×
  • প্রকাশিত : ২০২৪-০৫-১৪
  • ৫৬ বার পঠিত
বাংলামোটরের টাইলস মার্কেটে টাইলস লোড-আনলোডিংয়ের কাজ করেন আব্দুল কাদের। দুপুরের খাবার সারছিলেন স্থানীয় একটি চায়ের টং দোকানে। পাউরুটি, কলা আর চা দিয়ে।

নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে সবখানে। এমনকি রাজধানীর হোটেল রেস্তোঁরাগুলোতেও। সেখানে খাওয়ার খরচও বেড়ে গেছে অনেকটাই, যার ফলে আব্দুল কাদের দুপুরে হোটেলে ভাত খাওয়া বাদ দিয়েছেন বেশ কিছুদিন হলো। কারণ গলির কিংবা ফুটপাতের হোটেলে একবেলা ভাত খেতেও এখন খরচ হয় ন্যূনতম ৮০ থেকে ১শ টাকা।  সকালে বাড়ি থেকে ভাত খেয়ে কাজের উদ্দেশে বের হন। দুপুরের খাবার সারেন এই পাউরুটি-কলা দিয়েই। তবে তাতেও তার খরচ হচ্ছে ৩৫ টাকা। পাউরুটি ১৫, মাঝারি সাইজের একটি কলা ১০ আর এক কাপ কনডেন্সড মিল্কের চা দশ টাকা। 
 
যদি এর সঙ্গে আর একটি মাত্র কলা কিংবা সিগারেট-পান যুক্ত হয় তাহলে খরচ দাঁড়ায় অর্ধশত টাকার কাছাকাছি। অথচ সারা দিন কাজ করে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় হয় আব্দুল কাদেরের। বর্তমান বাজার দরে এই টাকায় স্ত্রী ও তিন সন্তানের তিন বেলা খাবার খরচ চালানোসহ অন্যান্য খরচ চালানো কতখানি সম্ভব তা বুঝিয়ে বলার হয়তো দরকার নেই। সেই কারণেই পেটের ক্ষুধা পেটে চেপে রেখেই পাউরুটি-কলা দিয়েই দুপুরের খাবার সারতে হয় আব্দুল কাদেরকে।
 
আর এই যে দিনের পর দিন পেট ভরে খাবার থেকে বঞ্চিত হওয়ার ছাপ যেন ফুটে উঠছে আব্দুল কাদেরের পুষ্টিহীন শরীরে। যেখানে চর্বি নেই এক ফোঁটাও, হাড়ের ওপর মাংস কতখানি সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ। শরীরে যে পর্যাপ্ত আমিষ জোটে না তার লক্ষণও সুস্পষ্ট। টাইলস অত্যন্ত ভারী পণ্য, তাই এর লোডিং-আনলোডিংয়ের কাজও কঠোর পরিশ্রমসাধ্য। 
 
রাজধানীর বর্তমান গরম আবহাওয়ায় এই ধরনের কষ্টসাধ্য পরিশ্রমের পর স্বাভাবিকভাবেই দুপুরে আব্দুল কাদেরের মতো দিনমজুরের পেটের চাহিদা দুমুঠো ভাত। হয়তো বা একটা ডিম অথবা এক টুকরো মুরগির মাংস। কিন্তু বর্তমানের দুর্মূল্যের বাজারে তাও জুটছে না আব্দুল কাদেরের মতো মজদুরদের পেটে। জানালেন, বাচ্চাদের জন্য একদিন আগে ডিম কিনেছিলেন চারটি, দাম নিয়েছে ৫০ টাকা। আক্ষেপ করে জানালেন, বাচ্চাদের একটু বড় মাছ বা মাংস তো দূরের কথা, এমনকি ডিমও ঠিকভাবে খাওয়াতে পারেন না তিনি।
 
