দুই সপ্তাহের মধ্যে দুইবার ভারত সফর করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সর্বশেষ সফরটি ছিল শেখ হাসিনার বর্তমান সরকারের মেয়াদে প্রথম দ্বিপক্ষীয় রাষ্ট্রীয় সফর। অন্যদিকে নরেন্দ্র মোদির বর্তমান সরকারের মেয়াদেও ভারতে প্রথম দ্বিপক্ষীয় রাষ্ট্রীয় সফর ছিল এটি।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিশেষ ও অনন্য।
এই সম্পর্ক আরো এগিয়ে নিতে দুই পক্ষেরই বার্তা ছিল প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে। সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফরে দুই দেশের সম্পর্কে অগ্রগতি ও অর্জনগুলো ছিল স্পষ্ট। ১০টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়েছে। ১৩টি সুনির্দিষ্ট ঘোষণা এসেছে।
সফরসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশি রোগীদের জন্য ভারতের ই-মেডিক্যাল ভিসা চালুর সিদ্ধান্তটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের জনগণ এ থেকে সরাসরি উপকৃত হবে। ই-মেডিক্যাল ভিসাব্যবস্থা চালুর ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ওপর ভারতের আস্থার প্রতিফলন ঘটেছে। এ ছাড়া নতুন নতুন রুটে বাস ও ট্রেন চালু, নতুন উপহাইকমিশন খোলার ঘোষণার মাধ্যমেও দুই দেশের মানুষে মানুষে যোগাযোগের চেষ্টার প্রতিফলন ঘটেছে।
বাংলাদেশ ও ভারত যে ডিজিটাল ভিশন বা রূপকল্পের বিষয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা বাংলাদেশের ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার স্বপ্নের জন্য সহায়ক। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতেও দুই দেশ সহযোগিতা করবে। আগামী দিনে দুই দেশের জনগণ এর সুফল পাবে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন।
সিরাজগঞ্জে ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো বাস্তবায়নে ভারত বাংলাদেশকে অর্থ সহায়তা দেবে। পানিসম্পদ খাতে দুই দেশে সহযোগিতার দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখা গেছে তিস্তার পানি সংরক্ষণ প্রকল্প বিষয়ে কারিগরি সহায়তা দল পাঠানোর ঘোষণার মধ্য দিয়ে।
এ ছাড়া গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি নবায়ন নিয়ে আলোচনার কথাও বলা হয়েছে। তিস্তার পানি সংরক্ষণ প্রকল্প নিয়ে চীন আগেই আগ্রহ দেখিয়েছিল। গত মাসে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় কোয়াত্রা ঢাকা সফরের সময় তিস্তা প্রকল্পে ভারতের যুক্ত হওয়ার আগ্রহের কথা জানান। সেই আগ্রহের আনুষ্ঠানিক বাস্তবায়ন ঘটেছে ভারত থেকে কারিগরি দল পাঠানোর ঘোষণার মধ্য দিয়ে।
তবে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার এই প্রক্রিয়ায় তাদের যুক্ত না করায় কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আপত্তি জানাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিষয়টি পুরোপুরি কারিগরি হওয়ায় এই প্রক্রিয়ায় রাজ্য সরকারকে যুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা আদৌ আছে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। দৃশ্যত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে প্রায় দেড় দশক ধরে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্যোগ ঝুলে আছে। মোদি সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরে অঙ্গীকারবদ্ধ। তবে সব পক্ষের সম্মতি নিয়েই তারা ওই চুক্তি করতে চায়।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদারে বাংলাদেশ, ভারত—দুই দেশই আগ্রহ দেখিয়েছে। প্রস্তাবিত ‘সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারি চুক্তি (সেপা)’ নিয়ে আলোচনা শুরু করতে দুই পক্ষই সম্মত হয়েছে। প্রতিরক্ষা খাতেও ভারত-বাংলাদেশ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করার আগ্রহ দেখিয়েছে।
এদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আগামী মাসে বাংলাদেশ সফরে আসতে পারেন—এমন তথ্যও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এসেছে। তবে নয়াদিল্লির সূত্রগুলো বলছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণ ভারতের প্রধানমন্ত্রী গ্রহণ করেছেন। তবে ওই সফর কবে হবে সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো বার্তা নেই।
অন্যদিকে ভারতের রাষ্ট্রপতিকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। ভারতের রাষ্ট্রপতি আগামী ডিসেম্বরে মৈত্রী দিবসে বাংলাদেশ সফর করতে পারেন। তবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
ঢাকা ও দিল্লির সূত্রগুলো বলছে, দুই দেশের নতুন সরকারের মেয়াদে প্রথম দ্বিপক্ষীয় রাষ্ট্রীয় সফর বিনিময়ের বার্তাটি খুব স্পষ্ট। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক অন্য যেকোনো দেশের সঙ্গে সম্পর্কের চেয়ে আলাদা। এই সম্পর্ক পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থার। এখানে ১০ দিনের ব্যবধানে দুইবার সফর করা যায়। বাংলাদেশ ও ভারত যে পরস্পরকে গুরুত্ব দেয় এই সফরে বারবার সেটিই তুলে ধরা হয়েছে।
শেখ হাসিনার সরকার কথা দিয়েছিল তাঁর বর্তমান মেয়াদে প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর ভারতেই হবে। কথা রেখেছে শেখ হাসিনার সরকার। শেখ হাসিনা যখন নয়াদিল্লি সফর করছেন তখন প্রস্তুতি চলছে তাঁর চীন সফরের। আগামী ৮ থেকে ১১ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর করার কথা। সেই সফরের প্রাক্কালে গত শনিবার ঢাকায় এসেছেন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ক মিনিস্টার লিও জিয়ানশাও। আজ সোমবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে বৈঠক করবেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন চীন সফরে গুরুত্ব পাবে ৭০০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। তবে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সম্পর্ক তার তুলনা অন্য কারো সঙ্গে হতে পারে না।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ গতকাল রবিবার ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে দুই দেশের যৌথ নদীর কিভাবে একটি অভিন্ন ব্যবস্থাপনা করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ভারত সফর চমৎকার, ফলপ্রসূ ও আন্তরিকতাপূর্ণ ছিল। তিস্তা ও যৌথ নদী ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, নদ-নদীগুলোর অভিন্ন ব্যবস্থাপনা করতে পারলে দুই দেশই উপকৃত হবে। তিস্তা নিয়ে চীনের বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আমরা ভারত সরকারের সহায়তা চেয়েছি। তখন চীনা প্রসঙ্গ এসেছে। সেখানে (মিয়ানমারে) জাতিগত যে সংঘাত চলছে, তাতে চীনের ভূমিকা নিয়ে কথা হয়েছে। অন্য কোনো কিছুতে চীনা প্রসঙ্গ আসেনি।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে হাছান মাহমুদ বলেন, ‘ই-ভিসা চালু করার বিষয়টি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন। বিশেষ করে মেডিক্যাল ভিসার ক্ষেত্রে, অন্যান্য ভিসাও যাতে সহজীকরণ হয়, সে বিষয়ে একটি প্যাকেজ নিয়ে এগোচ্ছেন তাঁরা।
এ জাতীয় আরো খবর..