×
  • প্রকাশিত : ২০২৪-০৬-২২
  • ৪৪ বার পঠিত
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদ-নদীর পানি কমায় ওই অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। সেখানে বৃষ্টিপাতও কমেছে। এ তথ্য জানিয়ে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলেছে, আগামী সোমবার পর্যন্ত তিন দিনের মধ্যে এই অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে। তবে বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও এসব এলাকার মানুষের দুর্ভোগ কমেনি।

সিলেটে প্রায় সাড়ে ১০ লাখ মানুষ এখনো দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। সুনামগঞ্জে সাড়ে আট লাখের বেশি মানুষ বন্যাকবলিত। মৌলভীবাজারে দুর্ভোগে চার লাখ মানুষ। হবিগঞ্জে ৯০০ হেক্টর জমির ফসল বিনষ্ট।

অন্যদিকে উত্তরের চার জেলা স্বল্পমেয়াদি বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে। কাউনিয়া পয়েন্টে এর মধ্যে তিস্তার পানি বাড়ায় আজ শনিবার (২২ জুন) উত্তরের জেলা রংপুরের বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে। বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও নীলফামারী জেলার নিম্নাঞ্চলও। 

পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র গতকাল শুক্রবার জানিয়েছে, দেশের উত্তরাঞ্চল ও সংলগ্ন উজানে আগামী সোমবার পর্যন্ত মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।

এ সময় এই অঞ্চলের তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদ-নদীর পানি বাড়তে পারে। এতে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও নীলফামারী জেলার কিছু নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকেছে।
পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান গতকাল সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদ-নদীর পানি কমছে। আশা করছি, আগামী তিন দিনের মধ্যে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। অন্যদিকে উত্তরাঞ্চলের তিস্তার পানি রংপুরের কাউনিয়া পয়েন্টে বেড়েছে।

আগামী তিন দিন উত্তরাঞ্চলের নদ-নদীর পানি বেড়ে কয়েক জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এরপর উত্তরাঞ্চলও স্বাভাবিক হয়ে যেতে পারে।’
 
সিলেটে আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়ছে মানুষ

সিলেটের সামগ্রিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত রয়েছে। নগর ও উপজেলাগুলোর বিভিন্ন এলাকা থেকে পানি নামতে শুরু করেছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর সিলেট কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল সকাল ৬টা থেকে পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় সিলেটে বৃষ্টিপাত হয়েছে ২০ মিলিমিটার। যেখানে এর আগের ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত হয় ১১০.২ মিলিমিটার।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেট কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দুই দিন ধরে নদ-নদীর পানি কমছে। জেলার পাঁচটি পয়েন্টে নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও বৃহস্পতিবারের তুলনায় গতকাল তা আরেক ধাপ কমেছে।

সরেজমিন নগরের উপশহর এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, এরই মধ্যে বি ও এ ব্লকের রাস্তাঘাটের পানি নেমে গেছে। বেশির ভাগ বাসাবাড়ি থেকে পানি নেমেছে।

উপশহর এলাকার বাসিন্দা লবিবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পুরো উপশহরই ডুবে গিয়েছিল। এখন তুলনামূলক উঁচু ব্লকগুলো থেকে পানি সরে গেছে। দু-এক দিন এভাবে বৃষ্টি না হলে হয়তো এ যাত্রায় মুক্তি মিলবে।’

সিলেটের প্রায় সব উপজেলায় বন্যার পানি কমছে। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার কাঁঠালবাড়ী গ্রামের সাইফুল ইসলাম গতকাল আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে বাড়ি ফিরেছেন। তিনি বলেন, ‘ঘরের ভেতর এখনো এক ফুটের মতো পানি রয়েছে। তবু বাড়ি চলে এসেছি আজ।’

সিলেটের জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, সিলেট সিটি করপোরেশনের ৪২টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৯টি ওয়ার্ড এবং জেলার ১৩ উপজেলার ১১১টি ইউনিয়নের মধ্যে ১০৭টি ইউনিয়নই বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। এতে করে নগর ও উপজেলাগুলোর ১০ লাখ ৪৩ হাজার ১৬১ জন মানুষ দুর্ভোগে পড়ে।

পৃথক ঘটনায় চার মৃত্যু

সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায় পৃথক ঘটনায় এক শিক্ষক ও শিশুসহ চারজনের প্রাণ গেছে। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার সকালে উপজেলার বিছনাকান্দিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে জুয়েল মিয়া (১৭) নামের এক কিশোরের মৃত্যু হয়। পেশায় দর্জি জুয়েল নৌকায় বগাইয়ার হাওরে ঘুরতে যায়। এ সময় স্থানীয় মধ্যপাড়া ক্লাবঘরের সামনে বিদ্যুৎ লাইনে জড়িয়ে সে গুরুতর আহত হয়। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে একটি চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

গত বুধবার রাতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে নাজমিন আক্তার (১০) এবং পানিতে ডুবে মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেনের (২৫) মৃত্যু ঘটে।
 
সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি

সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বাসাবাড়ি, সড়ক থেকে নামছে বন্যার পানি। আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে মানুষ। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, জেলায় মোট আট লাখ ৫৫ হাজার ৭৮০ জন বন্যাকবলিত।

সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। মানুষ আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ফিরে যাচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে বন্যার্তদের মধ্যে জিআরের চাল বিতরণ করা হচ্ছে। আশ্রয়কেন্দ্রেও রান্না করা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।

মৌলভীবাজারে দুর্ভোগে চার লাখ মানুষ

উজানে বৃষ্টি না হওয়ায় মৌলভীবাজার জেলার বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও এখনো পানিতে ডুবে আছে ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট। গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। কিন্তু দুর্ভোগে রয়েছে পানিবন্দি প্রায় চার লাখ মানুষ।

কুশিয়ারা ও জুড়ী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে মনু ও ধলাই নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে বইছে। তবে বন্যাকবলিত এলাকায় প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষের ভিড় বাড়ছে।

বন্যায় বেশি দুর্ভোগে পড়েছে রাজনগর, কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখার মানুষ। জেলার সাত উপজেলার ৪৭ ইউনিয়নের ৪৭৪টি গ্রামের প্রায় চার লাখ মানুষ পানিবন্দি রয়েছে।

মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, বন্যায় তিন লাখ ৪৭ হাজার ৪০২ জন মানুষ পানিবন্দি। ২০৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১০ হাজার বন্যার্ত মানুষ ও ২০০ গবাদি পশু আশ্রয় নিয়েছে।

গত কয়েক দিনের ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেট-আখাউড়া রেলপথের মৌলভীবাজারের কুলাউড়া অংশে কিছু স্থানে পানি উঠেছে। এতে গতি কমিয়ে ট্রেন চলাচলে নতুন নির্দেশনা দিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

হবিগঞ্জে ৯০০ হেক্টর জমির ফসল বিনষ্ট

হবিগঞ্জে খোয়াই নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে নামলেও  কুশিয়ারা ও কালনী-কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক জিলুফা সুলতানা জানান, বন্যা মোকাবেলায় ৫১০ মেট্রিক টন চাল, ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নুরে আলম সিদ্দিকী জানান, বন্যায় জেলার ৬৬৩ হেক্টর জমির আউশ ধান ও ১৮৬ হেক্টর জমির শাক-সবজি বিনষ্ট হয়েছে।

গাইবান্ধায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত

গাইবান্ধায় সব নদ-নদীর পানি বাড়ছে। তিস্তা নদীর পানি কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় এই নদীর পানি ৩০ সেন্টিমিটার  বেড়েছে। জেলার ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, ঘাঘট ও করতোয়া নদীর পানিও দ্রুত বাড়ছে। তবে এসব নদ-নদীর পানি এখনো বিপৎসীমার কিছুটা নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, নদীবেষ্টিত এলাকায় শুকনা খাবার বিতরণের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রাথমিক সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

কুড়িগ্রামে ভাঙনে গৃহহীন শতাধিক পরিবার

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও কয়েক দিনের টানা ভারি বর্ষণে কুড়িগ্রামে তিস্তা ও ধরলার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানির তোড়ে বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে নদীভাঙন। গত এক সপ্তাহে সদর, রাজারহাট, উলিপুর, নাগেশ্বরী ও রৌমারী উপজেলায় নদীভাঙনে শতাধিক পরিবার গৃহহীন হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় দেড় হাজার হেক্টর জমির পাট, বাদাম, ভুট্টা ও সবজিক্ষেত তলিয়ে গেছে।

লালমনিরহাটে ফের পানি বৃদ্ধির আভাস

লালমনিরহাটে তিস্তা নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় তিস্তা ব্যারাজ (ডালিয়া) পয়েন্টে নদীর পানি বিপৎসীমার ৫০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। গত বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে জেলার কোথাও বৃষ্টি হয়নি। তবে আবার নদীর পানি বাড়ার আভাস দিয়েছে পাউবো।

পাউবো লালমনিরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীল কুমার গতকাল বলেন, ‘আগামী ৭২ ঘণ্টায় তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি বেড়ে লালমনিরহাটের নিম্নাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা দেখা দিতে পারে।’

নীলফামারীতে তিস্তার পানি কমেছে

নীলফামারীতে দুই দিন আগে তিস্তার পানি বেড়ে বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই করলেও গতকাল কমতে শুরু করেছে। গত বৃহস্পতিবার সকাল ৬টায় তিস্তা ব্যারাজ পয়েণ্টে নদীর পানি বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলে আশপাশের বিভিন্ন চরাঞ্চলে পানি প্রবেশ করে।

নেত্রকোনায় ধীরগতিতে কমছে নদ-নদীর পানি

নেত্রকোনায় নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। তবে কলমাকান্দা উপজেলার উবদাখালী নদী এখনো বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

কলমাকান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, ‘উপজেলার হাওরের গ্রামগুলোতে বাড়িঘরে পানি ঢুকেছে। তবে এখন ধীরগতিতে পানি নেমে যাচ্ছে। মানুষের যাতে কোনো দুর্ভোগ না হয় সে জন্য প্রশাসন সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে।’

মাদরাসা শিক্ষার্থীর মৃত্যু

কলমাকান্দা উপজেলায় গতকাল রিফাত হোসেন (১১) নামের এক মাদরাসা শিক্ষার্থী ঢলের পানিতে ডুবে মারা গেছে। উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের রাতকান্দা গ্রামের আবু কালাম ও মনোয়ার খাতুন দম্পতির ছেলে সে। দুপুরের দিকে বাড়ির সামনের রাস্তায় পাহাড়ি ঢলের পানির তোড়ে ভেসে গিয়ে ডুবে মারা যায়।

[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা, সিলেট অফিস, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি, হবিগঞ্জ প্রতিনিধি, সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি, নীলফামারী প্রতিনিধি, গাইবান্ধা প্রতিনিধি, লালমনিরহাট প্রতিনিধি, নেত্রকোনা প্রতিনিধি, কুলাউড়া (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি, কলমাকান্দা (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি)]

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat