গৃহযুদ্ধ থেকে শ্রীলঙ্কাকে পরিত্রাণ দেওয়া মাহিন্দা রাজাপক্ষের জনপ্রিয়তা আজ থেকে এক দশক আগেও ছিল তুঙ্গে। সেই জনপ্রিয়তার ওপর ভর করে ২০১৯ সালে মাহিন্দা রাজাপক্ষের একসময়ের প্রতিরক্ষাসচিব এবং সাবেক সেনা কর্মকর্তা ভাই, যিনি বড় ভাইয়ের সঙ্গে তামিল বিদ্রোহীদের দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, সেই গোতাবায়া রাজাপক্ষে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন। একই সময়ে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের অধিক আসনে বিজয় লাভের পর বড় ভাই এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষেকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে দেশটিতে শুরু হয় রাজাপক্ষে পরিবারের শাসন।
আরো দুই ভাইকে সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া ছাড়াও সংসদে এবং সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবারের অপরাপর সদস্যকে নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে পরিবারতন্ত্রকে পোক্ত করা হয়। জননন্দিত একটি পরিবার দুই বছরের মধ্যে এতটাই নিন্দিত হয়ে যায় যে পদত্যাগের পর কলম্বোতে নিজের বাড়িতে অবস্থানকালে হাজার হাজার মানুষ নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেদ করে তাঁর বাড়িতে ঢুকে পড়ে। ১০ মে ভোরবেলা সেনাবাহিনীর সহায়তায় তাঁকে উদ্ধার করা হয়। প্রবল জনবিক্ষোভের মুখে জনরোষ থেকে রক্ষা পেতে বর্তমানে অনেকটা গোপনে রাজধানী থেকে ২৭০ কিলোমিটার দূরে ত্রিনকোমালির একটি নৌঘাঁটিতে পরিবারসহ কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যে অবস্থান করছেন। জানা গেছে, সেখানেও নৌঘাঁটির বাইরে হাজার হাজার মানুষ অবস্থান নিয়েছে। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের পর বিরোধী দলগুলোর প্রতি প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে কর্তৃক জাতীয় সরকার গঠনের আহ্বান করলেও সেই আহ্বানে সাড়া মিলছে না, দেশব্যাপী জরুরি অবস্থা এবং কারফিউ ভঙ্গ করে মানুষের বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। তাদের দাবি, চলে যেতে হবে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়াকেও।
১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর এমন ক্রান্তিকাল আর কখনো অতিক্রম করেনি ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। নিকট-অতীতে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশটি এখন ধুঁকছে প্রচণ্ড অর্থনৈতিক সংকটে। এর নেপথ্যের কারিগর রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং তাঁদের অপরিণামদর্শী কিছু ভূমিকা। অবশ্য শ্রীলঙ্কার বর্তমান অবস্থা যে পুরোটাই রাজাপক্ষে পরিবারের কারণে হয়েছে ঢালাওভাবে এমনটা দাবি করাও সমীচীন হবে না। মাহিন্দা রাজাপক্ষে ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ২০১৫ সালের নির্বাচনে অনেকটা অকল্পনীয়ভাবে পরাজিত হন তাঁরই মন্ত্রিসভার একসময়ের সদস্য মাইত্রিপালা সিরিসেনার কাছে। বাহ্যিকভাবে শ্রীলঙ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলির মধ্যে মাহিন্দার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে, এমনটা ধারণা করা গেলেও দেশের অনেক মানুষের মধ্যে একইভাবে তাঁকে এবং তাঁর শাসনামল নিয়ে এক ধরনের মিশ্র অনুভূতিও কাজ করেছে। তামিলদের দমন করতে গিয়ে মাহিন্দা এবং তাঁর ছোট ভাই বর্তমান প্রেসিডেন্ট এবং সে সময়ের প্রতিরক্ষাসচিব গোতাবায়া মিলে ৪০ হাজারের বেশি বেসামরিক মানুষকে হত্যা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে এবং এ নিয়ে জাতিসংঘ কর্তৃক নিরপেক্ষ তদন্তে তাঁরা সম্মতি দেননি।
