দেশের অর্থনৈতিক সংকট এতটাই প্রকট যে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত অর্থের সংস্থান দিতে পারছে না অর্থ মন্ত্রণালয়। চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে দেশের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বাস্তবায়ন মাত্র ৫৭.৫৪ শতাংশ। সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫৭.৩৭ শতাংশ বাস্তবায়ন করতে পেরেছিল মন্ত্রণালয়গুলো। গতকাল বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রকাশিত মাসিক হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে।
আইএমইডির প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) প্রথম ১১ মাসে দেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের উন্নয়ন কর্মসূচিতে খরচ হয়েছে মোট বরাদ্দের ৫৭.৫৪ শতাংশ। এই অর্থবছর সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ রয়েছে দুই লাখ ৫৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। বিপরীতে উন্নয়নের জন্য খরচ করা সম্ভব হয়েছে মাত্র এক লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকার সামান্য বেশি। অথচ করোনা মহামারির বছরে উন্নয়ন কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ থাকার কারণে ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে বরাদ্দের বিপরীতে খরচ হয়েছিল যথাক্রমে ৫৭.৩৭ ও ৫৮.৩৬ শতাংশ।
বর্তমানে অর্থসংকট এতটাই প্রকট হয়েছে যে একক মাস হিসেবে মে মাসেও খরচ হয়েছে ইতিহাসের সর্বনিম্ন। গত মে মাসে খরচ হয়েছে ২১ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৮.৮২ শতাংশ। অথচ ২০২২-২৩ অর্থবছরেও খরচ হয়েছিল ১১.৪ শতাংশ। ২০২০ সালে করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি কিছুটা চাপে ছিল।
তবে করোনার সময় অর্থসংকট এতটা প্রকট হয়নি। কিন্তু ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বাংলাদেশের অর্থসংকটের চিত্রটি আরো প্রকট হয়। এ পর্যায়ে এসে বরাদ্দ থাকার পরও অর্থ মন্ত্রণালয় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে অর্থ ছাড় করতে পারছে না।
চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (আরএডিপি) আকার ১৮ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে দুই লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। প্রতিবারের মতো এবারও মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ পাওয়া অর্থ ব্যয় করতে না পারায় কাটছাঁট করতে হয় সংশোধিত এডিপি।
এডিপি কাটছাঁটের ফলে আরএডিপির আকার দাঁড়াল দুই লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। মূল এডিপির আকার ছিল দুই লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, বাকি এক মাসে খরচ করতে হবে ৪২.৪৬ শতাংশ। অর্থাৎ এক মাসে ব্যয় করতে হবে এক লাখ আট হাজার কোটি টাকার বেশি। এর আগের অর্থবছরও একই সময়ে খরচ হয়েছিল মোট বরাদ্দের ৬১.৩৭ শতাংশ। এর আগের অর্থবছর অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে খরচ হয়েছে ৬৪.৮৪ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, এডিপি বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলেও বড় আকারের এডিপি নেওয়া হচ্ছে। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রথম আট বা ৯ মাস বাস্তবায়ন হার অনেক কম থাকে। কিন্তু শেষ দুই মাসে এডিপি বাস্তবায়ন ব্যাপকহারে বেড়ে যায়। শেষ সময়ে তড়িঘড়ি করে বাস্তবায়ন বাড়ানো হয়। এতে গুণগত মান ঠিক থাকে না।
তিনি বলেন, এর পরও বাস্তবায়নের কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে না। যথারীতি গতানুগতিভাবেই চলছে এডিপি। এ জন্য বড় আকরের এডিপি নেওয়ার চেয়ে বাস্তবায়নের দিকে নজর দেওয়া উচিত। ধীরগতির বিষয়ে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়ন কম হয়েছে, এটা ঠিক। তবে বাস্তবায়ন হার বাড়ানোর বিষয়ে জোর দেওয়া হচ্ছে। দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়নেও জোর দিতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এনইসি বৈঠকে সব সচিবকে এডিপি বাস্তবায়ন বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আইএমইডির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের এডিপিতে এক হাজার ৬৭৪টি প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ রয়েছে দুই লাখ ৫৪ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। প্রথম ১০ মাসে ৫৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের তত্ত্বাবধানে থাকা এসব প্রকল্পের বিপরীতে খরচ হয়েছে এক লাখ ৪৬ হাজার ৩৭৫ কোটি ৬৮ লাখ টাকা, যা বরাদ্দের মাত্র ৫৭.৫৪ শতাংশ।
গত কয়েক অর্থবছরের এডিপি বাস্তবায়নের চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, করোনার সময় ছাড়া চলতি অর্থবছরে এত কম এডিপি বাস্তবায়ন হয়নি কখনো। বাস্তবায়ন হয়েছিল ২০২০-২১ অর্থবছরে। ওই বছর সবচেয়ে কম এডিপি বাস্তবায়ন ছিল ৫৭.৩৭ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি বাস্তবায়ন হয়েছিল ২০২১-২২ অর্থবছরে। ওই সময় বাস্তবায়নের হার ছিল ৬৪.৮৪ শতাংশ। এদিকে সামগ্রিকভাবে এডিপি বাস্তবায়ন হারের সঙ্গে মাসের হিসেবে চলতি অর্থবছরের এপ্রিলে গত অর্থবছরের তুলনায় কম বাস্তবায়ন হয়েছে। আইএমইডির তথ্য অনুযায়ী, শুধু মে মাসে এডিপি বাস্তবায়নে খরচ হয়েছে ২১ হাজার ৫৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা। অর্থাৎ মে মাসে বাস্তবায়ন হয়েছে ৮.২৮ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই মাসে খরচ হয়েছিল ২৬ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা, যা বরাদ্দের ১১.৪০ শতাংশ। অর্থাৎ মাসের হিসাবে এডিপি বাস্তবায়ন ৩ শতাংশের বেশি কমেছে।
এ জাতীয় আরো খবর..