শিল্প উৎপাদনে বড় ভূমিকা রাখে বিদ্যুৎ ও গ্যাস। চাহিদা মেটাতে আমদানি করা হলেও ডলার সংকটে বিদ্যুতের কাঁচামাল গ্যাস আমদানিতে ভাটা পড়েছে। যার ফলে সরবরাহ সংকটে দেশের শিল্প উৎপাদনে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। এতে করে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) গ্যাস-বিদ্যুতের অবদানও কমেছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) জিডিপিতে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সরবরাহের প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে ০.৩১ শতাংশে। যেটি আগের বছরের একই সময়েও ছিল ২.৯৯ শতাংশ। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) যে প্রান্তিক হিসাব দিয়েছে, তাতে এ চিত্র উঠে এসেছে।
দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ খাতের অবদান কমায় প্রভাব পড়েছে শিল্প ও উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধিতেও।
উৎপাদন থমকে গেছে। শুধু থমকে যাওয়াই নয়, সেটি এখন ঋণাত্মক ধারায় ঠেকেছে। দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) এ খাতের প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক ০.৪৫ শতাংশ, যেটি আগের প্রান্তিকেও ছিল ১১.৬ শতাংশ। এটি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে ছিল ১০.৮৮ শতাংশ।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে শিল্পের প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে কম। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে শিল্পের প্রবৃদ্ধি কমে ৩.২৪ শতাংশে নেমেছে, যা দুই বছর আগেও ছিল ১৪ শতাংশের বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়েও এ খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ শতাংশ। তবে প্রবৃদ্ধি কমলেও চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে শিল্প খাতের মূল্য সংযোজন বেড়ে তিন লাখ ১২ হাজার ১০৭ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। আগের প্রান্তিকে তা ছিল দুই লাখ ৮৭ হাজার ৬৯৪ কোটি টাকা।
অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে এ খাতের মূল্য সংযোজন বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা। শিল্প খাতের উপখাত রয়েছে চারটি। এর মধ্যে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সরবরাহ একটি। সর্বশেষ অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে এ খাতের মূল্য সংযোজন ৯ হাজার ১৫৯ কোটি টাকা। অথচ তিন মাস আগেও এ খাতের মূল্য সংযোজন ছিল ১১ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে এ খাতের মূল্য সংযোজন কমেছে দুই হাজার ১৩৮ কোটি টাকা।
কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের ১১টি উপখাত দিয়ে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) হিসাব গণনা করা হয়। বিবিএস বলছে, চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক অক্টোবর-ডিসেম্বরে সব মিলিয়ে কলকারখানার উৎপাদন থেকে এক লাখ ৯৯ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা অর্থনীতিতে যুক্ত হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই প্রান্তিকে ছিল দুই লাখ ৭৭৫ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে কলকারখানা উপখাত থেকে অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন কমেছে ৯০০ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলের বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক এবং জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জ্বালানি আমদানি কমানোর প্রভাব জিডিপির প্রবৃদ্ধি ও শিল্পের পণ্য উৎপাদনসহ নানা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর পড়ছে। তাই কোনোভাবেই ডলার সাশ্রয় করতে গিয়ে জ্বালানি আমদানি কমানোর সুযোগ নেই। ডলার সাশ্রয় করতে হলে অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি সীমিত করা যেতে পারে। জ্বালানি আমদানি ব্যাহত হলে জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে প্রভাব পড়বেই। তাই এ বিষয়টি সরকারকে গুরুত্ব দিয়ে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
আন্তর্জাতিক বাজারে শিল্পের কাঁচামালের দাম অনেক কমে এলেও এর সুবিধা নিতে পারেনি দেশের শিল্প-কারখানাগুলো। জ্বালানিসংকট ও আমদানি সীমাবদ্ধতার কারণে শিল্প তার সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারছে না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডলারের উচ্চমূল্য। এমন নানা সংকটের মুখে শিল্পের প্রবৃদ্ধি তলানিতে নেমে এসেছে। যে শিল্পের ওপর ভর করে দেশের জিডিপি এগিয়ে যাচ্ছিল তা এখন নিম্নমুখী।
দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে সেবা খাত। এরপরই শিল্প খাতের অবস্থান। গত কয়েকটি অর্থবছরে অর্থনীতিতে শিল্পের অবদান ধারাবাহিকভাবে বাড়ছিল। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপিতে শিল্পের অবদান ছিল ৩৭.৬৫ শতাংশ। জিডিপিতে এক-তৃতীয়াংশের বেশি অবদান রাখা এ খাতের প্রবৃদ্ধি মারাত্মক হারে হ্রাস পাওয়ায় কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
শিল্প খাতের মধ্যে উৎপাদন খাতের প্রাণ হলো দেশের ৪৬ হাজারের বেশি ছোট-বড় কলকারখানা। এসব কলকারখানার মূল জ্বালানি হলো বিদ্যুৎ ও গ্যাস। চাহিদা অনুযায়ী, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সরবরাহ না থাকায় উৎপাদন খাত এরই মধ্যে নেতিবাচক অবস্থানে চলে গেছে। দ্বিতীয় প্রান্তিকে উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক ০.৪৫ শতাংশ। বিভিন্ন সংকটের মধ্যেও এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৩৬.৯২ শতাংশ, ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ৩৬.০১ শতাংশ। এর মধ্যেই বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)।
এ জাতীয় আরো খবর..