেন। সেই সময় ভারতের উচ্চ সমাজের বড় নাম ছিলেন বীরেন্দ্র। মুম্বাই ও লন্ডনের বহু ক্লাবের সদস্য ছিলেন। শিকার করতেন, ঘোড়া চালাতে ভালোবাসতেন, গাড়ির রেসে অংশ নিতেন, আবার ক্রিকেট, বিলিয়ার্ডও খেলতেন।

বীরেন্দ্র তার কাজের জন্য বড় অঙ্কের বেতন তো পেতেনই, এর পাশাপাশি ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসেবে জুড়ে যাওয়ার চুক্তির জন্য সরকারের কাছ থেকে বছরে দুই ১২ হাজার রুপি করে পেতেন। তখনকার দিনে এই অঙ্ক নেহাৎ কম ছিল না। যদিও ১৯৭১ সালে ভারত সরকার আইন করে দেশীয় রাজ্যগুলোর অনুদান বন্ধ করে দেওয়ার পর সেই অর্থ আসার পথ বন্ধ হয়ে যায়। তবে বীরেন্দ্র তার ক্ষুরধার ব্যবসায়ী বুদ্ধিতে ততদিনে অনেকটাই ওপরে উঠে গেছেন।

কিন্তু বীরেন্দ্রর কাছে টাটা গোষ্ঠীর পারিবারিক শেয়ার গেল কী করে? বীরেন্দ্রের ছেলে জয়প্রতাপ জানান, ১৯৮০ সালে জাহাঙ্গির রতনজি দাদাভাই টাটা ১২-১৩টি টাটা সন্সের শেয়ার দিয়েছিলেন বীরেন্দ্রকে। এর সঠিক কারণ না জানলেও জয়প্রতাপের ধারণা, এই ধরনের সংস্থায় অনেক সময়ে শেয়ারের আভ্যন্তরীণ হিসাব বদলায়। হয়তো সেভাবেই তখন কিছু শেয়ার অতিরিক্ত হয়েছিল। টাটাদের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় সেই শেয়ার দেওয়া হয়েছিল বীরেন্দ্রকে। জয়প্রতাপ মনে করেন, ওই শেয়ার ছিল তার বাবার প্রতি টাটাদের ভরসার একটি স্মারক।

কিন্তু তাহলে এখন বীরেন্দ্রর নামে একটি মাত্র শেয়ার রয়েছে কেন? জয়প্রতাপ জানান, ১৯৯৮ সালে বীরেন্দ্র নিজে বস্ত্র ব্যবসায় নামেন। নিজের কারখানাও গড়ে তোলেন। সেই সময়ই মূলধনের প্রয়োজনে টাটার শেয়ার বিক্রি করে দেন। রেখে দেন শুধু একটি। স্মৃতিচিহ্ন হিসেবেই। যে স্মৃতির বরাবরের ভক্ত ছোটা উদয়পুরের রাজপরিবার। কারণ তাদের রাজপ্রতীকে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা রয়েছে দুটি লাতিন শব্দ—‘মেমোরিয়া ম্যানেট’, যার বাংলা অর্থ ‘স্মৃতি টুকু থাক’।

যদিও এই স্মৃতির দাম নেহাত কম নয়। টাটা সন্সের ওই একটি শেয়ারের দামের হিসাব কষলে বাকি শেয়ার হোল্ডারদের সম্পত্তির হিসাব কষতে হবে। শাপুরজি পালোনজিদের শেয়ারের হিসাব করলে দেখা যাবে, তাদের ৭৪ হাজারের কিছু বেশিসংখ্যাক শেয়ারের দাম না হলেও ৯০ হাজার কোটি রুপি। সেই হিসাবে বীরেন্দ্রের ওই একটি শেয়ারের দাম এক কোটির কম তো হবেই না।

তবে এই কোটি টাকার শেয়ার এখনো রয়েছে বীরেন্দ্রের নামেই। জয়প্রতাপ জানান, তার বাবা ২০০৫ সালে মারা গেলেও ওই শেয়ারের মালিকানা রয়েছে তারই নামে। বীরেন্দ্রের দুই সন্তানের মধ্যে উত্তরাধিকারী কে হবেন, তা নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছে পরিবারে। তা না মিটলে কোটি টাকার শেয়ার কার ভাগ্যে যাবে, সে ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত হবে না।

সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat