গাজীপুর মহানগরের গাছা থানার দক্ষিণ খাইলকুর এলাকা থেকে এক শিক্ষক দম্পতির লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরে প্রাইভেট কারের ভেতর থেকে তাঁদের লাশ উদ্ধার করা হয়। শিক্ষক দম্পতি জিয়াউর রহমান মামুন (৫১) এবং তাঁর স্ত্রী মাহমুদা আক্তার জলির (৩৫) লাশ উদ্ধারের সময় প্রাইভেট কারের দরজার লক খোলা ছিল।
মামুন গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গী বিসিক এলাকার শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এবং জলি টঙ্গীর বাজার এলাকার আমজাদ আলী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা ছিলেন।
নিহত দম্পতির বাসা নগরীর গাছা থানার দক্ষিণ খাইলকুরের বগারটেক এলাকায়। মামুনের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ত্রিশালে। তসিফুর রহমান মেরাজ (২৩) নামে তাঁদের একটি ছেলে রয়েছে।
বুধবার সন্ধ্যা থেকে নিখোঁজ ছিলেন এই শিক্ষক দম্পতি। কার থেকে লাশ উদ্ধারের সময় দুজনের মুখ থেকে ফেনাযুক্ত লালা ঝরছিল। কারের ভেতর তাঁদের মোবাইল ফোন, প্রায় দেড় লাখ টাকা এবং প্রায় তিন ভরি স্বর্ণালংকার থাকলেও সেসব খোয়া যায়নি। পুলিশ বলছে, এই মৃত্যু রহস্যে ঘেরা। তবে পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, বিষাক্ত খাবার খাইয়ে পরিকল্পিতভাবে তাঁদের হত্যা করা হয়েছে। এ নিয়ে দেখা দিয়েছে অনেক প্রশ্ন।
শিক্ষক দম্পতির সন্তান গণবিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি সায়েন্স বিভাগের তৃতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী তসিফুর রহমান মেরাজ জানান, আলাদা স্কুলে চাকরি করলেও তাঁর মা-বাবা প্রতিদিন একসঙ্গে নিজেদের প্রাইভেট কারে যাওয়া-আসা করতেন। বুধবার স্কুলের কাজ সেরে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে মামুন স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন। কারটি তিনি নিজেই চালাচ্ছিলেন।
ওই সময় তাঁদের সঙ্গে গাড়িতে ছিলেন সহকর্মী ও সম্পর্কে মামাতো ভাই মো. কামরুজ্জামান। পথে তাঁকে নামিয়ে দেন মামুন। কামরুজ্জামান গণিতের সহকারী শিক্ষক।
মেরাজ আরো জানান, স্কুল থেকে রওনা দেওয়ার আগে অফিসকক্ষে বসে তাঁর মা-বাবা কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে চা ও মিষ্টি খেয়েছেন। বুধবার সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে মেরাজ প্রথমে বাবাকে ফোন দেন। ফোন না ধরায় পরে মাকে ফোন দেন। মা ফোন ধরে জানান যে পথে আছেন, কিছুক্ষণের মধ্যে বাসায় পৌঁছে যাবেন। এ সময় তাঁর কণ্ঠ স্বাভাবিক শোনা যায়নি, জড়তা ছিল।
কিন্তু যথেষ্ট সময় পার হলেও তাঁরা বাসায় না ফেরায় রাত ৮টার দিকে মা-বাবাকে ফের ফোন করেন মেরাজ। তবে রিং বাজলেও তাঁরা কেউ ফোন রিসিভ করেননি। মেরাজ রাত ১০টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে শেষে চাচাদের নিয়ে শুরু করেন খোঁজাখুঁজি। রাতভর বিভিন্ন জায়গায় খুঁজেও মা-বাবার সন্ধান পাননি মেরাজ। ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বড় চাচা প্রাইমারি শিক্ষক আতিকুর রহমানকে নিয়ে পুবাইলের দিকে খুঁজতে বের হয়ে বাড়ির অল্প দূরেই বগারটেক ঢালে দেখতে পান তাঁদের প্রাইভেট কারটি রাস্তার পাশে দাঁড়ানো। কাছে গিয়ে দেখেন, গাড়ির দরজা লক করা নয়। চালকের আসনে বসা মামুনের হাত স্টিয়ারিংয়ে রাখা। তাঁর পাশের সিটে বসা স্ত্রী জলি। দুজনই অচেতন। উদ্ধার করে দ্রুত তাঁদের স্থানীয় তায়রুননেছা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং পরে সেখান থেকে রাজধানীর উত্তরার একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, অনেক আগেই তাঁদের মৃত্যু হয়েছে।
এটিকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড উল্লেখ করে মেরাজ তাঁর মা-বাবার হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে বিচারের দাবি জানান।
শিক্ষক মামুনের ভগ্নিপতি মাওলানা আবদুর রশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গাড়িতে মামুনের ব্যাগে স্কুলের এক লাখ ৪০ হাজার টাকা, তাঁর স্ত্রীর শরীরে প্রায় তিন ভরি স্বর্ণালংকার, তাঁদের দুজনের দামি মোবাইল ফোন ছিল। কিছুই খোয়া যায়নি। ছিনতাইকারীদের কাজ হলে এসব নিয়ে যেত। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, শত্রুতা থেকে পরিকল্পনা করে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে কেউ। আমরা রাত দেড়টার দিকে গাছা থানায় গিয়ে পুলিশের সহযোগিতা চেয়েছি। পুলিশ আমাদের বলেছে, রাতটা দেখে সকালে যেতে, তখন তারা দেখবে। ’
তিনি আরো বলেন, ‘মামুন আগে টঙ্গীর নোয়াগাঁও স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। জলি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী। ১০ বছর আগে মেরাজকে রেখে প্রথম স্ত্রী ক্যান্সারে মারা যান। এর দুই বছর পর পারিবারিকভাবে জলিকে বিয়ে করেন মামুন। নিজের সন্তান না হওয়ায় মেরাজকে আপন সন্তানের মতো ভালোবাসতেন জলি। দুই বছর আগে প্রধান শিক্ষক হিসেবে শহীদ স্মৃতি স্কুলে যোগ দেন মামুন। ভালো মানুষ হিসেবে এলাকায় তাঁর পরিচিতি ছিল। ’
গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে আহাজারি করছিলেন জলির মা শামসুন্নাহার। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘বুধবার সন্ধ্যার দিকে জলির সঙ্গে মোবাইলে আমার শেষ কথা হয়। কল দেওয়ার পর জানিয়েছিল মামুনের সঙ্গে বাড়ি ফিরছে। ওই সময় জলির গলার আওয়াজ স্বাভাবিক মনে হয়নি। কথায় ঘুম ঘুম ভাব ছিল। ’
জানা গেছে, একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে দুই বছর আগে শহীদ স্মৃতি স্কুলের দায়িত্ব নেন মামুন। শৃঙ্খলা ফেরাতে তখন ১০-১১ জন শিক্ষককে বরখাস্ত করে নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেন তিনি। এসব ঝামেলায় না জড়াতে পরিবারের পক্ষ থেকে মামুনকে সতর্ক করা হয়েছিল। বরখাস্ত এবং নতুন নিয়োগকে কেন্দ্র করে একটি পক্ষের মধ্যে অসন্তোষ চলছিল।
গাছা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) নন্দলাল চৌধুরী জানান, শিক্ষক দম্পতি বাড়ি থেকে নেওয়া খাবার স্কুলে খেতেন। প্রাইভেট কারে থাকা খাবারের বাটি সিআইডি পুলিশ জব্দ করেছে। স্কুল থেকে শুরু করে পুরো পথের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। ফুটেজে দেখা গেছে, শিক্ষক মামুন সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে স্কুল থেকে গাড়ি নিয়ে বের হন। রাত ৮টা ২০ মিনিটে যেখানে গাড়ি পাওয়া গেছে, সেখানে পৌঁছেন। ফুটেজ দেখে ক্লু বের করার চেষ্টা চলছে। তবে যেখানে গাড়িটি পাওয়া গেছে, সেখানে সিসি ক্যামেরা থাকলেও নষ্ট থাকায় গাড়ি থেকে কেউ নেমেছে কি না তা দেখা যায়নি।
তিনি আরো জানান, সুরতহালে শিক্ষক দম্পতির শরীরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। ঘটনাটি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। ময়নাতদন্ত শেষে লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পাওয়ার পর মৃত্যুর কারণ জানা যাবে।
লাশের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাইমিন আহমেদ জানান, শিক্ষক দম্পতির শরীরের অভ্যন্তরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। আঘাতগুলো আগের, নাকি মৃত্যুর সময়কার তা বোর্ডের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এ ছাড়া বিষক্রিয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হতে তাঁদের পাকস্থলীর কেমিক্যাল টেস্টের জন্য ঢাকায় পাঠানো হবে।
গতকাল রাত ১টা পর্যন্ত এ ঘটনায় থানায় কোনো মামলা করা হয়নি।
এ জাতীয় আরো খবর..