পরপর চারবার ক্ষমতায় দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন দল আওয়ামী লীগ। কিন্তু এই সময়ে রাজনীতি কতটা দলটির নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে? নাকি হয়ে উঠেছে সামরিক-বেসামরিক আমলানির্ভর? আওয়ামী লীগের ৭৫ বছরের ইতিহাস মূল্যায়ন করতে গিয়ে এ নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা।
তাদের অভিযোগ, বেতনভুক্ত আমলারা গুরুত্ব পাচ্ছে দলটিতে। যা রাজনীতির জন্যও অশনিসংকেত হিসেবে দেখছেন তারা।
এমনকি রাজনীতি কতটা রাজনীতিবিদদের হাতে আছে— এ নিয়ে জাতীয় সংসদে আক্ষেপ ছিল আওয়ামী লীগের দুই বর্ষীয়ান নেতার। একাদশ জাতীয় সংসদে দলটির সংসদ সদস্য মতিয়া চৌধুরী বলেছিলেন, আমলাদের হাতেও দেশকে দেখেছি, গামলাদের হাতেও আমরা দেখছি, সামলাদের হাতেও আমরা দেখেছি। কেউ-ই দেশের চেহারা ভালো করতে পারেন নাই। রাজনীতিবিদরাই দুর্দিনে বাতি জ্বালায়।
তোফায়েল আহমেদ মন্তব্য করেছিলেন, যারা নির্বাচিত প্রতিনিধি, তাদের জন্য নির্ধারিত যে স্থান আছে, তা থাকা উচিত।
টানা চারবার ক্ষমতায় থাকায় দেশের সবচেয়ে প্রাচীন দলটির নেতাকর্মীদের এই আক্ষেপ শুধুই বেড়েছে। রাজনীতি হয়েছে আরও আমলা নির্ভর। বিভিন্ন সময় এমপি-জনপ্রতিনিধিদের সাথে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের মতানৈক্যের বিষয়টি প্রতিনিয়তই উঠে আসছে। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানেও গুরুত্ব পাচ্ছেন না রাজনীতিবিদরা। এমন অভিযোগের পাশাপাশি মনোনয়ন দৌড়ে থাকতে দ্বন্দ্বে জড়াচ্ছেন কোনো কোনো আমলা। সবশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপি হওয়ার দৌড়ে ছিলেন ২৫ জন সাবেক আমলা। শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন পান চারজন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মন্ত্রিপরিষদ সচিব পর্যন্ত যদি সরকারের পক্ষে থাকে, তাহলে অন্যরা কিছু করতে পারবে না। দলের কর্মীদের ক্ষতি হচ্ছে, দলেরও ক্ষতি হচ্ছে, এগুলো যখন প্রকাশ হয়ে যায় তখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
করোনার সময় জনপ্রিতিনিধি ও আমলাদের বিরোধের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে জেলায় জেলায় ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব এমপির বদলে দেয়া হয় সচিবদের। এরপর থেকে মাঠ পর্যায়ে আমলাদের প্রভাব আরও বাড়তে থাকে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান বলেন, বেতনভূক্ত কর্মচারী (আমলা) সবসময় স্ট্যাটাস বজায় রাখার চেষ্টা করবে, আর নিজে নিরাপদে থাকার চেষ্টা করবে। কোনো ঝুঁকি তারা নেবে না। তাই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সৎ, একনিষ্ঠ এবং যাদেরকে আমরা বলি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত এই লোকগুলোকে সামনে নিয়ে আসতে হবে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের আমলা নির্ভর মনোভাবের কারণে সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি বাড়ছে। সেবার মানও কমছে বলে মনে করেন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি সাইফুল হক বললেন, নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়ায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করার পরিবর্তে কে জিততে পারবে, কার টাকা আছে, কার মাফিয়া-পেশি শক্তি আছে— এটিই প্রধান বিবেচনায় রাখছে। এটা করতে গিয়ে পুরো দলের গঠন এখন পরিবর্তন হয়ে গেছে।
এমন অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করছে না আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও। বলছেন, কিছু সমস্যা হলেও গণমানুষের দল হিসেবেই এখনও টিকে আছে আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, আওয়ামী লীগকে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের প্রাধান্য দিতে হবে এবং তাদের সাথে থাকতে হবে। আওয়ামী লীগ কখনও আমলাকেন্দ্রিক হয় না। আওয়ামী লীগ আমলাকেন্দ্রিক হওয়ার দল নয়।
বিশ্লেষকদের মতে, সুযোগ সুবিধা নিশ্চিতে আমলাদের অনেকেই তোষামোদিতে নেমেছেন। এর ফলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হয়েও তৃণমূলের নেতাকর্মীরা কোনঠাসা পরিস্থিতিতে রাজনীতি করতে বাধ্য হচ্ছেন।
এ জাতীয় আরো খবর..