বর্তমান মূল্যস্ফীতি ও বাজার দর পরিস্থিতি কতটা অসহনীয় হয়ে চেপে বসেছে দেশের নিম্নআয়ের দরিদ্র মানুষের পিঠের ওপর, তার একটি উদাহরণ হলো হাড় জিরজিরে শরীরের এই দিনমজুর আব্দুল কাদের। বর্তমান মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি যেন তার শরীর থেকে শুষে নিচ্ছে জীবনীশক্তির শেষ ফোঁটাটুকুও। এই চিত্র শুধু আব্দুল কাদেরেরই নয়, নীলফামারী থেকে ঢাকায় রিকশা চালাতে আসা গফুর মিয়া, রংমিস্ত্রির কাজ করা সামাদ ঢালী, সবারই পরিস্থিতি একই। হোটেলে খাওয়ার খরচ বেশি হওয়ায় তারা সবাই দুপুরের খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন ভাত।
 
এতো গেল নিম্নবিত্তদের চিত্র। কিন্তু এই মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা কতটা পিষ্ট হচ্ছেন তার চিত্র চোখে পড়লো রাজধানীর কারওয়ানবাজার ও হাতিরপুর বাজার ঘুরে।
 
দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে মধ্যবিত্তের
 
কারওয়ানবাজারে কথা হয় রাজধানীর একটি থানায় কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক উপপরিদর্শকের (এসআই) সঙ্গে। জানালেন পুলিশের আয় সম্পর্কে মানুষের অনেক নেতিবাচক ধারণা থাকলেও, সবার ক্ষেত্রেই এই ধারণাটা সত্য নয়। পুলিশের সবাই ‘উপরি’ খায় না। বেতনের টাকায় তিন সন্তান নিয়ে ঢাকায় পরিবার নিয়ে থাকতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। বেতন ও রেশন যা পান তা দিয়ে বাচ্চাদের পড়াশোনা, কোচিংয়ের খরচসহ অন্যান্য খরচ মেটানোর পাশাপাশি খাদ্যপণ্যের খরচ অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় তাদের একটু ভালোমন্দ খাওয়ানোও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে তার জন্য। জানালেন, প্রতি বছর বেতন যে পরিমাণ বাড়ে, পণ্য আর অন্যান্য খরচ বাড়ে তার থেকে কয়েক গুণ বেশি।  যার সাথে পাল্লা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।
 
কারওয়ানবাজারের মুরগি পট্টি থেকে ব্রয়লার মুরগি কিনছিলেন নাসিমা আক্তার ও মায়া বেগম নামের দুইজন মধ্যবয়সি নারী। জানালেন, বাজার দর এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে স্কুলপড়ুয়া বাচ্চাদের মুখে একটু বাড়তি পুষ্টিকর খাবার তুলে দেয়াও কঠিন হয়ে হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের জন্য। পাকিস্তানি কক মুরগি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৪শ টাকায়। ব্রয়লার ২২০ টাকায়। আগে বাচ্চাদের কক মুরগি খাওয়ালেও এখন সামর্থ্যের বাইরে চলে যাওয়ায় ব্রয়লার মুরগি খাওয়াচ্ছেন। বাড়ন্ত বাচ্চাদের শরীরে প্রয়োজন হয় ডিম ও দুধসহ অন্যান্য পুষ্টিকর খাবারের। কিন্তু তাও দেয়াটা সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে তার জন্য। শুধু খাবারের দামই নয়, ওষুধের দামও নাগালের বাইরে চলে গেছে বলে জানালেন নাসিমা আক্তার। বাধ্য হয়ে ওষুধ খাওয়াও কমিয়ে দিয়েছেন তিনি। বেড়েছে বাচ্চাদের বইপত্র, কাগজসহ পড়াশোনার জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য পণ্যের দামও। এর সঙ্গে টিউশনি কোচিংয়ের বাড়তি খরচ তো আছেই।
 
বাজেট কাটছাঁট করছেন উচ্চমধ্যবিত্তরাও
 
শুধু নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তই নয়, মূল্যস্ফীতিতে নাকাল মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তরা। রাজধানীর হাতিরপুল, অ্যালিফ্যান্ট রোড এলাকা মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তদের আবাসস্থল হিসেবেই পরিচিত। হাতিরপুল কাঁচাবাজারও রাজধানীর ‘অভিজাত’ কাঁচাবাজার হিসেবেই পরিচিত, যেখানে সব পণ্যের দামই একটু চড়া।
 
সেখানে কথা হলো এক আয়কর আইনজীবীর (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) সঙ্গে। বাজার পরিস্থিতি কি জানতে চাইলে প্রৌঢ় এই আয়কর আইনজীবী দেখালেন তার হাতের একটি ব্যাগে থাকা কেজি দু-এক মিষ্টি আলুর দিকে। জানালেন দুই ছেলের পরিবার, নাতিরাসহ তার পরিবারের সদস্য ১১ জন। সবাই মিলে বিকেলের নাস্তায় তার খরচ হয় কয়েকশ টাকা। তবে মূল্যস্ফীতির কারণে বিকেলের এই নাস্তায় কাটছাঁট করতে হচ্ছে তাকে। দুই কেজি মিষ্টি আলু কিনেছেন, নাস্তা হিসেবে খাওয়া হবে এটাই। অথচ মোটামুটি স্বচ্ছল জীবনই যাপন করে এসেছেন এই আইনজীবী। ব্যক্তিগত গাড়িও রয়েছে তার। কিন্তু দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে চাপে পড়েছেন তিনিও। ভালো নেই তার গ্রাহকরাও। সবারই ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি চাপের মুখে।
 
খাদ্য মূল্যস্ফীতি অতিক্রম করেছে ডাবল ডিজিট

কারওয়ানবাজার থেকে হাতিরপুল বাজার সবখানেই দেখা গেল নিত্যপণ্যের দামের বেপরোয়া ঊর্ধ্বগতি। ডিম, মুরগি, মাছ, মাংস, কাঁচাবাজার ফলমূল সব পণ্যের দামই সাধারণ মানুষের কেনার পক্ষে কষ্টসাধ্য।  দেশের মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রতি মাসেই তথ্য উপাত্ত প্রকাশ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছর ধরেই মূল্যস্ফীতি প্রায় ডাবল ডিজিটের কাছাকাছি, দশ শতাংশ ছুঁই ছুঁই। সর্বশেষ এপ্রিল মাসেও মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ বলে উঠে আসে তাদের প্রতিবেদনে। সার্বিক মূল্যস্ফীতি এখনও দুই অংকের ঘর অতিক্রম না করলেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি এরমধ্যেই অতিক্রম করেছে ডাবল ডিজিট। বিবিএসের হিসাবে সবশেষ এপ্রিল মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ২২ শতাংশে।
 
অপরদিকে বিবিএসের দেয়া তথ্যের বিপরীতে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বর্তমানে ১৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছে দেশের অপর সরকারি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা বিআইডিএস। গত ১০ মে একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশ বলে জানান বিআইডিএস মহাপরিচালক বিনায়ক সেন। এক বছরে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে মাছের দাম, প্রায় ২০ শতাংশ; এরপর বেড়েছে মুরগিসহ পোল্ট্রিপণ্যের দাম। বিবিএসের তথ্য পর্যালোচনা করে এবং বিআইডিএসের নিজেদের উদ্যোগে সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে খাদ্য মূল্যস্ফীতির এই চিত্র উঠে এসেছে বলে জানান বিনায়ক সেন।
 
শঙ্কা বাড়াচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন বিনিময় হার
 
এদিকে সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানেরই জরিপে যেখানে উঠে এসেছে খাদ্য মূল্যস্ফীতির এই ঊর্ধ্বমুখী উল্লম্ফনের চিত্র, ঠিক তখনই যেন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দাঁড়িয়েছে সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সংঘটিত টাকার সবচেয়ে বড় অবমূল্যায়ন। গত ৮ মে এক লাফে ডলারের বিপরীতে টাকার দাম সাত টাকা বাড়িয়ে ১১৭ টাকায় নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে দীর্ঘদিন ডলারের বিপরীতে টাকার দর ১১০ টাকায় বেঁধে রেখেছিলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মূলত আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা আইএমএফের চাপেই বাংলাদেশ ব্যাংকের এই পদক্ষেপ বলে মনে করা হচ্ছে।  বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের শর্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নমনীয় করতে সরকারকে চাপ দিয়ে আসছিলো। এক লাফে ডলারের দাম ৭ টাকা বাড়ানোর প্রেক্ষিতে ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানিনির্ভর দেশ হওয়ায় আমদানি খরচ বেড়ে যাবে, পণ্যের দাম বাড়বে। আমদানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ফলে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে। চাপ বাড়বে সাধারণ মানুষের ওপর।
 
বাজেটে মূল্যস্ফীতি হ্রাসকে গুরুত্ব দিতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা

দেশের মূল্যস্ফীতি ও আর্থিক খাতের এই শঙ্কাজনক পরিস্থিতির মধ্যেই আর মাত্র অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই উপস্থাপন হতে যাচ্ছে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট। দেশের বর্তমান মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে খাদ্যপণ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামকে সাধারণ জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার বিষয়টিকে জোর দিয়ে সরকারের প্রতি আগামী বাজেট প্রণয়নের পরামর্শ দিলেন বিশেষজ্ঞরা। এ জন্য প্রয়োজনে খাদ্যপণ্যের আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহারসহ সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতায় আরও বেশি সংখ্যক মানুষকে খাদ্য নিরাপত্তার আওতায় নিয়ে আসা এবং প্রয়োজনে খাদ্যের রেশনিং কার্যক্রম চালুর ওপর জোর দেন তারা।
 
এ ব্যাপারে বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বলেন, খাদ্য মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে আগামী বাজেটে এনিমেল ফিড, পোল্ট্রি হ্যাচারির কাঁচামাল ইত্যাদির ওপর যেন ট্যারিফ আরোপ না করা হয় সে ব্যাপারে সরকারকে দৃষ্টি দিতে হবে। এর প্রভাব কিছুটা হলেও মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতির ওপর পড়বে।
  
তিনি বলেন, চালের দাম মোটামুটি স্থিতিশীল থাকলেও পোল্ট্রিপণ্য, মাছ কিংবা মাংসের ক্ষেত্রে কিন্তু বলা যাবে না। এ পরিস্থিতিতে বর্তমানে এসব পণ্য কিংবা এগুলো উৎপাদনের কাঁচামালের ওপর বর্তমানের যে ট্যারিফ পলিসি রয়েছে তা সরকারকে পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। এতে হয়তো এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের কিছুটা ক্ষতি হবে, তবে তা রফতানিতে নগদ প্রণোদনা বন্ধ করে দেয়ার মাধ্যমে পুষিয়ে নেয়া যাবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, যেহেতু ডলার এখন ১১৭ টাকা হয়েছে, সেক্ষেত্রে রফতানিকারকদের আর নতুন করে ক্যাশ ইনসেনটিভ দেয়ার প্রয়োজনীয়তার কোন কারণ তিনি দেখছেন না। এই টাকাটা ট্যারিফ হ্রাসের মাধ্যমে যে রাজস্বের ক্ষতি হবে তা দিয়ে সহজেই পুষিয়ে নেয়া যাবে।
 
মূল্যস্ফীতি কমাতে প্রাইস কমিশন গঠনের পরামর্শ

অপরদিকে দেশের নিম্নবিত্ত ও দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় নিয়ে আসার পাশাপাশি বিদেশি ডলার পাচার প্রতিরোধে কার্যকর ও দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানালেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এম এম আকাশ। এছাড়া নিত্যপণ্যের দাম নির্ধারিত করে দেয়ার জন্য আলাদা প্রাইস কমিশন গঠন করে সেখানে গণশুনানির মাধ্যমে নিত্যপণ্যের মূল্য নির্ধারণেরও পরামর্শ দেন তিনি।
 
তিনি বলেন, যারা নির্ধারিত আয়ে চলে অর্থাৎ স্যালারি ক্লাস এবং যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছেন অর্থাৎ নিম্নবিত্ত; সব মিলিয়ে সমাজের নিচের অন্তত ৪০ শতাংশ মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা বিশেষ করে খাদ্য নিরাপত্তা জালের আওতায় আনতে হবে। শহরগুলোতে ট্রাকসেলের মতো যে সব রেশনিং ব্যবস্থা আছে সেগুলোকে আরও বিস্তৃত করতে হবে।
 
