২০১৮ সালে ৪০তম বিসিএস পরীক্ষা থেকে কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হয়। সরকারি চাকরিপ্রত্যাশীদের জন্য এরপর আরো তিনটি বিসিএস পরীক্ষার সুপারিশ করে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। কোটামুক্ত এসব বিসিএস পরীক্ষার সঙ্গে কোটাযুক্ত ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সংখ্যার বিচারে কোটা বাতিলের কোনো প্রভাব পড়েনি কোটামুক্ত বিসিএস পরীক্ষায়। তবে অনেক ক্যাডারে নারীরা আগের মতোই পিছিয়ে আছেন।
এমনকি কোনো কোনো ক্যাডার নারীশূন্য ছিল।
সংখ্যার হিসাবে পুরোপুরি মেধার ভিত্তিতে নেওয়া বিসিএসগুলোয় নারীরা পিছিয়ে না থাকলেও এবং কোটাযুক্ত ও কোটামুক্ত দুই পদ্ধতিতেই ঢাকা বিভাগ এগিয়ে থাকার পরও পিছিয়ে ছিল সিলেট বিভাগ। কোটার ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আগের অবস্থাও বহাল রয়েছে। আগেও অনেক ক্যাডারে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যরা পিছিয়ে ছিলেন।
কোটামুক্ত বিসিএসগুলোতেও তাঁরা পিছিয়ে।
ফল বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, কোটা পদ্ধতি বাতিলের পর ৪৩তম বিসিএসে দুই হাজার ১৬৩ জন প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে সুপারিশ করে পিএসসি। এর মধ্যে পুরুষ এক হাজার ৭৪২ জন (৮০.৫৪ শতাংশ) এবং নারী ৪২১ জন (১৯.৪৬ শতাংশ)। এর মধ্যে চাকরির জন্য সবচেয়ে বেশি সুপারিশ করা হয় ঢাকা বিভাগের প্রার্থীদের।
আর সবচেয়ে কম সুপারিশপ্রাপ্ত ছিল সিলেট বিভাগ। ঢাকা বিভাগে ছিলেন ৪৭১ জন (২১.৭৮ শতাংশ) প্রার্থী। এর মধ্যে পুরুষ ছিলেন ৩৭৫ জন (১৭.৩৪ শতাংশ), আর নারী ছিলেন ৯৬ জন (৪.৪৪ শতাংশ)। সিলেট বিভাগে চাকরির জন্য সুপারিশ করা হয় ৫০ জন (২.৩১ শতাংশ)। এর মধ্যে পুরুষ ৪২ জন (১.৯৪ শতাংশ) এবং নারী আটজন (০.৩৭ শতাংশ)।
৪২তম বিসিএস ছিল বিশেষ। এই বিসিএসে করোনাকালে ৩১ হাজার ২৬ জন চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়। ৪২তম বিসিএসে পুরুষদের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন নারীরা। ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই বিসিএসে পুরুষ নিয়োগ পেয়েছেন ১৩ হাজার ৬৭৬ জন (৪৪.৮ শতাংশ), আর নারী নিয়োগ পেয়েছেন ১৭ হাজার ৩৫০ জন (৫৫.৯২ শতাংশ)। পুরুষের চেয়ে নারী নিয়োগ পেয়েছেন তিন হাজার ৬৭৪ জন বেশি।
৪১তম বিসিএসে সুপারিশ পেয়েছিলেন দুই হাজার ৫১৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ এক হাজার ৮৪৪ জন (৭৩.২৯ শতাংশ) এবং নারী ৬৭২ জন (২৬.৭১ শতাংশ)।
৪০তম বিসিএসে এক হাজার ৯৬৩ জন প্রার্থীকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করে পিএসসি। এর মধ্যে পুরুষ ছিলেন এক হাজার ৪৫২ জন (৭৩.২৯ শতাংশ), আর নারী ছিলেন ৫১১ জন (২৬.০৩ শতাংশ)। এই বিসিএসেও সর্বাধিক প্রার্থী সুপারিশ করা হয় ঢাকা বিভাগে। আর সবচেয়ে কম সুপারিশপ্রাপ্ত ছিল সিলেট বিভাগ। একই সঙ্গে ৪০তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে ২৫ জেলা থেকে কেউ নিয়োগ পাননি।
এদিকে ৩৮তম বিসিএস পর্যন্ত কোটা পদ্ধতি বহাল ছিল। ওই বিসিএসে দুই হাজার ২০৪ জন প্রার্থীকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করে পিএসসি। এর মধ্যে পুরুষ ছিলেন এক হাজার ৬১১ জন (৭৩.৯ শতাংশ), আর নারী ছিলেন ৫৯৩ জন (২৬.৯১ শতাংশ)। এতেও সবচেয়ে বেশি সুপারিশ করা হয় ঢাকা বিভাগে। আর সবচেয়ে কম সুপারিশপ্রাপ্ত ছিল সিলেট বিভাগ। ঢাকা বিভাগে সুপারিশ করা হয় ৪৯৮ জন (২২.৬০ শতাংশ)। এর মধ্যে পুরুষ ছিলেন ৩৪২ জন (১৫.৫২ শতাংশ), আর নারী ছিলেন ১৫৬ জন (৭.৮ শতাংশ)। সিলেট বিভাগে সুপারিশ করা ৫০ জন (২.২৭ শতাংশ)। এর মধ্যে পুরুষ ৩৮ জন (১.৭২ শতাংশ), আর নারী ২২ জন (০.৫৫ শতাংশ)।
আবার ৩৮তম বিসিএসের মতোই ৪১ ও ৪০তম বিসিএসে ২৬ শতাংশের মধ্যে ছিলেন নারীরা। তবে ৪৩তম বিসিএসে কিছুটা কমলেও ৪২তম বিসিএসে আবার বেড়ে যায়।
ফল বিশ্লেষণে আরো দেখা গেছে, কিছু ক্যাডারে কোটাযুক্ত অবস্থায় যেমন নারীরা নিয়োগ পেতেন না, কোটামুক্ত আবস্থায়ও নিয়োগ পাচ্ছেন না। যেমন, ৪৩তম বিসিএস সাধারণ ১২টি ক্যাডারের মধ্যে শুল্ক ও আবগারি, পরিবার পরিকল্পনা, ডাক, রেলওয়ে পরিবহন ও বাণিজ্য ক্যাডারে কোনো নারী নিয়োগ পাননি। একইভাবে ৩৮তম বিসিএসে সমবায় ও তথ্য ক্যাডারের সহকারী পরিচালক পদে কোনো নারী নিয়োগ পাননি।
দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পিছিয়ে পড়া মানুষদের মূল ধারার সঙ্গে যুক্ত করতে ৫ শতাংশ কোটা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। এই কোটা সুবিধার কারণে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অনেকের সরকারি চাকরিতে আসার সুযোগ সৃষ্টি হয়। তবে লেখাপড়ায় পিছিয়ে থাকার কারণে তাঁরা কোটা সুবিধার পুরোটা ব্যবহার করতে পারতেন না। ফলে বেশির ভাগ বিসিএসেই ৩ শতাংশের বেশি কোটা পূরণ হতো না। এ জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় তাঁদের বিশেষভাবে নিয়োগের অনুরোধ করে। সেটিও কার্যকর হয়নি। কোটামুক্ত বিসিএসে দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যরা পিছিয়েই আছেন।
কোটা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, সামগ্রিক দিক বিবেচনা করলে নারীরা এগিয়েই আছেন। কোটা বাতিলের পরও তাঁরা আগের মতোই নিয়োগ পাচ্ছেন। এর মধ্যে একটি বিসিএসে পুরুষের চেয়ে নারীরা এগিয়ে ছিলেন। আবার কোটা বাতিলের প্রথম বিসিএসে প্রথম হয়েছেন একজন নারী। তিনি হচ্ছেন যশোর জেলার জান্নাতুল ফেরদৌস। তিনি একজন প্রকৌশলী। কারিগরি বিষয়ে পড়াশোনা করে সাধারণ বিষয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে তিনি বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে প্রথম হন।
বিষয়টি নিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আপনারা যদি আমাদের পরিসংখ্যান দেখেন বুঝতে পারবেন, নারীরা পিছিয়ে নেই, বরং তাঁরা এগিয়ে যাচ্ছেন। ১০ শতাংশ নারী কোটা বাতিলের পরও নারীরা আগের মতোই নিয়োগ পাচ্ছেন।’
পরিসংখ্যান তুলে ধরে মন্ত্রী বলেন, ‘কোটা পদ্ধতি বহাল থাকা অবস্থায় ৩৫তম বিসিএসে নারী কর্মকর্তা রয়েছেন ২৮ শতাংশ। ৩৬তম বিসিএসে ২৬.২২ শতাংশ, ৩৭তম বিসিএসে ২৪.৭৩ শতাংশ এবং ৩৮তম বিসিএসে ২৬ শতাংশ নারী কর্মকর্তা রয়েছেন। কোটা পদ্ধতি বাতিলের পর ৪০তম বিসিএসেও দেখেছি নারীদের হার ২৬ শতাংশ। ৪১তম বিসিএসে ২৬ শতাংশ নারী প্রার্থী পদায়নের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। প্রতিটি বিসিএসে ২৬ থেকে ২৭ শতাংশ নারী সুপারিশপ্রাপ্ত হচ্ছেন।’
তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সামষ্টিকভাবে নারীরা এগোলেও বিভিন্ন ক্যাডারে পিছিয়ে থাকার চিত্রও স্পষ্ট। একইভাবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা দেশের কিছু জেলা ও অঞ্চলেরও পিছিয়ে থাকার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। কোটামুক্ত বিসিএসগুলোয় পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে মূল ধারায় নিয়ে আসার চেষ্টার কিছুটা ব্যাঘাত ঘটেছে।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পিএসসি সাংবিধানিক সংস্থা হলেও সরকারের নীতি অনুসরণ করতে হয়। জনবল বাছাইয়ের জন্য সরকার যে সিদ্ধান্ত নেয় আমরা সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উপযুক্ত ব্যক্তিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে পিএসসির যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মেধার ভিত্তিতে বিসিএস আয়োজনের। পিএসসি তাই করেছে। এতে আমাদের কোনো সমস্যাও হচ্ছে না।’
এ জাতীয় আরো খবর..