বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন কখনো বৃথা যায়নি। সেই ১৯৫২ সাল, ১৯৯০ সাল, এমনকি ২০২৪ সাল—প্রতিটি আন্দোলনই দেখেছে বিজয়ের মুখ। আগের সব আন্দোলন নিয়ে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র-প্রামাণ্যচিত্র। ২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলনের বিজয় নিয়েও হতে চলেছে বেশ কিছু চলচ্চিত্র ও ওয়েব ছবি।
নির্মাতাদের সঙ্গে কথা বলে লিখেছেন সুদীপ কুমার দীপ।
প্রাথমিক নাম বাক-স্বাধীনতা (শিহাব শাহীন)
চলচ্চিত্র, ওয়েব ছবি, ওয়েব সিরিজ বা নাটক—সব মাধ্যমেই সাফল্য পেয়েছেন শিহাব শাহীন। চলচ্চিত্র ‘ছুঁয়ে দিলে মন’ নির্মাণ করে যেমন পেয়েছেন জনপ্রিয়তা, তেমনি ওয়েব সিরিজ ‘গোলাম মামুন’ ও ‘সিন্ডিকেট’-এ সমাজের নানা অসংগতি তুলে ধরে কুড়িয়েছেন সমালোচকদের ভালোবাসা। এবার ছাত্র আন্দোলন নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে যাচ্ছেন তিনি।
এরই মধ্যে শুরু করেছেন গল্প লেখার কাজ। মাস দুয়েকের মধ্যেই শুরু করতে চান শুটিং। গতকাল শিহাব শাহীন বলেন, “অতীতে আমি অনেক কিছুই বলতে পারিনি বাক-স্বাধীনতার অভাবে। ‘গোলাম মামুন’ বা ‘সিন্ডিকেট’-এ আমার মতো করে সংলাপ বা চিত্রনাট্য করতে পারিনি।
ওটিটি প্ল্যাটফরম থেকেও সাহস দেয়নি। এবার ছাত্র আন্দোলন নিয়ে নির্মিতব্য ছবিটিতে সব তুলে ধরব। এখানে কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমার বিশ্বাস, সেন্সর ছাড়পত্র নিয়েও দুশ্চিন্তা করতে হবে না। আমার ছাত্র ভাইয়েরাই তত দিনে সব কিছু পরিবর্তন করে ফেলবেন।
নির্মাতা শিহাব শাহীনকে তাঁর মতো করে কাজ করার পথ তৈরি করে দেবেন।”
ছবির গল্পটা কি শুধু ২০২৪ এর আন্দোলন নিয়েই হবে? উত্তরে শিহাব শাহীন বলেন, “মাত্র লেখা শুরু করেছি। ২০২৪ সালের প্রাধান্য তো থাকবেই, পাশাপাশি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনও যৌক্তিকভাবে আসতে পারে। এখনই বলা যাচ্ছে না চিত্রনাট্য কোন দিকে এগোবে। তবে বলতে পারেন, ছাত্র আন্দোলনের ওপর পরিপূর্ণ একটা ছবি নির্মাণ করব, যেখানে সত্যিটা উঠে আসবে, বাস্তবতা তুলে ধরব। আপাতত ‘বাক-স্বাধীনতা’ টাইটেল ধরে কাজ করছি। নাম পরিবর্তন হবে পরে।”
কারার ঐ লৌহ কবাট (খিজির হায়াত)
এবারের ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকে ছাত্রদের পাশে ছিলেন নির্মাতা খিজির হায়াত খান। তিনি গত বছরই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মাণ করেছিলেন ‘ওরা ৭ জন’। এবার তিনি চব্বিশের ছাত্র আন্দোলন নিয়ে নির্মাণ করবেন ‘কারার ঐ লৌহ কবাট’। গল্প লেখার কাজ এরই মধ্যে সম্পন্ন করেছেন। তবে চিত্রনাট্যে কিছুটা পরিবর্তন আসবে বলে জানান তিনি। খিজির বলেন, ‘গল্পের প্লটটি আগেই ভেবে রেখেছিলাম। কিছু পরিমার্জন-পরিবর্ধন করব। আমি সব সময় মাল্টি কাস্টিংয়ের ছবি নির্মাণ করি। প্রথম ছবি ‘জাগো’তে অভিনয় করেছিলেন একঝাঁক তারকা। ‘ওরা ৭ জন’-এও সেই ধারাবাহিকতা ছিল। নতুন ছবিতেও সেই ধারাবাহিকতা রাখতে চাই। প্রধান চরিত্রগুলোতে থাকবেন নতুন মুখ, যাঁরা ছাত্র। এবারও নিজেই প্রযোজনা করব। আগামী বছরের শুরুতে পর্দায় ছবিটি দেখতে পাবে দর্শক।’
আবু সাঈদ, মুগ্ধ ও আবরারকে নিয়ে চলচ্চিত্র (মাবরুর রশীদ বান্নাহ)
মাবরুর রশীদ বান্নাহ ছোট পর্দায় নিয়মিত নির্মাতা। প্রথমবার চলচ্চিত্র নির্মাণের ঘোষণা দিলেন সম্প্রতি। আর সেটাই করবেন ছাত্র আন্দোলন নিয়ে। সরকার পতনের দিন (৫ আগস্ট) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্টে বান্নাহ লেখেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশে আমার প্রথম ঘোষণা, ফিল্ম বানাব। আমার ভাই সাঈদ, মুগ্ধ, আবরার ফাহাদকে নিয়ে।’ বান্নাহ ছিলেন ব্যাংককে। আজই দেশে ফিরবেন। জানা গেছে, দেশে ফিরেই তিনি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবেন।
ছবির নাম বিজয় (খন্দকার সুমন)
‘সাঁতাও’ নির্মাণ করে দারুণ প্রশংসিত হয়েছেন খন্দকার সুমন। তবে কিছু ক্ষোভও আছে তাঁর। ‘সাঁতাও’ নির্মাণ করেছিলেন তিস্তা নদীকে কেন্দ্র করে। কোথাও সেটা বলতে পারেননি। ছবির কোনো সংলাপেও উঠে আসেনি নদীটির নাম। কারণ? সুমন বলেন, ‘একমাত্র সেন্সর ছাড়পত্র না পাওয়ার ভয়ে এটা করতে বাধ্য হয়েছিলাম। তিস্তা ইস্যু নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভারত-বাংলাদেশ আলোচনা চলছে, তিস্তার পানির অভাবে উত্তরাঞ্চলের ক্ষতির দিকটা তুলে ধরে ঝামেলা তৈরি করে ফেলি যদি?’ তবে সুমন এখন আর ভয় করছেন না। তিনি বাক-স্বাধীনতার বিজয় হয়েছে বলেই মনে করছেন। তাই ছাত্রদের নিয়ে তাঁর নির্মিতব্য ছবির নামও রেখেছেন ‘বিজয়’। গল্পে উঠে আসবে বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের আদ্যোপান্ত। সুমন বলেন, ‘বাঙালি যতবার অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে, ততবারই ছাত্ররা জেগে উঠেছেন। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে আজকের এই আন্দোলন—সবটাই আমার ছবিতে উঠে আসবে।’
আরো যাঁরা আছেন
ছাত্র আন্দোলন নিয়ে আরো কয়েকজন নির্মাতা ছবি নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন। এর মধ্যে আছেন ‘জুয়াড়ি’খ্যাত এ কিউ খোকন, ‘বাপজানের বায়োস্কোপ’খ্যাত রিয়াজুল রিজু ও ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’খ্যাত দেবাশীষ বিশ্বাস। এ কিউ খোকন বলেন, ‘আমি শুধু একটা চলচ্চিত্র নয়, একটা দলিল তৈরি করে যেতে চাই আগামী প্রজন্মের জন্য। বলে যেতে চাই, ছাত্ররা চাইলে কি না পারে! শিগগিরই শিল্পী-কলাকুশলী নির্বাচন শুরু করব।’
দেবাশীষ বিশ্বাস বলেন, ‘ছাত্ররা জাতির ভবিষ্যৎ, এটা বইতে পড়েছি। এবার বাস্তবে দেখলাম। এ রকম একটা বিষয় নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করাটা দায়িত্বের।’
ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে আহত হয়েছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া নির্মাতা রিয়াজুল রিজু। তিনি এখনো টাঙ্গাইলে চিকিৎসাধীন। সেখান থেকেই জানালেন এই আন্দোলন নিয়ে ছবি নির্মাণের কথা। বলেন, ‘চোখের সামনে সব কিছু দেখেছি। এটা নিয়ে ছবি নির্মাণ করাটা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে।’
এ জাতীয় আরো খবর..