×
  • প্রকাশিত : ২০২৪-০৬-২৯
  • ৪৩ বার পঠিত
সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি দমনের উদ্দেশ্যে বর্তমান সরকার ২০১২ সালের ১৮ অক্টোবর ‘সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয় : জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল’ শিরোনামে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল প্রণয়ন করেছে। এই উদ্যোগ যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি সুপারিশ করা হয়। কিন্তু গত ১২ বছরেও সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা পেয়েছেন শুদ্ধাচার পুরস্কার।

জনপ্রশাসনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কেবল রাষ্ট্রীয় নিয়ম-নীতি, আইনকানুন প্রণয়ন ও প্রয়োগই যথেষ্ট নয়। এ জন্য সামগ্রিক এবং নিরবচ্ছিন্ন কার্যক্রম প্রয়োজন। রাজনীতিতেও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা জরুরি। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও আত্মপ্রবঞ্চনার ঊর্ধ্বে থেকে সবাইকে আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধি করতে হবে।
 
স্বল্পমেয়াদি সুপারিশ ছিল- প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ে জনপ্রশাসনে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদ বিবরণী নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করা; বেআইনি কাজ ও অসদাচরণ সম্পর্কে তথ্য প্রদানকারী ব্যক্তিদের সুরক্ষায় ‘জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট তথ্য প্রদান (সুরক্ষা) আইন’ বাস্তবায়ন; পাবলিক সার্ভিসে জিআরএসের আওতায় অভিযোগ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রবর্তন; একটি আধুনিক বার্ষিক সম্পাদিত কর্মমূল্যায়ন পদ্ধতি এবং প্রণোদনা ও পারিতোষিক ব্যবস্থার প্রবর্তন; প্রতিবছর নিয়মিতভাবে শূন্যপদে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ নিশ্চিত করা। 

মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশ ছিল- পাবলিক সার্ভিসের দক্ষতা বৃদ্ধি ও আধুনিকায়নের জন্য সিভিল সার্ভিস আইন প্রণয়ন; কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘কর্মজীবন উন্নয়ন পরিকল্পনা’ প্রণয়নের মাধ্যমে একটি দক্ষ, দায়বদ্ধ, যোগ্য ও দ্রুত সাড়াদান-সক্ষম নির্বাহী বিভাগ প্রতিষ্ঠা; কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সক্ষমতা উন্নয়নের জন্য কর্মকালীন প্রশিক্ষণ পরিচালনা এবং প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ; জ্যেষ্ঠতা, কৃতি, জ্ঞান ও দক্ষতার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতামূলক পদোন্নতি পদ্ধতি প্রবর্তন; সরকারি সেবায় কার্যকারিতা আনয়ন ও গণমানুষের কাছে তা দ্রুত ও সহজলভ্য করার লক্ষ্যে ই-গভর্ন্যান্স প্রবর্তন ও তার প্রসার; সরকারি কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য যৌক্তিক বেতনকাঠামো নির্ধারণ ও জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে এগুলোর সমন্বয়সাধন।

বাস্তবায়িত হয়নি দুর্নীতি দমনের উদ্যোগ 
সরকারি চাকরিজীবীদের দুর্নীতি দমনের লক্ষ্যে ২০১২ সালে প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ে জনপ্রশাসনে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদ বিবরণী নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়ার কথা বলা হয়। অথচ সরকারি কর্মচারীকে আচরণবিধি মানাতে না পেরে গত বছরের শেষের দিকে এ নিয়ম বদলে ফেলার প্রস্তাব করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

এরপর সরকার সমালোচনার মুখে পড়ায় সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা-১৯৭৯ সংশোধনীর প্রক্রিয়া ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। বেআইনি কাজ ও অসদাচরণ সম্পর্কে তথ্য প্রদানকারী ব্যক্তিদের সুরক্ষা না দিয়ে বিতর্কিত আইন প্রণয়ন করে সাংবাদিকদের হয়রানি করা হচ্ছে। 
 
জিআরএসের মাধ্যমে অভিযোগ ব্যবস্থাপনাও যথাযথভাবে কার্যকর নেই। বর্তমানে শূন্য আছে চার লাখ ৭৩ হাজার একটি সরকারি পদ। অথচ স্বল্প সময়ে এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নের কথা বলা ছিল।

একইভাবে মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি সুপারিশও ঝুলে আছে। এসব উদ্যোগ কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে, তারও কোনো তদারকি নেই। 
সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা কালের কণ্ঠকে জানান, জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল প্রণয়নের বিষয়টি তিনি ওই পদে থাকাকালে শুরু। 

