বেসরকারি চাকরিজীবী শরিফের কাছে নতুন বাজেটের পর আয়-ব্যয়ের হিসাব আরো জটিল মনে হচ্ছে। বিভিন্ন পণ্যে বাড়তি শুল্ক ও কর আরোপের কারণে আগামী দিনে যে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়বে তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন তিনি। বাচ্চার দুধের দাম আদৌ কমবে কি না তা নিয়ে সংশয় থাকলেও বাচ্চার চকোলেট, জুস, আইসক্রিমের জন্য তাকে যে বেশি অর্থ গুনতে হবে তা নিশ্চিত। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে পার্কে ঘুরতে যাওয়া বা স্ত্রীর রূপচর্চা নিয়েও আছেন টেনশনে।
টেনশন কমাতে বাড়িতে মোবাইলে কথা বলবেন বা সিগারেট খাবেন, সেখানেও নেই স্বস্তি।
শরিফ বলেন, ‘৪৮ হাজার টাকা বেতন পেয়েও চলতে পারছি না। শুনলাম বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমানোই মূল টার্গেট নেওয়া হয়েছে। তাহলে তো পণ্যের দাম কমার কথা।
কিন্তু কোন পণ্যের দাম কমবে সেটাই খুঁজে পাচ্ছি না। এখন প্রতি মাসেই ১০-১৫ হাজার টাকা ধার করতে হয়। বেতন বাড়ার তো কোনো আওয়াজ নেই। এবার মনে হচ্ছে, খরচ বাঁচাতে পরিবারকে গ্রামেই পাঠিয়ে দিতে হবে।
অথচ দুই বছর আগে ৪০ হাজার টাকা বেতনেও চলতে তেমন সমস্যা হয়নি।’
শরিফের মতো একই গল্প বেশির ভাগের। আর নিম্নবিত্তরা তো চলছে নাগরিক সুবিধার বাইরে। সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক লক্ষ্যের তুলনায় দ্বিগুণ মূল্যস্ফীতি। খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরো বেশি।
দেশে মাথাপিছু আয় এখন দুই হাজার ৭৮৪ ডলার, বা প্রায় তিন লাখ টাকা। যেটা একজনের আয়। কিন্তু সেই আয় দিয়ে বেশির ভাগ মানুষকেই তার পরিবার চালাতে হয়, যা একটি পরিবারের চাহিদার তুলনায় খুবই কম।
গত ১৪ মাস ধরে দেশে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি। যে হারে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, তার চেয়ে ২ শতাংশ কম হারে বাড়ছে বেতন। অর্থাৎ প্রতি মাসেই একজন মানুষকে এই পরিমাণ অর্থ ধার করে চলতে হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দেরিতে হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। যদিও উচ্চ মূল্যস্ফীতি বাগে আসার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
স্বল্প মজুরিতে সংসার চালাতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠছে তাদের। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মাসিক মূল্য ও মজুরির তথ্যে দেখা যায়, গত এক বছরে (ফেব্রুয়ারি-২৩ থেকে জানুয়ারি-২৪) গড় মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৯.৫৮ শতাংশ এবং গড় মজুরি বৃদ্ধির হার ৭.৪৯ শতাংশ। অর্থাৎ আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হচ্ছে ২ শতাংশ। যার কারণে দেশের ৩৭ শতাংশ পরিবারই ঋণ করে সংসার চালাচ্ছে। আর এই ঋণের পরিমাণ গড়ে এক লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকা বলে উঠে এসেছে বিবিএসের খানা আয়-ব্যয় জরিপে।
মূল্যস্ফীতির শুরু বৈশ্বিক কারণে হলেও সরকারের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে মূল্যস্ফীতি কমছে না বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি কমাতে আমাদের প্রেসক্রিপশন ভুল ছিল। আমাদের যে পথে চলার দরকার ছিল, আমরা তার উল্টো পথে চলেছি। যার কারণে প্রায় এক বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে। কমানো যাচ্ছে না। আমরা এখন যে সিদ্ধান্ত নিচ্ছি তা আরো অনেক আগে নেওয়া দরকার ছিল। তখন আমরা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ ছাড়া আমরা বাজারে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণেও ব্যর্থ হয়েছি। যার সামগ্রিক প্রভাব এই অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি। যার মাসুল গুনছে সাধারণ জনগণ।’
এদিকে বাজেটে দেখা যাচ্ছে, শহরের কোলাহল ছেড়ে ঘুরতে যাওয়ার অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ও থিম পার্ক সেবার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসানো হচ্ছে। বাচ্চাদের আইসক্রিম, চকোলেট কিংবা কোমল পানীয়, বিভিন্ন ধরনের জুস, আমসত্ত্বতেও ভ্যাট যুক্ত করা হয়েছে। তীব্র দাবদাহ থেকে বাঁচতে এসি কেনার স্বপ্নেও সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট বসানো হয়েছে এসি ফ্রিজ তৈরির মূল উপকরণ কম্প্রেসার ও অন্য উপকরণ আমদানিতে। নারীদের রূপচর্চার সামগ্রীর ওপর ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে। মোবাইল ফোনে কথা বলতে ও ইন্টারনেট ব্যবহারে ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক যোগ করা হয়েছে। তবে ৩০টি নিত্যপণ্যের সরবরাহ পর্যায়ে উৎস কর ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা হচ্ছে। তবে এতে এসব পণ্যে কতটা দাম কমবে তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।
বেসরকারি এক গবেষণার তথ্য মতে, নিম্ন আয়ের মানুষ খাবারে বেশি খরচ করে। মজুরির তুলনায় মূল্যস্ফীতি বেশি হলে এই শ্রেণির মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপন প্রভাবিত হয়। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আগামী বাজেটে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই হবে সরকারের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। এ জন্য একগুচ্ছ সমন্বিত নীতি নিতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তায় জোর দেওয়ার পাশাপাশি শহরাঞ্চলের শ্রমিকদের জন্য রেশনিংয়ের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতির কারণে যেহেতু বাচ্চাদের পুষ্টির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, সেহেতু তাদের জন্য স্কুলে বিনা মূল্যে খাদ্য কর্মসূচি চালু করা দরকার।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হচ্ছে এবং রাজস্বনীতিতেও সহায়ক নীতিকৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দিতে ফ্যামিলি কার্ড, ওএমএস ইত্যাদি কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। আমাদের গৃহীত এসব নীতিকৌশলের ফলে আশা করছি আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশে নেমে আসবে।
একই সঙ্গে কর রাজস্বের পরিমাণ জিডিপির ১০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যে প্রশাসনিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, করজাল সম্প্রসারণ এবং কর আদায় ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনার অটোমেশন এবং হিউম্যান ইন্টারফেস কমানো ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘বাজেটে সরকার মূল্যস্ফীতি কমানোর যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তাতে সাধারণ মানুষের তেমন কোনো সুবিধা হবে না। কারণ মূল্যস্ফীতি বেশি থাকার কারণে পণ্যের দাম বেশিই থাকবে।’
এ জাতীয় আরো খবর..