রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে পাওয়া প্রস্তাবগুলো মূল্যায়নের আগেই নির্বাচন কমিশন (ইসি) জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নিয়ম-কানুন সংক্রান্ত প্রধান আইন ‘দ্য রিপ্রেজেন্টেশন অব দ্য পিপল অর্ডার’ (আরপিও) বা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। গত ৭ আগস্ট কমিশনের সভায় অনুমোদনের পর এসংক্রান্ত প্রস্তাব গত ৮ আগস্ট আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হয়েছে।
কমিশন থেকে বলা হচ্ছে, আগামী বছর ২০২৩ সালের শেষ দিকে বা ২০২৪ সালের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিতব্য দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে আরপিওর আর কোনো সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়ার সম্ভাবনা কম।
গত ১৭ জুলাই থেকে গতকাল ৩১ জুলাই পর্যন্ত ইসির সঙ্গে সংলাপে নিবন্ধিত ৩৯টি দলের মধ্যে ২৮টি দল অংশ নেয়।
রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ ৯টি দল সংলাপ বর্জন করে। অন্য দুটি দল বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও জাতীয় পার্টি-জেপি নির্ধারিত সময়ে সংলাপে যোগ দিতে না পারায় পরে সময় চেয়েছে; কিন্তু নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
সংলাপে দলগুলো যেসব দাবি বা প্রস্তাব রেখেছে তা মূল্যায়ন করে কি আরপিও সংশোধনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে—এই প্রশ্নে নির্বাচন কমিশনার বেগম রাশেদা সুলতানা গতকাল শুক্রবার কালের কণ্ঠকে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের মূল্যায়ন, সংলাপে পাওয়া দাবি বা প্রস্তাব সম্পর্কে কমিশন কী অভিমত জানাবে, সেসব বিষয় নিয়ে কাজ চলছে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে আরপিও সংশোধনের আর কোনো প্রস্তাব পাঠানোর চিন্তা-ভাবনা আছে কি না—এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আপাতত নেই। যে প্রস্তাব পাঠিয়েছি তার কী হবে না হবে, তার পরে অন্য বিষয় ভাবা যাবে। ’
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথও বলেন, গত ৮ আগস্ট আরপিও সংশোধনের প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয় কোনো পর্যবেক্ষণ দিলে সে অনুযায়ী প্রস্তাব সংশোধন করে আবারও পাঠানো হবে। নতুন করে আর কোনো প্রস্তাব নেওয়া হবে কি না, তা বলা যাচ্ছে না।
ইসির প্রস্তাবে যা আছে : ইসি সূত্রে জানা যায়, আরপিও সংশোধনে কমিশনের প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে, রিটার্নিং অফিসার ভোটের ফল ঘোষণার পরও অনিয়মের প্রমাণ পেলে ওই ফল সরকারি গেজেটে প্রকাশের আগে নির্বাচন কমিশন সে ফল বাতিল করতে পারবে। বর্তমানে ভোট চলাকালে কোনো অনিয়ম হলে ভোট বন্ধ করার ক্ষমতা রয়েছে নির্বাচন কমিশনের; কিন্তু ভোট গ্রহণের পর রিটার্নিং অফিসার ফল ঘোষণা করলে সেই ক্ষেত্রে আর কমিশনের কিছু করার থাকে না। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে পোলিং এজেন্টদের সুরক্ষা, অনিয়মে জড়িত নির্বাচনী কর্মকর্তা ও প্রভাব বিস্তারকারী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনা, নিবন্ধিত দলগুলোর সব ধরনের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য রাখার সময় সীমা ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাড়ানো, দলগুলোর গঠনতন্ত্র সংশোধনের সময় কমিয়ে এক মাস করাসহ আরপিওর ৭, ১২, ১৫, ২৫, ৩১, ৩৬, ৪৪, ৮৪, ৯০, ৯১ অনুচ্ছেদের বেশ কিছু ধারা-উপধারায় সংযোজন, বিয়োজন ও করণিক সংশোধন।
৫০ বছরে ১৭ বার সংশোধন : গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ প্রণীত হয়েছিল ১৯৭২ সালে। এরপর এখন পর্যন্ত ৫০ বছরে মোট ১৭ বার সংশোধন করা হয়েছে আইনটি। এ সময়ে সংযোজন-বিয়োজন করা হয়েছে এর বিভিন্ন অনুচ্ছেদের ২১১টি বিষয়। আরপিও প্রথম সংশোধন করা হয়েছিল ১৯৭৮ সালে।
পরে ১৯৮১, ১৯৮৫, ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৪, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮, ২০০৯, ২০১৩ ও একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৮ সংশোধনী আনা হয়। ওই বছরের ৩১ অক্টোবর সর্বশেষ ওই সংশোধনীতে সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের সুযোগ আরপিও সংশোধন করা হয়।
আরপিওতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয় নবম সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কর্মকালে ২০০৮-০৯ সালে। ২০০৮ সালের ৪২ ও ৪৫ নম্বর অধ্যাদেশের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে সংশোধন করা হয় আরপিও। ওই বছরই ৫২ নম্বর অধ্যাদেশের মাধ্যমে আরো একবার সংশোধন করা হয় ৯৫টি অনুচ্ছেদসংবলিত আইনটি।
ওই সময় থেকে ভোটার না হয়েও সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ইসিতে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন এবং প্রার্থীকে হলফনামার মাধ্যমে নিজের সম্পর্কে আট ধরনের তথ্য প্রদান বাধ্যতামূলক করা হয়। এ ছাড়া যুক্ত করা হয় ‘না’ ভোটের বিধান, সরকারি চাকরি থেকে পদত্যাগ বা অবসরের পর তিন বছর এবং বরখাস্ত হলে পাঁচ বছর পার না হলে নির্বাচনে অযোগ্যতার বিধান। দলীয় প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে তৃণমূলের মতামত বিবেচনায় নেওয়া এবং সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে হলে নিরবচ্ছিন্নভাবে তিন বছরের বেশি সময় দলের সদস্য থাকাও বাধ্যতামূলক করা হয়। নিষিদ্ধ করা হয় দলে অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন হিসেবে ছাত্র, শিক্ষক ও শ্রমিক সংগঠন এবং দেশের বাইরে কোনো শাখা রাখা। যুদ্ধাপরাধীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণও নিষিদ্ধ করা হয়। ২০২০ সালের মধ্যে দলের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সব কমিটিতে ন্যূনপক্ষে ৩৩ শতাংশ সদস্য পদ নারীদের জন্য সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক করা হয়। নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের জন্য আগে কখনো নির্বাচিত না হয়ে থাকলে নির্বাচনী এলাকার ১ শতাংশ ভোটারের সমর্থনও বাধ্যতামূলক করা হয়। নির্বাচনে অযোগ্য করা হয় ঋণখেলাপিদের সঙ্গে বিলখেলাপিদেরও। ইসি ওই সময় নির্বাচনী অপরাধের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা লাভ করে। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় পুলিশের সঙ্গে আনসার বাহিনী, ব্যাটালিয়ন আনসার, বাংলাদেশ রাইফেলস (পরে বিজিবি), কোস্ট গার্ড এবং প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এটি বহাল রাখা হয় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও। ওই সময় থেকে স্টিলের ব্যালট বাক্সের বদলে চালু হয় স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আরপিওর বাইরে ছবিসহ ভোটার তালিকা ও জাতীয় পরিচয়পত্রের পক্ষে আইন করা হয়। ওই নির্বাচনের পরে ২০০৯ সালে ইসির স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের এবং স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রণীত হয় ‘নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন’। এ ছাড়া পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ২০১১ সালে সংবিধানের ১২৫ (গ) অনুচ্ছেদে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সে নির্বাচনসংক্রান্ত কোনো মামলায় ইসিকে যুক্তিসংগত নোটিশ বা শুনানির সুযোগ না দিয়ে অন্তর্বর্তী বা অন্য কোনোরূপ নির্দেশ না দিতে আদালতের ওপর বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়।
এদিকে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে ওই সব বিধানের মধ্যে ‘না’ ভোটের বিধান বাতিল করা হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞা থেকে বাদ দেওয়া হয় প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগগুলো। এরপর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালে বিলুপ্ত করা হয় দলে তিন বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে সদস্য থাকার বিধানটি।
নুরুল হুদার কমিশন : ২০১৮ সালের ৩১ অক্টোবর রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান ইসির আরপিও সংস্কারের যে তিনটি প্রস্তাব অনুমোদন করা হয় সেগুলো হলো ভোট গ্রহণে ব্যালট পেপারের পাশাপাশি ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার, কম্পানি বা ফার্মের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বা অংশীদারকে সাত দিন আগের পরিবর্তে মনোনয়নপত্র দাখিলের দিন পর্যন্ত খেলাপি ঋণ পরিশোধের সুযোগ এবং অনলাইনেও প্রার্থীর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার বিধান। এর জন্য আরপিওর আটটি অনুচ্ছেদ ও উপ-অনুচ্ছেদ সংশোধন করতে হয়। ’
কাজী রকিব কমিশনের কর্মকালে সংস্কার : ২০১২ সালে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন ইসি দায়িত্ব নেওয়ার পর বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে অনেক প্রস্তাবই সরকারের সমর্থন পায়নি। যেসব প্রস্তাব সমর্থন পায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ‘যুদ্ধাপরাধীর’ পরিবর্তে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দণ্ডিত ব্যক্তিদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটার ছাড়া কেউ পোলিং এজেন্ট হতে পারবেন না। এসব বিষয়ে সংসদে আরপিও সংশোধন বিল পাস করা হয় ২০১৩ সালে।
এম এ সাঈদের আমল : অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এম এ সাঈদের নেতৃত্বাধীন ইসির প্রস্তাব অনুসারে ২০০১ সালের ৮ আগস্ট আরপিও সংশোধনের অধ্যাদেশ জারি হয়। এর মাধ্যমে কর ও টেলিফোন, গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ ইত্যাদির বিলখেলাপিরা নির্বাচনে অংশ নিতে না পারা, নির্বাচনে কেউ কারচুপি করলে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য তিনি নির্বাচনে অযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত হওয়া, তিনটির বেশি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না পারা। নির্বাচনের সময় পুলিশসহ সেনাবাহিনী ও অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীকে নির্বাচনে বিঘ্ন সৃষ্টিকারীদের বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা দেওয়া, নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে যেকোনো প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করার ক্ষমতা ইসিকে দেওয়া, কোনো প্রার্থী নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব দাখিলে ব্যর্থ হলে তাঁকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা আদায়—এসব বিধান যুক্ত হয়; কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধিতার মুখে ওই বছরের ২ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় অধ্যাদেশের মাধ্যমে ইসির প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
পঞ্চম সংসদ নির্বাচনের আগে সংস্কার : ইসির তথ্য মতে, পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ১৯৯১ সালে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার অধ্যাদেশের মাধ্যমে আরপিওতে বিভিন্ন সংশোধনী আনে। ওই সময় নির্বাচন কমিশন ও রিটার্নিং অফিসারের কাছে নির্বাচনের আগে প্রার্থীর খরচের সম্ভাব্য উৎস জানানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। এ ছাড়া নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ইসির আওতায় আনার জন্য ‘নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ-১৯৯০’ জারি করা হয়।
এ জাতীয় আরো খবর..