×
  • প্রকাশিত : ২০২৪-০৫-২৭
  • ৮৬ বার পঠিত
বঙ্গোপসাগরে বিভিন্ন সময়ে জন্ম নেয়া ঘূর্ণিঝড়ে স্থলভাগের ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি ঠেকাতে বরাবরই ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে সুন্দরবন। রেমালের ব্যাপক তাণ্ডবে এবারও বুক চিতিয়ে লড়েছে সুন্দরবন। ঝড়ের সামনে লড়াই করে বাতাসের গতিবেগ অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে এই বন।

ঘূর্ণিঝড় রেমালের এগিয়ে আসার আগমুহূর্তে আবারও আলোচনায় বাংলাদেশ অংশে ছয় হাজারের বেশি বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। ধারণা করা হচ্ছে, সিডর, আইলা, বুলবুল, আম্পান, ইয়াসের মত এবারও সুন্দরবন ঘূর্ণিঝড় রেমালকে মোকাবিলা করছে এবং এ বনই তাকে রুখে দেবে। এ ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথ সম্পর্কে যে ধারণা পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে রেমালের যাত্রাপথে এর ঝাপটা মোকাবিলায় বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে সুন্দরবন।

সোমবার (২৭ মে) আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়টি পূর্ণগতিতে উপকূল অতিক্রম করছে। মোংলা, পটুয়াখালীর খেপুপাড়া ও পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে এ ঘূর্ণিঝড় অতিক্রম করছে। উপকূল পার হতে এটি ৫-৬ ঘণ্টা সময় নিচ্ছে। এ সময় বাতাসের গতিবেগ ১১১ কিলোমিটার।’

ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রকৃতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এটাকে প্রায় আইলার সঙ্গে তুলনা করতে পারি, একই ক্যাটাগরির। আবার কোনও ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে কোনও ঘূর্ণিঝড় সিমিলার হবে না।’
 
তিনি বলেন, ‘প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমালের ব্যাসার্ধ ২০০ কিলোমিটার। মানে খেপুপাড়ার কাছ দিয়ে রেমাল পার হওয়ার সময় বামে ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকা পাচ্ছে আর ডানে ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে বরিশাল-পটুয়াখালী পাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে খেপুপাড়ার পাশ দিয়ে অতিক্রমকালে সুন্দরবনের ওপর দিয়েও এর প্রভাব পড়ছে, বরিশাল-পটুয়াখালীতেও পড়বে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এ সময় বনায়নের কারণে সুন্দরবন ও আশপাশের এলাকা হয়ত কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু বনায়ন কম এমন এলাকায়, বরিশাল-পটুয়াখালীতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়তে পারে।’

আবহাওয়া অধিদফতরের সাবেক পরিচালক ড. সমরেন্দ্র কর্মকার বলেন, ‘এ অঞ্চলে বেশকিছু ঝড় সুন্দরবনের দিকে এসেছে সত্যি। কিন্তু আপার স্টিয়ারিং উচ্চচাপ সিস্টেমের ওপর নির্ভর করে ঘূর্ণিঝড়ের গতি প্রকৃতি। এখন পর্যন্ত যতটুকু জেনেছি সুন্দরবনের হিরণ পয়েন্টসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় এর প্রভাব পড়ছে। বরাবরের মতো সুন্দরবনই প্রকৃতির ঢাল হয়ে কাজ করছে।’

এ আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘প্রবল ঘূর্ণিঝড় হওয়ায় ১২০-১৩০ কিলোমিটার বেগে কোথাও কোথাও ঝড় বয়ে যাবে। ‘রেমাল’ অল্প সময় পেয়েছে। ২২ মে লঘুচাপটি হওয়ার চার দিনের মাথায় ঘূর্ণিঝড় হয়ে উপকূল অতিক্রম করছে। কখনও কখনও সাগরে বেশিদিন স্থায়ী হয়ে ঘূর্ণিঝড় হলে তা আরও বেশি ভয়ংকর হতে পারে। সমুদ্রে পানির সংস্পর্শে ঘূর্ণিঝড় যত বেশি শক্তি সঞ্চয় করে, স্থলে এলেই তা দ্রুত দুর্বল হয়ে যায়।’

২০০৯ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’ এবং ২০০৭ সালের নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ও স্থলভাগে উঠে এসেছিল সুন্দরবন উপকূল দিয়ে। এর মধ্যে আইলায় বাতাসের গতি ছিল ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১২০ কিলোমিটার। আর সিডরের শক্তি ছিল তার দ্বিগুণেরও বেশি, ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার।

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশের সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় সিডরের আঘাতে মৃত্যু হয় প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষের। কিন্তু আরও বহু মানুষ বেঁচে যায় সুন্দরবনের কারণে। এই ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই ঝড়ে ভেঙে পড়ে বনের হাজার হাজার গাছপালা।
 
২০১৯ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ ও ২০২১ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ সুন্দরবনে আঘাত হানে। তবে আগের তুলনায় সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতি কম হলেও দুই ঝড়ে যথাক্রমে ২৪ ও ৭ জনের মৃত্যু ঘটে।

সবশেষ ২০২৩ সালের ৩ ডিসেম্বরে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয়েছিল ঘূর্ণিঝড় ‘মিগযাউম’, যা পরে ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ দিয়ে উপকূল অতিক্রম করে। সে ঝড়ের তেমন কোনো প্রভাব বাংলাদেশে পড়েনি।

তারও আগে গত ১৭ নভেম্বর দুপুরে ঘণ্টায় ৮৮ কিলোমিটার গতির বাতাসের শক্তি নিয়ে খেপুপাড়ার কাছ দিয়ে বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’। তাতে গাছপালা ও ফসলের ক্ষতি ছাড়াও মৃত্যু হয় ৯ জনের।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ম্যানগ্রোভ বনটি নিজে ক্ষতি সয়ে এবারও ঘূর্ণিঝড়ের ধাক্কা অনেকটাই ঠেকিয়ে দিচ্ছে। সুন্দরবনের অবস্থানটাই এমন। উপকূলভাগের কিছু গাছপালা হয়তে নষ্ট হবে। কিন্তু তারপরও যে গতিতে ঘূর্ণিঝড় আসে, সেই গতি কমিয়ে দেয় সুন্দরবন। এবারও সুন্দরবনের কারণে রক্ষা পাওয়া যাবে।

বন বিভাগের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দে’র ভাষ্য, সুন্দরবন সুরক্ষায় সরকারের নানা উদ্যোগের মধ্যে এর জীববৈচিত্র্যও আগের চেয়ে বেড়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি তো থাকেই। কিন্তু এখানকার জীববৈচত্র্যের জন্য ঘূর্ণিঝড় তো হুমকি। তবে ঝড়ের আগে ও পরে করণীয় বিষয়ে আমাদের সচেতনতা রয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা, সাম্প্রতিক সময়ের মতো সুন্দরবন এবারও নিজে রক্ষা পাবে, অন্যদেরও ঢাল হবে।

ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফিক অ্যান্ড ম্যারিটাইম ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার দাশ বলেন, ‘সুন্দরবন ঢাল হিসেবে তো কাজ করবেই। কিন্তু আমরা সুন্দরবনের অনেক ক্ষয়ক্ষতি করেছি। আগুনে পুড়ে অনেকটা জায়গা নষ্ট হল, বিভিন্ন ইনফ্রাস্টাকচার তৈরি করা হয়েছে। ঢাল হিসেবে রক্ষা না করলে তো আরও অনেক বেশি ক্ষতি হত। ফোল্ডার ভেঙে গেছে, ফোল্ডার নষ্ট- সেখানে তো সুন্দরবনের ঢাল হিসেবে কাজ করার সুযোগ নেই।’

তিনি বলেন, ‘আগুনে যে পুড়ল, সেটার জন্য কিন্তু আমাদের ভুগতে হবে। কারণ ঘুর্ণিঝড় তো বছরে দুবার হবেই। এটা মাথায় রেখে আমাদের ব্যবস্থাপনা করতে হবে। সুন্দরবনকে সুন্দরবনের মতো রাখতে হবে এবং সেটাকে মেইনটেইন করতে হবে।’

ঘূর্ণিঝড় রেমাল সম্পর্কে মোহন কুমার দাশ বলেন, ‘এটার স্পিড বেশি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা বাড়ছে। এ কারণে পশ্চিমবঙ্গের অনেক জায়গায় বন্যার অ্যালার্ট দেয়া হয়েছে। আমাদের এখানেও জলোচ্ছ্বাসের কারণে বন্যা হবে।’

বুয়েটের বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘এখন সমুদ্রের তাপমাত্রা যেভাবে বাড়ছে, তার যে প্যাটার্ন, হয়ত ঘূর্ণিঝড় এদিকে শক্তি বেশি পায়, মুভমেন্টটা সহজ হয়; গবেষণা না করে বলা যাচ্ছে না। তবে সবশেষ ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে অধিকাংশ এদিক দিয়েই যাচ্ছে। এখন খুব দ্রুত ঘূর্ণিঝড় তৈরি হচ্ছে। সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিও হচ্ছে এ কারণে।

‘ঘূর্ণিঝড় একদিনের মধ্যেই তৈরি হয়ে উপকূলে আসছে। এর মানে, সমুদ্র থেকে অনেক বেশি শক্তি পাচ্ছে। যেহেতু বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে তাপমাত্রা অনেক বেড়ে যাচ্ছে। এ কারণে সুন্দরবন এলাকায় বেশি আঘাত হানছে ঘূর্ণিঝড়।’

তিনি আরও বলেন, ‘সরকারকে আরও একটু সক্রিয় হতে হবে। সবসময় তো সুন্দরবন একা রক্ষা করবে না। অন্যান্য জায়গায়ও কিন্তু বনায়ন তৈরি করতে হবে। গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে, সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। আর একটা বন কিন্তু তৈরি করা যাবে না, শুধু বাড়ানো যেতে পারে। এজন্য কোনোভাবে যেন বনগুলো নষ্ট না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।’

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat