×
  • প্রকাশিত : ২০২২-০৭-০৬
  • ২৬১ বার পঠিত
রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজ উৎপাদন খাতে দেশি ও বিদেশি কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। বাকি ১৬ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকঋণ।

দেশে রেফ্রিজারেটর উৎপাদনের মৌলিক কোম্পানি রয়েছে ১২টি। এছাড়া বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করে দেশে ফ্রিজ উৎপাদন করে আরও কয়েকটি কোম্পানি। বিদেশি কোম্পানি রয়েছে ১৯টি।

এর মধ্যে তিনটি কোম্পানি দেশে ফ্রিজ উৎপাদনের কারখানা স্থাপন করেছে। বাকি কোম্পানিগুলো আমদানি করে বাজারজাত করে। এসব খাতে আরও বিনিয়োগ রয়েছে। সবমিলিয়ে রেফ্রিজারেটর শিল্পে লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।

দেশের অর্থনীতির আকার বাড়ায় উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটেছে। এই শ্রেণির পুরো অংশই ইলেকট্রনিক সামগ্রীর বড় ক্রেতা। এর মধ্যে এই শ্রেণির কাছে ফ্রিজ হয়ে উঠেছে নিত্যব্যবহার্য একটি পণ্য।

কোনো কোনো পরিবারে একাধিক ফ্রিজ ব্যবহারের নজিরও রয়েছে। শহরের গণ্ডি ছাড়িয়ে গ্রামেও এই শ্রেণির বিকাশ ঘটছে। অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ দরিদ্র পরিবারেও ফ্রিজের ব্যবহার হচ্ছে।

ফলে ফ্রিজের চাহিদাও বাড়ছে। এটি একটি ভারী শিল্প হওয়ায় এতে একদিকে যেমন বড় বিনিয়োগের প্রয়োজন, লাগে বড় অঙ্কের ঋণও। এর বিকাশে সরকার থেকেও নীতিসহায়তা দেওয়া হয়েছে। সব মিলে এ শিল্পের বিকাশ ঘটছে দ্রুত।

মার্কেটিং ওয়াচ বাংলাদেশের এক জরিপে বলা হয়, দেশি-বিদেশি মিলে মোট চাহিদার ৯৫ শতাংশই দেশে উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে দেশীয় কোম্পানিগুলো উৎপাদন করে ৭৭ শতাংশ। বাকি ১৮ শতাংশ বিদেশি কোম্পানিগুলো। এর বাইরে বিদেশ থেকে সরাসরি আমদানি হয় ৫ শতাংশ।

উদ্যোক্তারা জানান, দেশের চাহিদা মেটানোর পুরো সক্ষমতাই দেশীয় কোম্পানিগুলোর রয়েছে। মুক্তবাজার অর্থনীতি বলে আমদানিও হচ্ছে। এতে দেশীয় ফ্রিজ বিদেশি ফ্রিজের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করেছে।

দেশ থেকে ফ্রিজ রপ্তানিও হচ্ছে। ফলে একদিকে ফ্রিজ আমদানি বাবদ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে। অন্যদিকে ফ্রিজ রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন হচ্ছে। এর মাধ্যমে দেশের ভারী শিল্পের ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ বড় ব্র্যান্ডিং হচ্ছে বিদেশে। 

ফ্রিজের বড় ভোক্তা উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটায় পণ্যটির বাজারও বড় হচ্ছে। ফলে এ খাতে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৯২ সালে দেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৯ শতাংশ ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির।

এখন তা বেড়ে ২২ শতাংশ হয়েছে। অর্থাৎ প্রায় ৪ কোটি মানুষ মধ্যবিত্ত। ২০২৫ সালে তা বেড়ে হবে ২৫ শতাংশে। ২০৩০ সালে তা আরও বেড়ে ৩৩ শতাংশের বেশি হবে। ওই সময়ে ৫ কোটি ২৪ লাখ লোক মধ্যবিত্ত হবে। এ শ্রেণির সাড়ে ৪৮ শতাংশ চাকরিজীবী।

বাকিরা ব্যবসায়ী বা অন্য পেশায় জড়িত রয়েছেন। এর বাইরে ৫ শতাংশ আছে উচ্চবিত্ত। অর্থাৎ প্রায় ১ কোটি উচ্চবিত্ত। অর্থাৎ বর্তমানে কমপক্ষে ৫ কোটি মানুষ ফ্রিজ কিনে। একটি ফ্রিজের মেয়াদ ১০ থেকে ১৫ বছর। দারিদ্র্য থেকে মানুষ ক্রমেই ওপরে উঠে আসছে।

আর ফ্রিজের চাহিদাও বাড়ছে। উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পরিবারে একাধিক ফ্রিজের ব্যবহার রয়েছে। এর বাইরে হোটেল-রেস্টুরেন্ট, সুপারশপ, ওষুধের দোকান, হাসপাতাল, অফিসসহ প্রায় সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে একাধিক ফ্রিজ ব্যবহৃত হচ্ছে।

কোম্পানিগুলোর সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে ফ্রিজের বাজার বড় হচ্ছে। বর্তমানে প্রতিবছর গড়ে ৩০ থেকে ৩২ লাখ ফ্রিজ বিক্রি হচ্ছে। প্রতিবছর ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে বিক্রি বাড়ছে। এ হিসাবে প্রতিবছর গড়ে ৪ থেকে ৫ লাখ করে ফ্রিজের চাহিদা বাড়ছে।

এ হিসাবে আগামী ৫ বছরের মধ্যে ফ্রিজের চাহিদা বেড়ে ৫০ লাখে দাঁড়াবে। বর্তমানে ফ্রিজের বাজার রয়েছে ৮ হাজার ২০০ কোটি টাকার। প্রতিবছর এ বাজার বাড়ছে ১৫ শতাংশ হারে। এ হিসাবে ২০২৫ সালে ফ্রিজের বাজার সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

এর বাইরে রপ্তানির বাজার তো আছেই। মেইড ইন বাংলাদেশ ব্র্যান্ড জনপ্রিয় হলে ফ্রিজের রপ্তানি আরও বাড়বে। কেননা এখন দেশে আন্তর্জাতিক মানের ফ্রিজ উৎপাদন হচ্ছে। দামও কম।

আকার ও মানভেদে দেশি ফ্রিজ ১৩ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। বিদেশি ফ্রিজ ৩০ হাজার থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দাম কম ও মানে ভালো হওয়ায় দেশি ফ্রিজই এখন বেশি বিক্রি হচ্ছে।

২০১০ সালের আগে ফ্রিজ শিল্প পুরোটাই আমদানিনির্ভর ছিল। ২০০৮ সালে প্রথমবার দেশে ফ্রিজের কারখানা স্থাপন কাজ শুরু হয়। ২০১০ সালে দেশে উৎপাদিত ফ্রিজ বাজারে আসে। এরপর থেকে এ শিল্পের শুধু সামনে এগিয়ে চলা। আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

দেশে এখন ১১টি কোম্পানি ফ্রিজ উৎপাদন করছে। আরও একটি কোম্পানি অচিরেই আসছে। চাহিদার কারণে সরকার থেকেও এ শিল্পের বিকাশে নীতিসহায়তা দেওয়া হয়েছে। ২০১০ সালে ফ্রিজ উৎপাদনের ওপর থেকে সব ধরনের ভ্যাট প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।

কিন্তু চলতি অর্থবছরে এ খাতে উৎপাদন পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়। উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে এ ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে।

কেননা আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বেশি, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় পরিবহণ ব্যয় বেড়েছে এবং ডলারের দাম বাড়ায় সার্বিকভাবে উৎপাদন ব্যয় ৫ থেকে ২০ শতাংশ বেড়ে গেছে। ফলে এর সঙ্গে ভ্যাট যোগ হলে দাম আরও বাড়বে। এতে দেশীয় বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

একটি ফ্রিজ উৎপাদনের কারখানা করতে ৩০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকার প্রয়োজন হয়। দেশে বর্তমানে ১১টি কারখানা উৎপাদন করছে। এর মধ্যে যমুনা গ্রুপের যমুনা ফ্রিজ, ওয়ালটন গ্রুপের ওয়ালটন ফ্রিজ, মিনিস্টার গ্রুপের মিনিস্টার ফ্রিজ, ট্রান্সকম গ্রুপের ট্রান্সটেক ফ্রিজ, প্রাণ গ্রুপের ভিশন ফ্রিজ। এছাড়াও আছে ভিসতা ও ওরিয়ন গ্রুপ। 

বিদেশি ব্র্যান্ডের মধ্যে রয়েছে স্যামসাং, এলজি, তোশিবা, শার্প, ইলেকট্রা, কেলভিমনটন, হেইজ অ্যান্ড হায়ার, হিটাচি, ওয়ার্লপুল, প্যানাসনিক, কনকা, সিঙ্গার, গ্রি, র‌্যাংগস, হাইকো।

ফ্রিজ আমদানি নিরুৎসাহিত করতে সরকার সম্প্রতি এর ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করেছে। সব মিলে প্রায় ১০৮ শতাংশ কর দিতে হয়। এছাড়া ফ্রিজসহ বিলাসী পণ্য আমদানিতে ৭৫ শতাংশ এলসি মার্জিন আরোপ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগে মার্জিন দিতে হতো ৫ থেকে ২০ শতাংশ। ফলে দেশীয় শিল্পের বিকাশ হবে বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে দেখা যায়, ফ্রিজের চাহিদা ও উৎপাদন বাড়ায় শিল্প খাতে এর গুরুত্ব বাড়ছে। ১০ বছর আগে ইলেকট্রনিক শিল্পে মোট ভার দেওয়া ছিল শূন্য দশমিক ২ শতাংশের কম। বর্তমানে তা বেড়ে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ হয়েছে।

যেভাবে এ শিল্পের বিকাশ হচ্ছে তাতে এর অবদান ১ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে ২০২৫ সালের মধ্যেই। ফলে এ খাতে বিনিয়োগ যেমন বাড়বে, তেমনই বাড়বে কর্মসংস্থানও। একই সঙ্গে বাড়বে মোট দেশজ উৎপাদনে এর অবদান।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বর্তমানে ৩৬টি দেশ থেকে ফ্রিজ ও এর উপকরণ আমদানি হয়। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮ কোটি ৬০ লাখ ডলার বা ৭২৯ কোটি টাকার ফ্রিজ ও এর উপকরণ আমদানি হয়েছে।

গত অর্থবছরে তা কমে ৭ কোটি ৩৫ লাখ ডলার বা ৬২৩ কোটি টাকার আমদানি হয়েছে। ওই এক বছরের ব্যবধানে এর আমদানি কমেছে প্রায় ১৫ শতাংশ। এভাবে প্রতিবছরই আমদানি কমছে। উৎপাদন বাড়ছে দেশে।

এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয়েছে চীন থেকে ৪ কোটি ৫৫ লাখ ডলারের। থাইল্যান্ড থেকে ১ কোটি ১১ লাখ ডলারের এবং ভারত থেকে ৫৬ লাখ ডলারের।

বিদেশি কোম্পানিগুলোর ওইসব দেশে স্থাপিত কারখানায় উৎপাদিত ফ্রিজ আমদানি হয়েছে। তবে এগুলো চীন ছাড়া থাইল্যান্ড ও ভারতের নিজস্ব ব্র্যান্ড আমদানিতে নেই।

এছাড়া বেলজিয়াম, জার্মানি, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, ইতালি, দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেন, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য থেকে আমদানি হয়েছে।

আমদানির বিপরীতে দেশে উৎপাদিত ফ্রিজ বিদেশে রপ্তানিও হচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় সবই দেশীয় কোম্পানিগুলো করছে। প্রতিবছরই রপ্তানি বাড়ছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২২টি দেশে রপ্তানি হয়েছিল ১২ লাখ ১৬ হাজার ডলার বা ১০ কোটি ৩২ লাখ টাকার ফ্রিজ ও এর উপকরণ।

গত অর্থবছরে রপ্তানি বেড়ে ৬৫ লাখ ৫০ হাজার ডলার বা ৫৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকা হয়েছে। ওই এক বছরের ব্যবধানে রপ্তানি বেড়েছে সাড়ে ৫ গুণ। আগামী দিনে এ খাতে রপ্তানি আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা।

কারণ, দেশি কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি বিদেশি কোম্পানিগুলোও বাংলাদেশে কারখানা করে এখন থেকে বিদেশে রপ্তানি করার কথা ভাবছে। এ কারণে এ খাতে বিদেশি বিনিয়োগও বাড়ছে।

২০১১ সালে ইলেকট্রনিক খাতে বিদেশি কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ ছিল ১৪ কোটি ডলার। ওই সময়ে তারা শুধু ট্রেডিং খাতেই বিনিয়োগ করত। ২০২১ সালে তা বেড়ে ১০৫ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।

১১ বছরে বিনিয়োগ বেড়েছে সাড়ে ৭ গুণ। ইলেকট্রনিক খাতের অন্যতম একটি উপখাত হচ্ছে ফ্রিজ। এ কারখানায় টিভি, ভিসিভি, সিসি ক্যামেরাসহ অন্যান্য পণ্যও উৎপাদন করা যায়।

বাংলাদেশ থেকে ফ্রিজ এবং এর উপকরণ রপ্তানি হচ্ছে পূর্ব তিমুর, গ্রিস, ইরাক, মালদ্বীপ, নেপাল, লেবানন, নাইজেরিয়া, সৌদি আরব, ইয়েমেন প্রভৃতি দেশে।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat