নাটোরের লালপুর উপজেলার মোহরকয়া ভাঙ্গাপাড়া গ্রামের এক যুবক কৌশলে সামাজিক যোগাযোগের মোবাইল অ্যাপ ইমোর বিভিন্ন নম্বর হ্যাক করে আসছিলেন। এ ঘটনায় করা মামলার রায়ে গত ২৭ মার্চ রাজশাহী সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালত রাজু আহমেদ (২৭) নামের এই হ্যাকারকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেন। একই সঙ্গে তাঁকে পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড করা হয়।
এ ব্যাপারে রাজশাহী সাইবার ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ইসমত আরা জানান, রাজু নারী সেজে ইমোতে একটি অ্যাকাউন্ট খোলেন।
এর মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের এক নারী ও তাঁর প্রবাসী ভগ্নিপতির ইমো অ্যাকাউন্ট হ্যাক করেন রাজু। আইডি ফিরিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে তিনি ২০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন।
এ ঘটনায় ভুক্তভোগী নারী ২০২২ সালের ১৪ ডিসেম্বর সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। বিষয়টি তদন্তে নাটোর পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে পাঠানো হয়।
পুলিশ তদন্ত করে আসামির পরিচয়ের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর ২০২৩ সালের ১৩ মার্চ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। এ ঘটনায় সেদিনই পুলিশ বাদী হয়ে রাজুর বিরুদ্ধে লালপুর থানায় একটি মামলা করে। এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে রায় ঘোষণা করা হয়।
জয়পুরহাটের পাঁচবিবি এলাকার সনাতন ধর্মাবলম্বী এক নারীর (৪০) ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে অশ্লীল ছবি ও ভিডিও ছেড়ে দেওয়া হয়।
এ ঘটনায় গত বছরের ১২ মে ওই নারী পাঁচবিবি থানায় অভিযোগ করেন। এটি মামলা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। তদন্তে পাঁচবিবি থানা রাজশাহী মহানগর পুলিশের (আরএমপি) সাইবার অপরাধ ইউনিটের সহযোগিতা কামনা করে। সাইবার ইউনিট ফেসবুক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে জড়িতকে শনাক্ত করে। পরে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
মামলাটি এখন বিচারাধীন।
এর আগে গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পৃথক মামলার রায়ে দুজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডের আদেশ দেন রাজশাহী সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালত। পাবনা সদরের রামানন্দপুর গ্রামের মোকছেদ মোল্লার ছেলে কাউসার উদ্দিনকে (৪১) তিন বছর এবং পাবনার আমিনপুরের দুর্গাপুর দক্ষিণচর এলাকার আব্দুল বারিক মল্লিকের ছেলে সাগর আহম্মেদকে (২৫) এক বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তার ল্যাপটপ থেকে তথ্য পাচারের দায়ে কাউসারকে অভিযুক্ত করা হয়।
রাজশাহী বিভাগীয় সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালত সূত্র মতে, রাজশাহীতে ফেসবুক, অনলাইন, ইউটিউব, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে বিভিন্ন অপরাধমূলক ঘটনার হার ব্যাপক বেড়েছে।
ওই আদালতের সরকারি কৌঁসুলি ইসমত আরা বলেন, ‘দুই বছর আগেও আদালতে যেখানে গড়ে প্রতিদিন একটি-দুটি করে মামলা আসত, এখন গড়ে তিন-চারটি করে মামলা আসছে। প্রতিদিন ছয়-সাতটি মামলা আদালতে উঠছে। এতে সাইবার অপরাধের ঘটনা দিন দিন বাড়ছে বলে ধরে নেওয়া যায়। তবে আদালতে মামলাজট নেই।’
রাজশাহীর পবা এলাকার রাফসান জনি নামের এক শিক্ষার্থীর ফেসবুক হ্যাক করে অশ্লীল ছবি ব্যবহার করে চাঁদা দাবি করে প্রতারকচক্র। এ ঘটনায় জনি গত বছরের ৩১ মার্চ পবা থানায় মামলা করেন। এর ভিত্তিতে আরএমপির সাইবার ইউনিট ঘটনার তদন্ত করে চক্রকে শনাক্ত করে।
গত বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী সৌরভের বিকাশ নম্বর হ্যাক করে ৭০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় একটি প্রতারকচক্র। এ ঘটনায় সৌরভ মতিহার থানায় মামলা করেন। পরে আরএমপির সাইবার ইউনিট দোষীদের শনাক্ত ও টাকা উদ্ধার করে।
আরএমপির সাইবার ইউনিটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার উৎপল কুমার বলেন, ‘সাইবার অপরাধ আগের চেয়ে বেড়েছে। আরএমপির সাইবার ইউনিটে রাজশাহীসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে গড়ে প্রতিদিন পাঁচ-সাতটি অপরাধের অভিযোগ আসে। আড়ালে থাকা এসব অপরাধীকে শনাক্ত করা আমাদের কাজ। এ কাজে বাড়তি সতর্কতার সঙ্গে আমাদের কয়েকটি ধাপ পেরোতে হয়।’
উৎপল কুমারের তথ্য মতে, গত বছর আরএমপির সাইবার ইউনিটে অভিযোগ ছিল তিন হাজার ২৪৪টি। এতে শুধু সাইবার অপরাধসংক্রান্ত অভিযোগ ৮৮৮টি। অনলাইন, ফেসবুক, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ, ই-মেইলসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের অভিযোগ ৫০৭টি। সাইবার ইউনিট ৪৮৫টি অভিযোগের তদন্ত সম্পন্ন করে। এ ছাড়া নগদ, বিকাশ ও রকেটের মাধ্যমে প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আসে ৩৮১টি। এর মধ্যে ৩৫৭টির তদন্ত সম্পন্ন হয়। ২০২২ সালে এই ইউনিটে অভিযোগ জমা হয় তিন হাজার ৬৮৩টি। এর মধ্যে সাইবারসংক্রান্ত অভিযোগ ৭৮০টি। এসব অভিযোগের মধ্যে ফেসবুক, অনলাইন, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ, ই-মেইলসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের অভিযোগ ৪৪৭টি। নগদ, বিকাশ ও রকেটের মাধ্যমে প্রতারণার অভিযোগ ৩৩৩টি।
উল্লিখিত দুই বছরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২২ সালের চেয়ে ২০২৩ সালে সাইবার অপরাধের ঘটনা শতাধিক বেড়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত অভিযোগ জমা পড়েছে ৩৫০টির মতো।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আনিসুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে রাজশাহী বিভাগে যেসব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, এর মধ্যে বেশি দেখা যাচ্ছে সাইবার অপরাধ। বিশেষ করে ফেসবুকের মাধ্যমে বা অনলাইনে প্রতারণার ঘটনা ব্যাপক বেড়েছে। তবে এসব অপরাধীকে দমনে পুলিশের জোরালো তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।’
এ জাতীয় আরো খবর..