বিষয়টি ২০১৫ সালের নির্বাচনে মাহিন্দার পরাজয়ের এবং মাইত্রিপালা সিরিসেনার বিজয়ের একটি বড় কারণ বলে মনে করা হয়। তবে খুব অল্প সময়ের মধ্যে দুই দলের দুজন প্রেসিডেন্ট মাইত্রিপালা এবং প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের মধ্যে বিভেদ শুরু হয়ে গেলে দেশে রাজনৈতিক সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এই রাজনৈতিক সংকটের ফলে দেশটির অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সেই সময় থেকেই মূলত শ্রীলঙ্কার উন্নয়নের মেগাপ্রকল্পগুলো চলমান ছিল, যার অর্থ সংস্থান ঘটেছিল বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে নেওয়া ঋণের মাধ্যমে। ২০১৮ সালে রাজনৈতিক সংকটকে নিজের অনুকূলে আনতে প্রেসিডেন্ট মাইত্রিপালা প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহকে বরখাস্ত করে তাঁর অনুগত মাহিন্দা রাজাপক্ষেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। পার্লামেন্টে দুই দফা ভোটাভুটিতে মাহিন্দা রাজাপক্ষে পরাজিত হলেও যখন দায়িত্ব থেকে সরে যাচ্ছিলেন না, সে সময় সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে তাঁকে সরে যেতে হয়। বাধ্য হয়ে প্রসিডেন্ট মাইত্রিপালা আবারও রনিল বিক্রমাসিংহকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করান। এই সময়ে ৫১ দিনের এই টালমাটাল রাজনৈতিক উত্তেজনায় দেশের অর্থনীতির ক্ষতির মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। এর পরপরই রাজধানী কলম্বো ও ক্যান্ডিতে বোমা হামলায় কয়েক শ মানুষের মৃত্যু হলে প্রেসিডেন্ট মাইত্রিপালা ও প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে এবং জনগণের কাছে রাজাপক্ষে পরিবার অনিবার্য হয়ে ওঠে।
অবশ্য রাজাপক্ষে পরিবারের রাষ্ট্রের শাসনকার্যে পরিবারতন্ত্র কায়েমের ঘটনা এবারই প্রথম নয়, এর আগে মাহিন্দা যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন সে সময়েই তাঁর বড় ভাই চামাল রাজাপক্ষে পার্লামেন্টের স্পিকার এবং এক ছোট ভাই বাসিল রাজাপক্ষে অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া ছিলেন প্রতিরক্ষাসচিব। বিশেষ করে সে সময়ে অর্থমন্ত্রী বাসিল রাজাপক্ষে চরম দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে ‘মিস্টার টেন পার্সেন্ট’ নামে পরিচিত হন। ২০১৯ সালে ক্ষমতায় এসে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া বাসিলকে সব অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে আবারও অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন, পারিবারিক শাসনব্যবস্থাকে আরো মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করেন। জনগণের মনোযোগ অন্য খাতে প্রবাহিত করতে নির্বাচনকালীন প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে জনগণের ওপর করের মাত্রা ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশে নামিয়ে আনেন।
এদিকে আমলা এবং সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও কর্মচারীদের বেতন ও সুবিধা বাড়ানোর ফলে দেশের অর্থনীতিতে চাপ আরো বাড়তে থাকে। ২০২১ সালে কৃষিতে অর্গানিক প্রযুক্তি ব্যবহারের নামে অর্থ সাশ্রয়ের জন্য সব ধরনের সার আমদানি বন্ধ করে দেন। ফলে ফলন কমে যায়। আমদানির জন্য অর্থ সংস্থানের নামে বিদেশে বিপুল অঙ্কের সার্বভৌম বন্ড ছাড়েন। এটি এই সংকটকে আরো প্রকট করে তোলে। এর মধ্যে কভিড-১৯-এর অভিঘাতে পর্যটনশিল্পে ব্যাপক ধস নামে এবং এই খাত থেকে রাষ্ট্রীয় আয় ১২ শতাংশ কমে যায়। চলমান মেগাপ্রকল্পগুলো থেকে আয় শুরু করার আগেই অর্থদাতাদের কাছে ঋণের অর্থ পরিশোধের সময় চলে এলে দেখা যায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ দুই বিলিয়ন ডলারেরও কম, যা দিয়ে এক মাসের কম সময়ের আমদানি ব্যয় নির্বাহ করা যায়। দেশব্যাপী শুরু হয়ে যায় ব্যাপক নিত্যপণ্যের ঘাটতি। সরকার ৫১ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে অপারগতা প্রকাশ করে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে। জনগণ নেমে আসে রাস্তায়। বিক্ষোভে উত্তাল শ্রীলঙ্কা আজ একটি নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতি আজ এমন এক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যে শ্রীলঙ্কার সরকারদলীয় সব সংসদ সদস্য জীবনের ভয়ে একরকম পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। গত ৯ মে কলম্বোয় সরকারদলীয় একজন সংসদ সদস্যের গাড়ি সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হলে তিনি নিজের পিস্তলের গুলিতে আত্মঘাতী হন।
বর্তমানে প্রতিটি বিমানবন্দরে বিক্ষুব্ধ জনতা সরকারের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের বিদেশে পালিয়ে যাওয়া ঠেকাতে নজরদারি করছে। এমন অবস্থায় প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার জাতীয় সরকার গঠনের আহ্বানে যে জনগণ সাড়া দেবে না সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সংগত কারণেই প্রশ্ন এসে যায়, কিভাবে এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ ঘটতে পারে। এ ক্ষেত্রে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে অর্থনীতিতে যে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে দেশটি সেটি থেকে আশু পরিত্রাণের কোনো সুযোগ নেই। কারণ দাতারা তাদের বৈদেশিক ঋণের ৫১ বিলিয়ন ডলার মওকুফ করে দিলেও চলমান খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানি ঘাটতি মোকাবেলায় দেশটির আর্থিক সংগতি নেই। আর অর্থনৈতিক ঘাটতি মোকাবেলায় বিকল্প রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি ব্যর্থ হয়, সে ক্ষেত্রেও চলমান বিক্ষোভ নতুন করে দাঙ্গায় রূপ নেবে।
সরকার বারবার চীন ও ভারতের কাছে সাহায্য চাইলেও এ ক্ষেত্রে ভারত তাদের ক্রেডিট লাইন থেকে এক বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে। জানা গেছে, চীনের কাছ থেকে আরো চার থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রাপ্তির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। তবে বর্তমান দেউলিয়া ঘোষিত দেশটিকে কোনো দেশ কেন সাহায্য করতে সম্মত হবে সেটিও বিবেচনার বিষয়। এ ছাড়া চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা না কাটলে হয়তো কোনো দেশ এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখাবে না। আর এই অস্থিরতা কিভাবে কাটবে সেটাও অনেকটা এখন নির্ভর করছে আন্দোলনকারীদের পছন্দের ওপর, অর্থাৎ তারা কোন ধরনের রাজনৈতিক বিকল্প বেছে নেবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার পদত্যাগ এবং পরবর্তী সময়ে নিরপেক্ষ একজন অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট নিয়োগের মাধ্যমে আপাত এই রাজনৈতিক সংকটের সমাধান ঘটতে পারে। এমনটা যত দ্রুত ঘটে দেশটির জন্য ততই মঙ্গল, তাহলে অন্তত রাজনৈতিক সংকট পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে মনোনিবেশ করা সম্ভব হবে। তবে আর যাই হোক, সার্বিকভাবে পরিস্থিতিকে মানবিক দৃষ্টিতে দেখার অবকাশ রয়েছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ।
শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি সব দেশের জন্যই একটি অভিন্ন বার্তা বহন করে, আর সেটি হচ্ছে জনগণই সব ক্ষমতার উৎস।
এ জাতীয় আরো খবর..