×
  • প্রকাশিত : ২০২২-০৭-২২
  • ২৮৩ বার পঠিত
প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে এখন সপ্তম স্বর্গে অবস্থান করছেন। ১৯৯৯ ও ২০০৫ সালের দুটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাজে পরাজয় এবং ২০১০, ২০১৫ ও ২০১৯ সালের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া থেকে বিরত থাকার পর তিনি যখন সর্বশেষ সাধারণ নির্বাচনে (২০২০) হেরে যান, তখন সবাই তাঁর রাজনীতির শেষ দেখেছিল। এই তিনিই পরে চলতি বছরের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী এবং জুলাই মাসে প্রেসিডেন্ট হলেন। বিষয়টি তাঁর বয়সের সঙ্গে না গেলেও বুধবারের ভোটের ফল জানার সময় তিনি পার্লামেন্ট লনে আনন্দে গড়াগড়ি দিতেই পারতেন।

সুতরাং তাঁকে অভিনন্দন জানানোই ভালো।
অন্যদিকে রনিলকে প্রেসিডেন্ট পদে জিতিয়ে শ্রীলঙ্কার ক্ষমতাসীন দল এসএলপিপি খুব উল্লসিত। কারণ অন্তত পার্লামেন্টে দলটির রাজনৈতিক পেশি দুর্বল হয়নি। রাজনৈতিকভাবে বলতে গেলে, শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টের দিয়াভান্না লেকটি খুব দ্রুতই রাজাপক্ষদের জন্য ‘নান্দীকাদাল লেগুনে’ (যেখানে এলটিটিই প্রধানকে হত্যা করা হয়) পরিণত হয়েছে। ফলে দলটির ক্ষমতা এখন পার্লামেন্টের ভেতরেই সীমাবদ্ধ, যেখানে তারা মরিয়া হয়ে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলছে।

নতুন প্রেসিডেন্ট বিক্রমাসিংহে একই সঙ্গে ভাগ্যবান ও ভাগ্যহীন। ভাগ্যবান এই কারণে যে তিনি বহুল আকাঙ্ক্ষিত প্রেসিডেন্ট পদটি খুব শর্টকাটে অর্জন করতে পেরেছেন। ভাগ্যহীন এই কারণে যে তিনি দেশের সবচেয়ে খারাপ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে লক্ষ্যটি অর্জন করেছেন। যেসব পরিস্থিতির কারণে গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকটি গণ-অভ্যুত্থান এবং প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের বিদায় ঘটিয়েছে, সেসব আর্থ-সামাজিক কারণ এখনো বিদ্যমান।

অবশ্য দেশজুড়ে গণবিক্ষোভে কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে; কিন্তু এই মুহূর্তে আমরা যা অনুভব করছি, সেটা হচ্ছে ঝড়ের আগের শান্ত পরিস্থিতি। জনসাধারণের ক্রোধের শক্তিমত্তা কিন্তু কমে যায়নি। তাই রাজনীতিতে উত্তেজনা প্রশমিত করার একমাত্র উপায় হলো ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকটের কারণগুলো দূর করা। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ানো ছাড়া এই কাজটি করা যাবে না। আর এটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ।

বিক্রমাসিংহে এমন একটি সরকারের নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছেন, যার নিজেরই বৈধতার অভাব রয়েছে। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে এবং প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষের পদত্যাগের কারণেই বর্তমান এসএলপিপি সরকার তার বৈধতা হারিয়েছে। কারণ এই দুই ব্যক্তি হচ্ছেন মূল কারিগর, যাঁরা এসএলপিপির প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচনের প্রচারাভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং নিরঙ্কুশ গণরায় নিশ্চিত করেছিলেন। অথচ সেই এসএলপিপিই এখন রাস্তায় নামার আগেই মানুষকে ভয় পায়। তাদের পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে সমবায় সমিতির নির্বাচনেও দলটির লোকজন হেরে যাচ্ছেন। সুতরাং প্রেসিডেন্ট বিক্রমাসিংহের এই সত্যটির প্রতি চোখ বন্ধ রাখা উচিত নয় যে তিনি বুধবার যে পার্লামেন্ট জয়ের জন্য এমন একদল রাজনীতিবিদের কাছে ঋণী হয়েছেন, যাঁরা জনগণের সামনে যেতে খুব ভয় পান।

এটা সত্য যে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিতান্তই জনগ্রহণযোগ্যতা ও বৈধতাকে প্রমাণ করে না। এ জন্য ইউএনপি নেতৃত্বাধীন ইউএনএফ সরকারের কথা মনে করা যেতে পারে। তারা পার্লামেন্টে কার্যকারিতা দিয়েছিল; কিন্তু পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে ইউএনপি একটি আসনও জিততে পারেনি।

বিবেচনায় রাখা দরকার, এসএলপিপির হর্তাকর্তারা ক্ষমতার অপব্যবহার, সরকারি তহবিল চুরি এবং দুর্নীতির বন্ধ করতে না পারার কারণে জনসাধারণের বিক্ষোভের মুখে বাজে সময় পার করছেন। ফলে নিষ্ঠুর দমন-পীড়নের মাধ্যমে তাঁরা এখন সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের ওপর উপযুক্ত প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করবেন। অথচ এই হর্তাকর্তারাই প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষকে তাঁদের ইচ্ছা পূরণের জন্য চাপ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু সৌভাগ্যবশত তিনি বিক্ষোভকারীদের ওপর সামরিক বাহিনীক ছেড়ে দেওয়ার পরিবর্তে নিজে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এখন আশা করা যেতে পারে, প্রেসিডেন্ট বিক্রমাসিংহেও এই গোষ্ঠীর চাপের কাছে নতি স্বীকার করবেন না। গত বুধবার এসএলপিপির যে এমপিরা বিক্রমসিংহেকে ভোট দিয়েছেন, তাঁরা প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের পতনেও অবদান রেখেছিলেন। এখন ঠিকই তাঁরা হারিয়ে যাওয়া সময় পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা দেখে লালা ঝরাচ্ছেন।

বুধবার বিক্রমাসিংহেকে সমর্থনকারী প্রায় সব এমপিই এসএলপিপির সদস্য এবং রনিল বিক্রমাসিংহেও তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার টিকিয়ে রাখার জন্য তাঁদের ওপর নির্ভরশীল থাকবেন। বিপরীত দিকে যে ব্যক্তি শাসকদল এসএলপিপিকে নিয়ন্ত্রণ করবেন, তিনিই কার্যনির্বাহী প্রেসিডেন্টের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হবেন। আর ওই ব্যক্তিটি হচ্ছেন বাসিল রাজাপক্ষে, যাঁর বুড়ো আঙুলের নিচে এসএলপিপি অবস্থান করছে। এমনকি ৬৯ লাখ মানুষের দ্বারা নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট গোতাবায়াও ভাই বাসিলের দয়ায় টিকে ছিলেন। এখন প্রেসিডেন্ট বিক্রমাসিংহে একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করে বাসিলের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখতে সক্ষম হবেন কি না, সেটাই দেখার বিষয়।

শ্রীলঙ্কায় যে ‘আরাগালিয়া’ (রাজপথের সংগ্রাম) চলছে, তা জনসাধারণের ক্ষোভের হিমশৈলের চূড়া মাত্র। আর বর্তমান সরকার ভাঙা মাস্তুল ও ছেঁড়া পাল নিয়ে নিছক আর্তনাদকারী। সুতরাং এটি এমন একটি বিষয়, যা নতুন প্রেসিডেন্টের মনে রাখা উচিত, যদি তিনি তাঁর পূর্বসূরির ভাগ্যকে এড়াতে চান।

সূত্র : সম্পাদকীয়, দি আইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat