বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে জাতির সামনে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। ইতিমধ্যে ৮ আগস্ট গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সাম্য ও ন্যায্যতাভিত্তিক, দুর্নীতিমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, শোষণহীন, জবাবদিহিমূলক এবং জ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পিত ও টেকসই বাংলাদেশ গড়ার প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের আহ্বান থাকবে।
শনিবার (১০ আগস্ট) রাজধানীর প্ল্যানার্স টাওয়ারে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) আয়োজিত ‘নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে পরিকল্পনাবিদদের প্রত্যাশা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা এসব কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বিগত সরকার প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে অহেতুক বড় বড় প্রকল্প নিয়েছে। অথচ এর বেশির ভাগই সাধারণ মানুষের উপকারে আসেনি, আসবে না। ছোট-বড় এসব প্রকল্পের বিষয়ে একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে। প্রয়োজনে এ বিষয়ে একটি কমিশন গঠন করে কোন প্রকল্পের কত অগ্রগতি হয়েছে, অর্ধেক হলে সেটি কতটা কাজে আসবে ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে সরকারকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বক্তারা আরো বলেন, চলমান পরিস্থিতিতে নতুন সরকারের প্রধান কাজ হবে দ্রুত দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্র নিশ্চিত করা। এই সময়ে বড় কোনো প্রকল্প হাতে নেওয়া মোটেই ঠিক হবে না। বরং আগের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে নেওয়া বড় প্রকল্পের আসলে কতটা প্রয়োজন ছিল সেটি দেখতে হবে। দেখা গেছে, একটি জেলা শহরে এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়ে করা হচ্ছে! সেটি আসলে কতটা প্রয়োজন ছিল? অথচ ছোট অধিক প্রয়োজনীয় অনেক প্রকল্প অর্থ ছাড়ের জন্য কাজ বন্ধ হয়ে আছে।
বিআইপির পরিকল্পনাবিদরা বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে পেশাজীবীদের যথাযথ সম্পৃক্ততা, গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি, ঢাকাকেন্দ্রিক উন্নয়ন ধারণার বিকেন্দ্রীকরণ, সব দখলকৃত নদী, খাল, পার্ক, খেলার মাঠ অনতিবিলম্বে উদ্ধার করে জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া, স্থানীয় সরকারব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ এবং পাবলিক যানবাহন, ফুটপাত এবং রাস্তাঘাট বয়স্ক, শিশু, শারীরিক অক্ষম, গর্ভবতী নারী এবং নারীবান্ধব করার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।
অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধে বিআইপির সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, ‘একটা নগরকে কিভাবে গড়তে হয়, কিভাবে নিয়মের মধ্যে আনতে হয় সেটা শিক্ষার্থীরা যেভাবে জাতিকে শিখিয়েছে, সেভাবে জাতিকে আর কেউ শেখাতে পারেনি কখনো। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, সংবিধানের ক্ষমতা কাঠামোর ভারসাম্য পুনরুদ্ধার, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন পরিচালনা, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশনের স্বাধীন পরিচালনা, সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা উচিত।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সব এলাকার জন্য নগর, অঞ্চল ও গ্রামীণ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন; এসব পরিকল্পনা দলিলকে অনুসরণ করে সব ধরনের উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা এবং এতদসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠন করা দরকার। এ ছাড়া দেশের অর্থনৈতিক এবং স্থানিক (নগর, অঞ্চল ও গ্রামীণ) উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণে ও বাস্তবায়নে জন্য উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি এবং পেশাজীবীদের যথাযথ সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা এবং এতদসংক্রান্ত গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
বিআইপির সহসভাপতি পরিকল্পনাবিদ সৈয়দ শাহরিয়ার আমিন বর্তমান পরিস্থিতিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে ঢেলে সাজানো, বহুতত্ববাদ চর্চা করা, শোষণ ও বৈষম্য দূর করতে তথ্যের অবাধ প্রবাহ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং স্থানিক পরিকল্পনা যথাযথ বাস্তবায়ন করার ওপর জোর দেন। এ ছাড়া মুক্ত স্বাধীন গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
বিআইপির যুগ্ম সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ তামজিদুল ইসলাম বলেন, ‘স্থানীয় সরকারের ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে চাইলে সরকার ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন আনতে হবে। এর জন্য তিনি পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালের কথা বলেন, যেখানে রয়েছে তিন স্তরবিশিষ্ট সরকারব্যবস্থা। সুতরাং সে পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দেশেও হবে তিন স্তরবিশিষ্ট। এখানে কেন্দ্রীয় সরকারের কাজ হবে নীতিনির্ধারণ, আর উন্নয়ন করবে প্রদেশিক এবং স্থানীয় সরকার। তাহলেই দেশের ভারসাম্য রক্ষা হবে।’
জুলাইয়ের বিপ্লবে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন সেসব শহীদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে বিআইপির কোষাধ্যক্ষ পরিকল্পনাবিদ ড. মু. মোসলেহ উদ্দীন হাসান বলেন, ‘সুষম নগরায়ণের জন্যে ঢাকাকেন্দ্রিক উন্নয়ন ধারণার বিকেন্দ্রীকরণ করে দেশের আঞ্চলিক পর্যায়ে উন্নয়ন নিশ্চিত করার পরিকাঠামো ও অর্থায়ন নিশ্চিত করা দরকার।’
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ক্ষেত্রে আঞ্চলিক বৈষম্যকে আমলে নিয়ে সুষম উন্নয়ন দর্শনকে প্রাধান্য দিয়ে এডিপির বরাদ্দ দেওয়া ও জেলাভিত্তিক বাজেট কাঠামো প্রণয়ন করার জন্যে তিনি নীতিনির্ধারকদের আহ্বান করেন।
বিআইপির সাবেক সভাপতি পরিকল্পনাবিদ আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘জাতীয় ভৌত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জোর দেওয়া, প্রকল্প গহণে বৈষম্য দূর করা ও সর্বজনীন প্রকল্প গহণ করা, প্রকল্পের লোকেশন গ্রহণে বৈষম্য দূর করা এবং রাতের অন্ধকারে প্রকল্প গ্রহণ না করে জনগণের প্রয়োজনে প্রকল্প নেওয়া প্রয়োজন।’
সংবাদ সম্মেলন শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে বিআইপির সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘সুশাসন বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। দেশের বেশিসংখ্যক মানুষকে সুবিধা দিতে হবে। খেলার মাঠ, ফাঁকা জায়গা এবং পার্ক উন্নয়নের নামে ধংস করা যাবে না। `গ্রাম হবে শহর’ বলে গ্রামের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করা যাবে না। এই জিনিসগুলো আগে পরিকল্পনাবিদরা বললেও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গ্রহণ করা হতো না। যেহেতু বিপ্লব-পরবর্তী রাষ্ট্রে কাঠামোগত পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব, তাই সুশাসনের মাধ্যমে কম খরচে অধিক উন্নয়নের দিকে আমাদের হাঁটতে হবে। একটি সাম্য ও ন্যায্যতাভিত্তিক, দুর্নীতিমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, শোষণহীন, জবাবদিহিমূলক এবং জ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পিত নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে রাষ্ট্রের সব অংশীজনের ন্যায় পরিকল্পনাবিদদের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নতুন বাংলাদেশ পুনর্গঠনে অব্যাহত সহযোগিতা প্রদানে পেশাজীবী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিআইপি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিআইপির বোর্ড সদস্য পরিকল্পনাবিদ হোসনে আরা আলো, পরিকল্পনাবিদ মো. আবু নাইম সোহাগ, পরিকল্পনাবিদ মো. ফাহিম আবেদীন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. নুরুল্লাহ প্রমুখ।
এ জাতীয় আরো খবর..