দেশে হস্তশিল্পের অভ্যন্তরীণ বাজার ১০ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকার এবং ৭৫০ বিলিয়ন ডলারের বিশ্ববাজার রয়েছে। বাংলাক্রাফট সূত্রে জানা যায়, বৈশ্বিক এই বাজার প্রতিবছর ২০ শতাংশ হারে বাড়ছে। তবে নানা প্রতিবন্ধকতায় পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। ২০২৮ সালে এর বৈশ্বিক বাজার হবে এক লাখ ৩০ হাজার কোটি ডলারের।
যেখানে বাংলাদেশে এর হিস্যা মাত্র ১ শতাংশের কম।
হস্তশিল্পের এমন সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সরকারের নীতি সহায়তা, গবেষণায় বিনিয়োগ এবং জাতীয় হস্তশিল্প পণ্য পল্লী করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। যেখানে বিদেশি পর্যটকদেরও আকর্ষণ করবে। এ ছাড়া রপ্তানি প্রণোদনা আগের মতো ৮ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করার দাবি জানানো হয়েছে।
তবে রপ্তানি হিসেবে বাংলাক্রাফট এবং রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যে কিছু গরমিল রয়েছে। বাংলাক্রাফট ১০০ কোটি ডলারের রপ্তানি পরিসংখ্যানের কথা জানালেও ইপিবির তথ্য অনুসারে, দেশের হস্তশিল্প থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আয় হয়েছে দুই কোটি ৯৭ লাখ ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে আয় এসেছে চার কোটি ২৮ লাখ ডলার এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে এই খাত থেকে আয় এসেছিল তিন কোটি ৩৯ লাখ ডলার। সেই হিসেবে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের হিস্যা ১ শতাংশ বা দুই কোটি ৯০ লাখ ডলার।
এদিকে চলতি অর্থবছরের গত ১১ মাসে এই খাত থেকে আয় হয়েছে তিন কোটি ২০ লাখ ডলার। এই আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে বেড়েছে ১৯.২৩ শতাংশ। এর আগের অর্থবছরের এই সময়ের আয় ছিল দুই কোটি ৬৮ লাখ ডলার। বাংলাদেশে প্রধান প্রতিযোগী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে চীন, ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া। এই দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১তম।
বাংলাক্রাফটের তথ্য বলছে, বিশ্বে হস্তশিল্পজাত পণ্য রপ্তানিতে সবার ওপরে রয়েছে ভারত। শুধু ২০২৩ সালেই প্রায় ৬৩ লাখ শিপমেন্ট করেছে প্রতিবেশী দেশটি। এই তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে আছে ইন্দোনেশিয়া, তৃতীয় স্থানে ভিয়েতনাম এবং চতুর্থ স্থানে চীন। তাদের শিপমেন্ট যথাক্রমে দেড় লাখ, ৫৬ হাজার এবং ৫১ হাজার। বাংলাদেশের শিপমেন্ট এক হাজারের কিছু বেশি।
বাংলাদেশ থেকে হস্তশিল্পজাত পণ্য যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স, হল্যান্ড, বেলজিয়াম, স্পেন, জাপানসহ বিশ্বের ৫০ দেশে যায়। কভিড মহামারির কারণে প্রাকৃতিক পণ্য ব্যবহারে আগ্রহ বাড়ায় বাংলাদেশি হস্তশিল্পের জন্য সুযোগ তৈরি হয়। বর্তমানে রপ্তানির ৬০ শতাংশ হচ্ছে ইউরোপে।
খাতসংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, করোনা মহামারির সময় এই খাতের রপ্তানি আয় ঊর্ধ্বমুখী থাকলে বৈশ্বিক মন্দা, মূল্যস্ফীতি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে এই খাতের রপ্তানি আয় নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির দিকে যাচ্ছে। তবে তাঁরা মনে করেন, প্রচ্ছন্ন রপ্তানি বা ডিম এক্সপোর্ট আরো বেশি। কেননা জামদানি, তাঁতের শাড়ি, শতরঞ্জি টেরাকোটা, নকশিকাঁথা হস্তশিল্প হলেও এসবের কোনো কোনো পণ্য আলাদাভাবে রপ্তানি হয়।
এই খাতে সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে তাঁরা আরো বলেন, সার্কুলার ইকোনমি বা ঘূর্ণায়মান অর্থনীতিতেও এর বিশাল ভূমিকা আছে। বিশেষ করে কাপড়ের বর্জ্য বা পুরনো কাপড়ের তৈরি হস্তশিল্পেও বিশাল ভূমিকা আছে এই খাতের।
সরকার এই খাতকে ২০২৪ সালের বর্ষপণ্য উল্লেখ করে জানায়, বিশ্ববাজারের পাশাপাশি বিশাল একটি অভ্যন্তরীণ বাজারও রয়েছে। বিশেষ করে করপোরেট বিশ্বেও এই হস্তশিল্পের চাহিদা বাড়ছে। স্থানীয় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জার পাশাপাশি বিভিন্ন স্যুভেনির পণ্যে ব্যবহার করছে হস্তশিল্পের।
বাংলাক্রাফটের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন. হস্তশিল্পের বৈশ্বিক বাজার ৭৫০ বিলিয়ন ডলার। ২০ শতাংশ হারে বাড়ছে এই বাজার। ২০২৮ সালে এক হাজার ৩০০ বিলিয়ন ডলার হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বিবিএসের ২০২৩ সালের তথ্য বলছে, ২০২২ সালে হস্তশিল্পের মোট প্রতিষ্ঠান ছিল ৭৩ হাজার ৫৪২টি। এর মধ্যে ৪৩.৮ শতাংশই (৩২,২২৪টি) বাঁশ ও বেতের প্রতিষ্ঠান। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে মৃৎপাত্র ও টেপা পুতুল তৈরির প্রতিষ্ঠান। এগুলো আছে ১৪ হাজার ১০৮টি।
বিবিএস জরিপ বলছে, হস্তশিল্প খাতে মোট কর্মসংস্থান ব্যয় ৯৯৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে কাঁচামালেই লাগে ৭০৭ কোটি টাকা। রপ্তানিকারকরা বলছেন, হস্তশিল্পের জন্য যে কাঁচামাল প্রয়োজন তা সব সময় পাওয়া যায় না। বিবিএসের জরিপেও দেখা গেছে, প্রায় ২৫ শতাংশ উদ্যোক্তার কাছেই উপকরণ বা কাঁচামাল সংগ্রহই মূল সংকট।
হস্তশিল্প প্রদর্শনী শুরু কাল
বৈশ্বিক বাজারের বিশাল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে আগামীকাল থেকে শুরু হতে যাচ্ছে পাঁচ দিনব্যাপী হস্তশিল্পের প্রদর্শনী। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আয়োজিত এই প্রদর্শনী চলবে ২৯ জুন পর্যন্ত। এবারের মেলায় হস্তশিল্পের প্রায় ১০০টি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করছে। এর মধ্যে রয়েছে জেডিপিসি, বাংলাক্রাফট, জয়িতা এবং রংপুরের শতরঞ্জি। মেলার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে হস্তশিল্পের প্রচার-প্রসার, নারী কর্মসংস্থান এবং দেশের প্রাচীন ও ঐহিত্যবাহী পণ্য তুলে ধরা।
এ জাতীয় আরো খবর..