সপ্তাহ ব্যবধানে ফের অস্থির হয়ে ওঠেছে রাজধানীর নিত্যপণ্যের বাজার। দাম বেড়ে গেছে মাছ-মাংস ও শাক-সবজিসহ প্রায় প্রতিটি পণ্যের। এতে সাধারণ ভোক্তারা বিপাকে।
শুক্রবার (১৭ মে) সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কেরানীগঞ্জের জিনজিরা, আগানগর এবং রাজধানীর, নয়াবাজার, কারওয়ানবাজার ও হাতিরপুল কাঁচাবাজারসহ বেশ কটি বাজার ঘুরে এ চিত্র দেখা যায়।
কোরবানির ঈদের বাকি এক মাসের কিছু বেশি সময়। রোজার ঈদের আগে যেভাবে পণ্যের দাম বেড়েছিল, বর্তমানেও ঠিক একই পরিস্থিতি বাজারে।
ক্রেতাদের দাবি, প্রতিদিনই বাড়ছে কোনো না কোনো পণ্যের দাম। তার বিপরীতে কমছে না; কমলেও খুবই নগণ্য।
আনিসুল নামে এক বেসরকারি চাকরিজীবী বলেন,
রাত পোহালেই বাড়ছে কোনো না কোনো পণ্যের দাম। ভোক্তারা এখন ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন।
নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোটা যেন এক ধরনের ফ্যাশন হয়ে গেছে। কোনো একটা কিছু হলেই বেড়ে যায় পণ্যের দাম। উৎসব এলে কিংবা বৃষ্টি বা গরম হলেই দাম বাড়ানোর উৎসবে মেতে ওঠেন ব্যবসায়ীরা।
এদিকে, বিক্রেতাদের দাবি, তীব্র গরমের কারণ ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন ও সরবরাহব্যবস্থা। এতে বাজারে সরবরাহ ঘাটতি দেখা দেয়ায় দাম বাড়ছে পণ্যের।
তীব্র গরমে যখন জনজীবনে হাঁসফাঁস অবস্থা, তখন উত্তাপ বাড়ছে সবজির বাজারেও। হাতে গোনা দু-একটি ছাড়া কোনো সবজিই কেজিতে মিলছে না ৫০ টাকার নিচে।
বাজারে প্রতি কেজি বেগুন ৭০-৯০ টাকা, শসা ৪০ টাকা, করলা ৬০ টাকা, পেঁপে ৮০ টাকা, টমেটো ৫০ টাকা, পটোল ৬০ টাকা, গাজর ৫০ টাকা, ঢ্যাঁড়শ ৪০ টাকা ও কহি ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া ধুন্দল ৬০ টাকা, বরবটি ৮০ টাকা, লতি ৬০ টাকা, আলু ৫৫ টাকা, ঝিঙা ৬০ টাকা ও কাঁকরোল ৮০-১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
দাম চড়েছে কাঁচা মরিচেরও। পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ ১০০-১২০ টাকা ও খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ১৫০-১৬০ টাকায়। এছাড়া প্রতি পিস লাউ ৬০ টাকা ও চালকুমড়া বিক্রি হচ্ছে ৬০-৭০ টাকায়। আর বাজারে লালশাকের আঁটি ১৫ টাকা, পাটশাক ১৫ টাকা, পুঁইশাক ২৫ টাকা, কলমিশাক ১৫ টাকা ও পালংশাক ১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সবজি বিক্রেতারা বলছেন, সপ্তাহ ব্যবধানে প্রতিকেজি সবজিতে দাম বেড়েছে ৫-১০ টাকা পর্যন্ত। মূলত তীব্র গরমে গ্রাম পর্যায়ে সবজির দাম বাড়ায় রাজধানীর বাজারগুলোতেও এর প্রভাব পড়েছে।
রাজধানীর কারওয়ানবাজারের সবজি বিক্রেতা আনিস বলেন, তীব্র গরমে ক্ষেতে নষ্ট হচ্ছে সবজি। পাশাপাশি সেচ বাবদ বেড়ে গেছে উৎপাদন খরচ। এর প্রভাবে দাম বাড়ছে।
আর কেরানীগঞ্জের আগানগর বাজারের সবজি বিক্রেতা উজ্জ্বল জানান,
দু-একটি সবজির দাম কমলেও তা খুবই নগণ্য। তবে যেগুলোর দাম বেড়েছে, সেগুলো কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকা পর্যন্ত।
উত্তাপ ছড়াচ্ছে মসলার বাজারও। কোরবানিকে কেন্দ্র করে বাজারে দাম বাড়ছে আদা, রসুন ও পেঁয়াজ, জিরা ও এলাচসহ প্রায় প্রতিটি মসলার। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে এলাচের দাম। বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায়। আর কেজিতে ১০-৩০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে প্রতি কেজি দেশি রসুন ২০০-২২০ টাকায় ও আমদানি করা রসুনের কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৪০ টাকায়। আদা আগের বাড়তি দামেই ২২০ থেকে ২৪০ টাকায় কেজি বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া বাজারে দারুচিনি ৫০০ থেকে ৫২০ টাকা, জিরা ৭৫০ থেকে ৭৮০ টাকা, এলাচ প্রকারভেদে ৩০০০ থেকে ৩৬০০ টাকা, গোলমরিচ ৮৮০ থেকে ৯০০ টাকা, লবঙ্গ ১৬০০ থেকে ১৬৫০ টাকা, তেজপাতা ১০০ থেকে ১২০ টাকা, শুকনো মরিচ মানভেদে ৩৮০ থেকে ৪২০ টাকা আলুবোখারা ৯৯০ টাকা, কাজুবাদাম ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকা ও ধনিয়া ২০০ থেকে ২৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
যতোই কোরবানি ঘনিয়ে আসছে ততোই অস্থির হয়ে উঠছে মসলার বাজার। ছবি: বিশ্বজিৎ দাস বিজয়
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলার সংকটে আমদানি কমায় দাম বেড়েছে পাইকারি বাজারগুলোতে। যার ফলে দাম বাড়ছে খুচরা বাজারেও। আমদানি না বাড়লে কোরবানিতে দাম আরও বাড়তে পারে।
এদিকে, বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে মাংসও। প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৮০-৮০০ টাকায়। এছাড়া প্রতি কেজি খাসির মাংস এক হাজার ৫০ টাকা থেকে এক হাজার ২০০ টাকা ও ছাগলের মাংস বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার টাকায়।
আর প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ২২০-২৩০ টাকা, সোনালি মুরগি ৩৮০-৪০০ টাকা, দেশি মুরগি ৭২০-৭৫০ টাকা, সাদা লেয়ার ২৯০ টাকা ও লাল লেয়ার বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ টাকায়। এছাড়া জাতভেদে প্রতি পিস হাঁস বিক্রি হচ্ছে ৬০০-৭০০ টাকায়।
প্রতিকেজি সোনালি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৩৮০-৪০০ টাকায়। ছবি: বিশ্বজিৎ দাস বিজয়
বিক্রেতারা জানান, গরমে মুরগি মরার প্রভাব পড়েছে বাজারে, যে কারণে দাম বাড়ছে। রাজধানীর কারওয়ানবাজার কিচেন মার্কেটের মামা ভাগিনা চিকেন ব্রয়লার হাউসের ব্যবসায়ী মো. দিদার হোসেন বলেন,
তীব্র গরমে খামারে প্রচুর মুরগি মারা গেছে। এতে বাজারে সরবরাহ সংকট তৈরি হয়েছে। যার ফলে বাড়ছে ব্রয়লার ও সোনালিসহ অন্যান্য মুরগির দাম।
ঊর্ধ্বমুখী ডিমের দামও। সপ্তাহ ব্যবধানে রাজধানীতে ডজনে ৩০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে মুরগির প্রতি ডজন লাল ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকা, আর সাদা ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৪৫ টাকায়। আর প্রতি ডজন হাঁসের ডিম ২০০ টাকা ও দেশি মুরগির ডিম ২৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
মুরগির প্রতি ডজন লাল ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায়। ছবি: বিশ্বজিৎ দাস বিজয়
বিক্রেতারা জানান, তীব্র গরমে মরে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে অনেকেই আগেভাগে বিক্রি করে দিচ্ছেন মুরগি। এতে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। এর প্রভাব পড়ছে ডিমের দামেও।
স্বস্তির খবর নেই মাছের বাজারেও। ক্রেতারা মাছ কিনতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন। নদী ও হাওড়ের মাছ সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে গেছে অনেক আগেই। চাষের মাছও এখন বেশ চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে।
বাজারে প্রতি কেজি তেলাপিয়া ২০০-২২০ টাকা, চাষের পাঙাশ ১৮০-২৩০ টাকা, চাষের শিং ৫৫০ টাকা, চাষের মাগুর ৬০০ টাকা ও চাষের কৈ বিক্রি হচ্ছে ২৮০-৩০০ টাকায়। এছাড়া আকারভেদে প্রতি কেজি রুই ৩৮০ থেকে ৪৫০ টাকা, কাতলা ৪০০ থেকে ৪৮০ টাকা, কোরাল ৭৫০ টাকা, টেংরা ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা, বোয়াল ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা ও আইড় ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর প্রতি কেজি ইলিশের জন্য গুনতে হচ্ছে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত।
রাজধানীর কারওয়ানবাজারের মাছ বিক্রেতা আসলাম জানান, এ বছর বৃষ্টি কম হয়েছে। আর গরমের কারণে মাছ কম ধরা পড়ছে। এতে কমছে না মাছের দাম।
নিত্যপণ্যের অস্থির বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ের দাবি ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েরই। ক্রেতারা বলছেন, নিয়মিত বাজার মনিটরিং করা হয় না। এতে বিক্রেতারা ইচ্ছেমতো দাম বাড়ানোর সুযোগ পায়।
আর বিক্রেতারা বলেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ইচ্ছেমতো দাম বাড়াচ্ছে। বাজারে নিয়মিত অভিযান চালালে অসাধুদের দৌরাত্ম্য কমবে।