রাষ্ট্রমালিকানাধীন পাঁচ ব্যাংক থেকে ৬৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে সরকারি সংস্থাগুলো। এর বেশির ভাগ ঋণ খেলাপযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত দেখাচ্ছে ব্যাংক। কারণ সরকারি সংস্থাগুলোর পক্ষে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সুপারিশের কারণে খেলাপযোগ্য ঋণ নিয়মিত দেখাতে বাধ্য হচ্ছেন ব্যাংকাররা। তা না হলে সংস্থাগুলোকে দেওয়া ৬৫ হাজার কোটি টাকার বেশির ভাগই খেলাপি হয়ে পড়বে।
রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা আটকা
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারি সংস্থা হওয়ায় কিস্তি না দিলেও দীর্ঘদিন ধরে এসব ঋণ নিয়মিত দেখাতে বাধ্য হচ্ছে ব্যাংক। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যাংক খাতসহ পুরো দেশ।
অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৪-এর তথ্য অনুযায়ী, গত ২৯ ফেব্রুয়ারি শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ৩০ সংস্থার কাছে ব্যাংকগুলোর ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজার ৮৯ কোটি টাকা, এক বছর আগেও যা ছিল প্রায় ৫৯ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। প্রতিবছরই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে সরকারি সংস্থাগুলোর ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বাড়ছে।
২০২৪ সালের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এসব ঋণের ৯৬.৫ শতাংশই রয়েছে সাতটি প্রতিষ্ঠানের কাছে। এর মধ্যে ১৮৪ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। এ সময় সর্বোচ্চ ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)।
জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে যাচ্ছে।
চলতি অর্থবছরে অন্তত ১২টি প্রতিষ্ঠান বড় ধরনের লোকসানে রয়েছে, এর পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১৯ হাজার কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। ফলে বছরের পর বছর ব্যাংকের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না প্রতিষ্ঠানগুলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, সরকারি সিদ্ধান্তেই সংস্থাগুলোর ঋণ নিয়মিত রাখা হয়। কিছু ক্ষেত্রে সরকার সেভাবে গ্যারান্টিও দেয়।
তাই ব্যাংকগুলো এসব ঋণ নিয়মিত রাখে।
কোন প্রতিষ্ঠানের কত ঋণ
ব্যাংকগুলোর কাছে সবচেয়ে বেশি ঋণ রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি)। গত ফেব্রুয়ারি শেষে ব্যাংকগুলোর কাছে প্রতিষ্ঠানটির ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৭০৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা। এক বছর আগে প্রতিষ্ঠানটির ঋণ ছিল ১৩ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা। ফলে এক বছরের ব্যবধানে ঋণ বেড়েছে তিন হাজার ৫০২ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) কাছে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর ঋণ বেড়ে হয়েছে আট হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা, যা এক বছর আগে ছিল আট হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা।
এ সময়ে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) ঋণ রয়েছে আট হাজার ২৬ কোটি, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ঋণ সাত হাজার ৪৪৭ কোটি, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) ঋণ ছয় হাজার ৭০২ কোটি, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতের প্রতিষ্ঠান বিবিসির কাছে চার হাজার ৪৮২ কোটি ও বিআইডাব্লিউটিসির কাছে ৩৩৩ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে।
অন্য সরকারি সংস্থার মধ্যে বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) কাছে ৬৭২ কোটি, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কাছে ৫৬২ কোটি, বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের (বিএসইসি) কাছে ২২৬ কোটি, বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (বিওজিএমসি) কাছে ১২৮ কোটি, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) কাছে ১২১ কোটি, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (সিপিএ) কাছে ১১০ কোটি, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশনের (বিটিএমসি) কাছে ২৫ কোটি, ঢাকা ওয়াসার কাছে ৮১ কোটি এবং বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের (বিটিবি) কাছে চার কোটি ৬২ লাখ টাকার ঋণ রয়েছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসানের জন্য দুর্নীতি, অদক্ষতা এবং সামর্থ্য অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন না করাকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলো বছরের পর বছর ধরে লোকসান করে আসছে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে পর্যালোচনা সাপেক্ষে মৌলিক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। কোনটা কোন পদ্ধতিতে রাখলে ভালো হবে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার সময় এসেছে। কিছু প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা ব্যক্তিমালিকানায় দিয়ে দেওয়া যেতে পারে, যাতে সরকারের পাশাপাশি জনগণের মালিকানা সৃষ্টি হয়।
এ জাতীয় আরো খবর..