পাশাপাশি বাজারে সিন্ডিকেটের প্রভাব ভেঙ্গে দিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীদের হাত থেকে সাধারণ ভোক্তাদের রক্ষা করতে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সরকারকে বাজারে এমন সিগন্যাল দিতে হবে যেন সবাই বুঝতে পারে সরকার এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে রয়েছে।
 
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে কঠোরভাবে দেশের বাইরে ডলার পাচার প্রতিরোধে কাজ করতে হবে উল্লেখ করে ড. এম এম আকাশ বলেন, বিদেশে ডলার পাচার প্রতিরোধ করতে না পারলে মূল্যস্ফীতি কখনই সামাল দেয়া সম্ভব হবে না। পাশাপাশি টাকার আরও অবমূল্যায়ন করতে বাধ্য হতে হবে। যে কোন মূল্যেই সরকারকে ডলার দেশে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
 
পাশাপাশি দেশে যারা বিভিন্নভাবে অবৈধ আয় করছে, সিন্ডিকেটবাজি করছে, নীতিভঙ্গ করছে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় না দেখে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণেরও পরামর্শ দেন এমএম আকাশ। তিনি বলেন, আইনভঙ্গকারী শীর্ষ রাজনীতিক কিংবা আমলাকে যদি শাস্তি দেয়া যায়, তবে জনগণের মাঝেও সরকারের আন্তরিকতার ব্যাপারে আস্থা ফিরে আসবে।
 
এম এম আকাশ বলেন, বাজারে পণ্যের দাম নিয়ে যে অরাজকতা তৈরি হচ্ছে তা প্রতিরোধে একটি প্রাইস কমিশন গঠন করতে হবে। যারা স্বচ্ছতার সঙ্গে ট্যারিফসহ অন্যান্য দিক বিবেচনা করে গণশুনানির মাধ্যমে বাজারে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করবে ।
 
ভুগতে হচ্ছে সময়মতো সুদের হার না বাড়ানোর ফল
 
অপরদিকে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের ওপর মূল্যস্ফীতির যে চাপ তা নিরসন করার একটাই উপায় তা হলো, মূল্যস্ফীতি কমানো। গত বছরের মূল্যস্ফীতির প্রধান কারণ ছিল ডলার সংকট। এর কারণে পণ্যের আমদানি হ্রাস পাওয়া, আমদানি হ্রাসের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হওয়া, আর উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার কারণে বাজারে সরবরাহ কমে যাওয়া। এজন্য ডলার সংকট নিরসণ করতে হবে। এতে আমদানির ওপর নিয়ন্ত্রণ কিছুটা শিথিল হবে। ফলে বাজারে পণ্যের সরবরাহ বাড়বে। পাশাপাশি সুদের হার সময়মতো না বাড়ানোর প্রভাবও পড়েছে বর্তমান মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতির ওপর। 
 
তিনি বলেন, যখন মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছিলো তখন বহু মাস সুদের হার বাড়ানোর কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বরং ‍উল্টোটা করা হয়েছে, টাকা ছাপিয়ে বাজেটে সহায়তা করা হয়েছে। যেহেতু সুদের হার বৃদ্ধি করার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেরিতে পদক্ষেপ নিয়েছে, তাই বর্তমান অবস্থায় কষ্ট হলেও এই অবস্থানে থাকতে হবে এবং টাকা ছাপানো বন্ধ করতে হবে।
 
সব মিলিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে বাজার ব্যবস্থাপনা, ডলার সংকট নিরসন আর সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতি- এই তিনটি বিষয়ে জোর দিতে হবে বলে উল্লেখ করেন বিশ্বব্যাংকের এই সাবেক অর্থনীতিবিদ। পাশাপাশি আগামী বাজেটে যেন গত বাজেটের মতো পরোক্ষ কর বসানো না হয় সে ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এর ফলে বিভিন্ন পণ্যের দাম আবার বেড়ে যেতে পারে।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat