রাত পোহালেই খুশির ঈদ। শেষ মুহূর্তে এসে রাজধানীর অলিগলিতে তাকালেই দেখা মিলছে গরু হাতে মনের আনন্দে বাড়ি ফিরছেন ক্রেতারা। আবার মেরাদিয়া ও বনশ্রীর মতো বিভিন্ন এলাকার অলিগলিতেও কোরবানির গরু নিয়ে বসে থাকতে দেখা গেছে বিক্রেতাদের। যদিও দাম পড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় শনিবার (১৫ জুন) রাতেই অনেক ব্যাপারী গরু বিক্রি করে দিয়েছেন।
রোববার (১৬ জুন) বেশ কয়েকজন খামারি ও ব্যাপারীর সঙ্গে কথা বললে তারাও জানান, এবার আতঙ্কের মধ্যে গরু বিক্রি করে দিয়েছেন তারা।
বেলা সাড়ে ১১টায় দক্ষিণ বনশ্রীর দশতলার সামনে বসে কথা হচ্ছিল শুক্কুর আলী নামের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘হাটে মাপবিহীন গরু উঠেছে।’ অর্থাৎ হাটে অতিরিক্ত সংখ্যক গরু উঠেছে।
নাটোর থেকে রাজধানীর মেরাদিয়া পশুর হাটে ৩৪টি গরু নিয়ে এসেছেন তিনি। ধানের খড় বিছিয়ে ক্রেতার অপেক্ষায় বসেছিলেন। গতকাল বাজার ভর্তি কোরবানির পশু ছিল। এক রাতের ব্যবধানে সব উধাও হয়ে গেল। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পাড়াপাড়ি করে বেঁচে সাফ করে দিয়েছে সবাই।’
‘কার আগে কে বিক্রি করেন’ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে দাবি করেন এই বিক্রেতা। তিনি বলেন, লোকজন তাড়াহুড়ো করে পশু বিক্রি করে দিয়েছেন।
যে কারণে শনিবার রাতে পুরো বনশ্রী ও মেরাদিয়া এলাকায় পশু বিক্রির ধুম পড়েছিল। লোকজন একের পর এক গরু নিয়ে যাচ্ছিলেন, আশপাশের লোকজন ডেকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘দাম কত পড়েছে ভাই?’ ক্রেতারাও তখন আনন্দের সঙ্গে দাম বলছিলেন।
তিনি বলেন, খুব একটা লাভে কেউ বিক্রি করতে পারেননি। দুয়েকটা গরু থেকে হাজার দশেক টাকা এসেছে। দুই হাজার, এক হাজার—এর চেয়ে বেশি লাভ খুব কমই হয়েছে।
পালতে যে টাকা খরচ হয়েছে, সেটা উঠলেই খামারিরা গরু ছেড়ে দিয়েছেন বলে দাবি করেন এই ব্যবসায়ী। এবার মেরাদিয়া হাটে তিনি ৩৪টা গরু নিয়ে এসেছিলেন। একটা বাদে সব বিক্রি হয়ে গেছে।
যে গরুটি এখনো বিক্রি হয়নি, সেটিতে ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা লোকসান হবে বলে দাবি করেন তিনি। এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘এক লাখ ৫৫ হাজার টাকা দিয়ে গরুটি কেনা হয়েছিল। এখন ক্রেতারা দাম বলছেন এক লাখ ১০ হাজার টাকা।’
বিক্রেতারা দাম বেশি চাইলেও সেই অনুসারে বেচতে পারছেন না বলে দাবি করে তিনি আরও বলেন, আমরা বেশি দাম চাইলেও ক্রেতারা দাম কম বলছেন। গত বছরে অনেক টাকা লাভ হয়েছিল। এবার হয়নি।
‘বর্তমানে যে গরু বাজারে আছে, ক্রেতারা যদি একটা একটা করে নিয়ে যান, তাহলে তো গরুই পাবে না,’ বলেন শুক্কুর আলী।
আগামীকাল সোমবার কোরবানির ঈদ। যে কারণে ব্যবসায়ীদের যেমন বিক্রির তাড়া আছে, ক্রেতাদেরও তর সইছে না। পছন্দের পশু কিনে তারা আল্লাহর খুশির জন্য তা কোরবানি দেবেন। যদিও অনেকে ঈদের দিন সকালেও পশু কিনে থাকেন, কিন্তু সেই সংখ্যাটি খুব বেশি না।
বৃহস্পতিবার (১৩ জুন) থেকে শুক্রবার (১৪ জুন) পর্যন্ত ক্রেতা-বিক্রেতা দুই পক্ষই দাম যাচাইয়ের চেষ্টা করেছেন। বিক্রেতারা একটু বেশি দামই চেয়েছেন এই কয়দিন।