সাবেক এই মন্ত্রিপরিষদসচিব বলেন, আশা করি, দুর্নীতি বন্ধের সব পরিকল্পনা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়িত হয়ে যাবে। জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল প্রণয়নের ১২ বছর চলছে। ভালো খবর হলো, এটি বাদ যায়নি, টিকে গেছে। সব মন্ত্রণালয়-বিভাগ ও সরকারি দপ্তর শুদ্ধাচার কৌশল সম্পর্কে জানে। 

তিনি বলেন, এখন দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশের পরিমাণ বেড়েছে। এটা ইতিবাচক দিক। কারণ দুর্নীতির খবর প্রকাশ হলে বিচার হবে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি পাবেন।  

সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, কাগজে-কলমে সরকারের অনেক ভালো উদ্যোগ আছে। কিন্তু কার্যকর না হওয়ায় দুর্নীতি আগের চেয়ে বেড়েছে। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে ধামাচাপা দেওয়া হয়। অথচ সরকারের উচিত এসব অভিযোগের নিরপেক্ষ তদন্ত করা। তদন্তের ভিত্তিতে জবাবদিহির আওতায় আনা। এরপর একসময়ে তারা শাস্তি পাবে। 

তিনি বলেন, আয়কর অফিসে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া এবং সরকারি কর্মচারীর নিজ দপ্তরে সম্পদের হিসাব বিবরণী জমার উদ্দেশ্য এক নয়। আয়কর অফিস সত্য-মিথ্যা যাচাই করে না। নিজ দপ্তর সম্পদের হিসাব যাচাই-বাছাই করতে পারে।

শাস্তি হয় না অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের 
প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও তিরস্কার ও বেতন হ্রাসের শাস্তি দিয়ে দায়িত্ব শেষ করছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেও এক পর্যায়ে ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে শাস্তি বা অব্যাহতি কোনোটি দেওয়া হয় না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদ্যো সাবেক সদস্য মতিউর রহমানের নামে কয়েকবার অভিযোগ আসার পরও কোনো শাস্তি হয়নি। কর্মকর্তাদের বেশির ভাগ নবীন হওয়ায় কম শাস্তির পাশাপাশি বড় দায় থেকেও অনেকে অব্যাহতি পাচ্ছেন। 

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রায় এক হাজার কর্মকর্তার নামে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১০ জন সহকারী সচিব, আটজন জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব, সাতজন উপসচিব, একজন যুগ্ম সচিব ও একজন অতিরিক্ত সচিবের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে প্রমাণিত হওয়ায় প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তবে তদন্ত শেষে প্রজ্ঞাপন হলেও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে তা প্রকাশ করা হয়নি। 

দুদকের তথ্য মতে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত শতাধিক দুর্নীতির মামলায় প্রায় ৩৭৪ জনকে আসামি করা হয়েছে, যাদের অর্ধেকই সরকারি চাকরিজীবী। তাদের পরিচয় পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, আসামিদের মধ্যে ৯৬ শতাংশ মধ্যম ও নিম্ন সারির কর্তকর্তা-কর্মচারী। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা রয়েছেন ৪ শতাংশের মতো। এর আগের অন্তত সাত বছরের তথ্য পর্যালোচনা করেও কাছাকাছি ধরনের চিত্র পাওয়া গেছে। এ ছাড়া উচ্চপদস্থ যে কয়েকজনকে আসামি করা হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারায় দেখা যাচ্ছে তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আবার পার পেয়ে যাচ্ছে। 

এ বিষয়ে সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতির শাস্তি শুধুই তিরস্কার—এটা ভাবা যায় না। কোনো দেশে দুর্নীতির মতো অপরাধের জন্য তিরস্কারের মতো লঘুদণ্ডের বিধান আছে বলে আমার জানা নেই। কিন্তু বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীরা দুর্নীতিপরায়ণ হলে তাদের তিরস্কারের মতো লঘুদণ্ড দিয়ে চাকরিতে বহাল রাখার বিধান রেখে ২০১৮ সালে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আচরণ) বিধিমালা তৈরি করা হয়েছে।’

জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের খসড়াটি পর্যালোচনার জন্য মন্ত্রিসভা তত্কালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করে। এরপর ওই কমিটি কয়েকটি সভায় মিলিত হয়ে দলিলটির কাঠামো ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে যেসব মতামত ও নির্দেশনা ছিল, সেগুলোর আলোকে সার্বিকভাবে এই দলিলটি বিন্যস্ত করা হয়। এরপর ২০১২ সালে মন্ত্রিসভার বৈঠকে কৌশলপত্রটি চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat