সামাজিক নিরাপত্তা খাতকে প্রায় সব সময় বড় করে দেখানোর চেষ্টা করা হয়। আর এ চেষ্টা প্রস্তাবিত বাজেটেও রয়েছে। নতুন বাজেটে এ খাতের সঙ্গে সামঞ্জস্য নেই এমন কমপক্ষে ১৩টি খাত রয়েছে। আবার যেসব খাত সামাজিক নিরাপত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, সেগুলোর মধ্যে ৯ খাতে বরাদ্দ কমানো হয়েছে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, বাজেটে মূল্যস্ফীতির নিরিখে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়েনি। আওতা ও সহায়তা যতটা বাড়ানো প্রয়োজন ছিল তা করা হয়নি। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে অন্য খাত কেন যুক্ত করতে হবে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, সরকার পেনশন খাতে ব্যয় করবে এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। এই ব্যয়টা আলাদাভাবে থাকা উচিত। এটি সামাজিক নিরাপত্তা খাতে কেন? এ ধরনের আরো ব্যয় যুক্ত করে এ খাতকে বড় করে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে।
দেশের সামাজিক নিরাপত্তা খাত বিশৃঙ্খল অবস্থায় রয়েছে। বড় করে দেখানোর জন্য এ খাতে সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশন, সঞ্চয়পত্রের সুদ, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় তহবিলসহ ছাত্র-ছাত্রীদের উপবৃত্তির টাকাও ঢুকানো হয়েছে।
তবে চলতি অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে যে ১২৩টি কর্মসূচি রয়েছে তার সংখ্যা নতুন বাজেটে কমানো হয়েছে। নতুন বাজেটে কর্মসূচির সংখ্যা কমিয়ে ১১৫টি করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করছে ২৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ।
চলতি অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ আছে এক লাখ সাত হাজার ৬১৪ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৩.১১ শতাংশ। নতুন বাজেটে পাঁচ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়িয়ে করা হয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। এই বরাদ্দ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২.৫৫ শতাংশ। অর্থাৎ বরাদ্দ বাড়িয়ে বলা হলেও জিডিপির হিসাবে আসলে তা ০.৫৬ শতাংশ কমেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূল সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোকে ধরা হলে এই বরাদ্দ জিডিপির ১.৭ শতাংশের বেশি হবে না।
যেসব খাতে বরাদ্দ কমেছে
পেনশনসহ অসামঞ্জস্যপূর্ণ নানা খাতে বরাদ্দ বাড়লেও সামাজিক নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট ৯ খাতে বরাদ্দ কমেছে।
অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান খাতে চলতি অর্থবছরে রয়েছে এক হাজার ৯২৫ কোটি টাকা। কিন্তু নতুন বাজেটে তা প্রায় ৫ শতাংশ কমিয়ে এক হাজার ৮৩০ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে।
দেশে নিত্যপণ্যের দাম ক্রমেই গরিবদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। অথচ নতুন বাজেটে খোলাবাজারে চাল বিক্রির জন্য বরাদ্দ কমিয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে। ওএমএস খাতে চলতি বাজেটে বরাদ্দ রয়েছে এক হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা। এটি কমিয়ে নতুন বাজেটে এক হাজার ৭২০ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।
হাওর ও উপকূলীয় অঞ্চলের অবকাঠামো ও জীবনমান উন্নয়নে চলতি বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয় ২০৭ কোটি ৫১ লাখ টাকা। নতুন বাজেটে তা কমিয়ে ৭০ কোটি ৫৫ লাখ টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট আরো চারটি খাতে নতুন বাজেটে বরাদ্দ কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
অসামঞ্জস্যপূর্ণ ১৩ খাত
অর্থনীতিবিদরা সব সময় বলে থাকেন, সরকারি চাকারিজীবীদের পেনশন কেন সামাজিক নিরাপত্তায় থাকবে? তবু সরকার প্রতি বাজেটে এ খাতকে সামাজিক নিরাপত্তায় রাখে। নতুন বাজেটেও সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশনের ব্যয় বাবদ ২৮ হাজার ৩৭ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এ খাতে রয়েছে ২৬ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা।
সঞ্চয়পত্রের সুদ বাবদ সামাজিক নিরাপত্তা খাতে রাখা হয়েছে সাত হাজার ৯০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরে এ খাতে রাখা আছে ছয় হাজার ৯০৯ কোটি টাকা। অবশ্য সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে করা হয় সাত হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা।
করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র (কুটির শিল্পসহ) শিল্প ও সার্ভিস সেন্টারের প্রতিষ্ঠানের সুদ বাবদ ভর্তুকি পাঁচ হাজার কোটি টাকা রাখা হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তায়। চলতি অর্থবছরে এ খাতে সামাজিক নিরাপত্তায় রয়েছে দুই হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, মাদরাসা, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর, কারিগরি এবং প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি সামাজিক নিরাপত্তা খাতে যুক্ত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে চার হাজার ৩৯০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় তহবিলও এই খাতে ঢোকানো হয়েছে। এ তহবিলে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অবশ্য করোনাভাইরাস শুরু হওয়ার পর ২০২০-২১ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট থেকে সামাজিক নিরাপত্তায় এ খাত যুক্ত করা হয়। সে সময় বরাদ্দ রাখা হয় এক হাজার ২৯০ কোটি টাকা। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে এ তহবিলে প্রথমে সাত হাজার ৩০০ কোটি টাকা রাখা হয়। সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ১০ হাজার কোটি টাকা করা হয়।
নারী উন্নয়ন ও উদ্যোক্তাদের বিশেষ তহবিলও এসেছে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে। নতুন বাজেটে এ খাতে ১২৫ কোটি টাকা রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি বাজেটেও একই পরিমাণ অর্থ রাখা আছে।
জলবায়ু পরিবর্তন তহবিলও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ঢোকানো হয়েছে। এ খাতে নতুন বাজেটে রাখা হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরেও একই পরিমাণ টাকা রাখা আছে।
দক্ষতা উন্নয়ন ও ভূমিকম্পজনিত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা তহবিলের টাকা রাখা হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তায়। এই তহবিলে রাখা হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল সার্ভিস খাতও ঢুকেছে সামাজিক নিরাপত্তায়। এ খাতে রাখা হয়েছে ৩৫ কোটি ৯৩ লাখ টাকা।
এ জাতীয় আরো খবর..