বিএনপি ও ছাত্রদলের আট মহানগর কমিটিসহ জাতীয়তাবাদী যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দেওয়া হলো গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে। যদিও ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল মহানগরসহ একসঙ্গে মোট নয়টি কমিটি বিলুপ্তির কোনো কারণ উল্লেখ করেনি বিএনপি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিগত আন্দোলনে ব্যর্থতার নিরিখে নতুন করে দল পুনর্গঠনের লক্ষ্যে বড় আকারে এই সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত।
এ বিষয়ে গতকাল শুক্রবার বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক দায়িত্বশীল নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একটি বৃহত্তর আন্দোলনে বিপর্যয়ের পর দলের বিভিন্ন পর্যায়ে নানা দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। বিশেষ করে ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের পর বিগত আন্দোলনে বিভিন্ন মহানগর বিএনপিসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর ব্যর্থতা নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। এর মধ্যে আন্দোলনে ছাত্রদল ও যুবদলের ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ছিল। এ দুই সংগঠনকে বিএনপি আন্দোলনের ‘ভ্যানগার্ড’ হিসেবে আশা করে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, শিগগিরই অন্যান্য কমিটি ভেঙে দিয়ে পুনর্গঠন করা হবে। তবে হঠাৎ করে একসঙ্গে এতগুলো কমিটি ভেঙে দেওয়ার বিষয়ে জ্যেষ্ঠ ও কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকে কিছু জানতেন না বলে জানা গেছে। কারণ, এ বিষয়ে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কোনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি। বরাবরের মতো গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে কমিটি বিলুপ্তির ঘোষণা দেওয়া হয়। এতে বাদ পড়া নেতাদের অনেকে অসন্তুষ্ট, কেউ কেউ হতবাক হন।
অবশ্য সদ্য বিলুপ্ত ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালাম কমিটি বিলুপ্তিকে ‘দল পুনর্গঠনের চলমান প্রক্রিয়া’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপিতে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান ছাড়া সব পদই পরিবর্তনশীল। আমাকে দলের স্বার্থে, আন্দোলনের স্বার্থে যখন যেখানে কাজে লাগাবে, আমি সেখানেই কাজ করব।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বিগত আন্দোলনে সবচেয়ে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা ছিল বরিশাল মহানগরে। সেখানে মজিবর রহমান সরোয়ারকে সরিয়ে তাঁর বিরোধী বলে পরিচিত মনিরুজ্জামান খানকে আহ্বায়ক করে মহানগর কমিটি করা হয়। ফলে শুরু থেকেই এই কমিটি নিয়ে বিতর্ক এবং নানা রকমের দ্বন্দ্ব চলছিল। কমিটি বিলুপ্তির পর সরোয়ারের অনুসারীরা তৎপর হয়েছেন। মজিবর রহমান সরোয়ার বর্তমানে দলের যুগ্ম মহাসচিব। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কমিটি বিলুপ্ত করাটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ারই অংশ। এখন পূর্ণাঙ্গ কমিটিও হতে পারে, আহ্বায়ক কমিটিও হতে পারে। যাহোক, সবাইকে নিয়ে সমন্বয় করেই যা করার করতে হবে। কারণ, আগে আহ্বায়ক কমিটি নেতৃত্ব দেওয়ার সময় আন্দোলন-সংগ্রামের অনেক ক্ষতি হয়েছে। নেতৃত্ব তৈরি হয়নি।’
বিএনপির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, বিগত আন্দোলনে কেন্দ্রীয় ও মাঠপর্যায়ের নেতাদের কার কী ভূমিকা ছিল, সে বিষয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন যায় লন্ডনে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে। তাঁর আগ্রহে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। সেটির ভিত্তিতেই তিনি কমিটি পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। তবে এ লক্ষ্যে তারেক রহমান কিছুদিন ধরে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করেন। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাতে কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণার আগে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি এবং যুবদলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে পৃথক ভার্চ্যুয়াল সভা করেন। সেখানে নেতাদের নতুন কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত জানিয়ে তাঁকে সহযোগিতার অনুরোধ জানান।
যুবদলের বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোনায়েম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যর্থতার জন্য কমিটি বিলুপ্ত করার হয়েছে মনে করি না। দলকে গতিশীল করার জন্য এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আর বিএনপি তো আন্দোলনে ব্যর্থ হয়নি। রাষ্ট্রযন্ত্রের এত নির্যাতনের মধ্যেও বিএনপি মাঠে ছিল। মানুষ যে ভোট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, এটি তো বিএনপির আন্দোলনেরই সাফল্য।’
দলের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, কোনো কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ থাকলে তা ভেঙে দেওয়া হবে। আর যেসব কমিটির মেয়াদ আছে, কিন্তু সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক বিগত আন্দোলনের মাঠে নিষ্ক্রিয় ছিলেন, তাঁদের সরিয়ে নতুন কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হবে। এমন নেতাদের একটি তালিকা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে রয়েছে। ওই সূত্র জানিয়েছে, বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটি, নির্বাহী কমিটি, জেলা ও মহানগর কমিটিসহ অন্যান্য অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠনের কাজও তাঁর বিবেচনায় রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
একসঙ্গে নয়টি কমিটি বিলুপ্তির পর সেগুলোর নেতৃত্বে অনেকের নাম আলোচিত হচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকা মহানগর উত্তরের সদস্যসচিব আমিনুল হক ও দক্ষিণের সদস্যসচিব রফিকুল আলম আগামী দিনেও থাকছেন বলে জানা গেছে। উত্তরের কমিটিতে তাবিথ আউয়াল, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম, সুলতান সালাউদ্দিন, যুবদলের সাবেক সহসভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর এবং দক্ষিণে আবার হাবিব উন নবী খান, হাবিবুর রশিদ ও তানভীর আহমেদের নাম আসছে।
চট্টগ্রাম মহানগরের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণার পরও আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেনের নাম শোনা যাচ্ছে। তাঁর সঙ্গে বিএনপির জ্যেষ্ঠ সদস্য এরশাদ উল্লাহ, যুগ্ম আহ্বায়ক নাজিমুর রহমান, এস এম সাইফুল ইসলাম ও আবুল হাশেমের নামও আলোচিত হচ্ছে।
শাহাদাত হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘দলীয় হাইকমান্ড যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আমরা তা-ই মেনে নেব। আমি নিজেও দীর্ঘদিন থেকে চাচ্ছি কেন্দ্রীয় কমিটিতে যেতে।’
এবার যুবদলের নেতৃত্বে কারা আসছেন, তা নিয়েও নেতা-কর্মীদের মধ্যে কৌতূহল আছে। এর মধ্যে বিলুপ্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোনায়েম নতুন কমিটিতেও থাকতে পারেন বলে জানা গেছে। তাঁর সঙ্গে বিদায়ী কমিটির সহসভাপতি নুরুল ইসলাম ও এস এম জাহাঙ্গীর, যুগ্ম সম্পাদক শফিকুল ইসলাম ও গোলাম মাওলার নাম আলোচিত হচ্ছে।
বিগত আন্দোলনে ছাত্রদলের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পর গত ১ মার্চ রাকিবুল ইসলামকে সভাপতি ও নাছির উদ্দীনকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রদলের সাত সদস্যের আংশিক কমিটি দেওয়া হয়। গত বৃহস্পতিবার ছাত্রদলের ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিম শাখা কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। নতুন কমিটি গঠনের প্রস্তুতি চলছে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথম কথা হচ্ছে সবগুলো কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। আমরা আগেই করতে চেয়েছিলাম। ছাত্রদলের সাংগঠনিক অভিভাবক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি মনে করেছেন এখনই সুবিধাজনক সময়। তা ছাড়া আমরা আন্দোলন উপযোগী নেতৃত্ব আনতে চাই।’
এ জাতীয় আরো খবর..