শহিদুল ইসলাম (৫৫) নামে আরেক খামারিও দাবি করেন, প্রত্যাশা অনুসারে তাদের বেচাবিক্রি হয়নি। সামান্য লাভে গরু ছেড়ে দিতে হয়েছে।
তিনি বলেন,
রাতেই বাজারের সব গরু বিক্রি হয়ে গেছে। সকালে নতুন করে পশু আনা হয়েছে। মেলা গ্রাহক আছে।
ব্যবসায়ীরা লোকসনের কথা শোনালেও ক্রেতারা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের দাবি, পশুর দাম বিক্রেতারা অনেক বেশি চাচ্ছেন। রাজধানীর ত্রিমোহনী থেকে পশু কিনতে এসেছেন বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা মোফাজ্জল হোসেন (৪০)।
তিনি বলেন,
গতবারের চেয়ে এবারে পশুর দাম অনেক বেশি। একটা গরুর দিকে ইশারা করে তিনি বলেন, এটা এক লাখ ২৫ হাজার টাকার বেশি হওয়ার কথা না। কিন্তু সেটা এক লাখ ৩৯ হাজার টাকায় কিনেছি।
আফতাপনগর পশুর হাট বন্ধ থাকায় মেরাদিয়া বাজারে চাপ বেড়েছে। এতে বিক্রেতারা বেশি দাম হাঁকছেন বলে দাবি করেন এই ক্রেতা।
দক্ষিণ বনশ্রীতে মাটিতে নাড়াকুটো বিছিয়ে বসেছিলেন কুষ্টিয়া থেকে আসা আরেক ব্যবসায়ী মোকসেদ আলী (৫৫)। গেল বছরেও তিনি এই বাজারে গরু তুলেছিলেন। নিজের সবচেয়ে বড় গরুটি দেখিয়ে এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘এটি প্রথম যখন বাজারে তুলি, তখন ক্রেতারা তিন লাখ টাকা বলেছিলেন। দুই দিন পরে এটার দাম বলেছেন দুই লাখ ৯০ হাজার টাকা। এখন দুই লাখ ২০ কিংবা ১০ হাজার টাকার মতো বলছেন। আমাদের ভুলের জন্যই এটা হয়েছে। বড় ওজনওয়ালা গরু আগেই ছেড়ে দেয়া উচিত ছিল।’
কুষ্টিয়া থেকে মেরাদিয়ার বাজারে গরু নিয়ে এসেছেন তিনি। যে করে হোক, আজই তাকে কুষ্টিয়ায় চলে যেতে হবে জানিয়ে এই ব্যবসায়ী বলেন, খরচ উঠলেই আমরা চলে যেতাম। গরুটি উৎপাদনে যে খরচ হয়েছে, সেই দামে বিক্রি করে দিতে পারলেই বেচে দেবেন বলে বোঝাতে চেয়েছেন এই ব্যবসায়ী।
এক ক্রেতা এসে গরুটির মাথায় হাত রেখে দাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তিন লাখ ৩০ হাজার টাকা।’ কিন্তু পাল্টা দাম না বলেই ওই ক্রেতা চলে যান।
শেষ সময়ে জমে উঠেছে কোরবানির পশুর হাট। ছবি: সময় সংবাদ
এবার বাজারে অনেক গরু উঠেছে বলে দাবি করেন এই বিক্রেতা। ঢাকার ডেমরা থেকে ২৩টি গরু নিয়ে এসেছেন সেলিম হোসেন নামের এক খামারি। তিনি বলেন, আমার খামারে ৪২টি গরু আছে। তার মধ্যে ২৩টি বাজারে তুলেছি।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি বলেন, এবার ভালো দাম পাওয়া যায়নি। গতকাল রাতে কিছু টাকা ব্যবসা করতে পেরেছি। চার-পাঁচটা গরুতে গড়ে পাঁচ হাজার টাকা করে লাভ হয়েছে। কিন্তু ভয়ে গরু ছেড়ে দিয়েছি। যখন দেখি বাজার নামছে, তখন গরু ধরে রাখার সাহস করিনি।
তার আগের দিনগুলোতে লোকসানে ছিলেন বলে জানান এই ব্যবসায়ী। লোকসান বলতে নিজেদের শ্রম ও লালন-পালনের খরচ ওঠে হাজারখানেক টাকা লাভ হয়েছে। এটা তো কোনো লাভ না।
এখন সবকিছুর দাম অনেক বেশি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গরুর খাবারের দাম অনেক বেশি। যে গরুর খামার করছে, সে জানে কত খরচ লাগে। যার খামার নেই, তিনি জানবেনই না, এক কেজি ভুসির দাম কত। যে কারণে ক্রেতাদের জিজ্ঞাসা করলে বলেন যে গরুর দাম বেশি।
এ জাতীয় আরো খবর..