সমুদ্রে আমদানি ও রপ্তানি পণ্য পরিবহনে বাড়ছে দেশীয় কম্পানির লাল-সবুজের পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা। এর মধ্যে শততম জাহাজ হিসেবে নাম লিখিয়েছে শিল্প গ্রুপ কবির স্টিল রি-রোলিং মিলস (কেএসআরএম) লিমিটেডের প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিং লিমিটেডের ‘এমভি জাহান-১’। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের ‘এমভি বাংলার জ্যোতি’ জাহাজ দিয়ে সমুদ্রে লাল-সবুজের পতাকা ওড়ানোর যাত্রার শুরু হয়েছিল। এখন সমুদ্রে কনটেইনারবাহী, কার্গো, এলপিজি, কেমিক্যাল ও অয়েলট্যাংকারবাহী জাহাজের সংখ্যা শতক পার করেছে।
এ খাতে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার। সমুদ্রে লাল-সবুজের পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা বাড়ার কারণে বহির্বিশ্বে বাড়বে বাংলাদেশের সুনামও।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর না থাকায় চট্টগ্রাম বন্দরে বড় কনটেইনারবাহী জাহাজ ভিড়তে পারে না। ফলে আন্তর্জাতিক রুটে কনটেইনারবাহী পণ্য পরিবহনের জন্য ছোট জাহাজের ওপর নির্ভর করতে হয়।
এসব জাহাজে করে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কনটেইনারবাহী পণ্য নিয়ে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, চীনসহ বিভিন্ন দেশের বন্দরে ট্রানজিট সুবিধায় রপ্তানি পণ্য নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানো হয়। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও চীনের বন্দরগুলোতে বিদেশি ফিডার অপারেটর কনটেইনার জাহাজের মাধ্যমে ট্রানজিট রুটে পণ্য পরিবহন করে।
বাংলাদেশ সমুদ্র বাণিজ্য অধিদপ্তরের তালিকা অনুযায়ী, ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে সাগরে প্রথম পণ্য পরিবহনের জন্য ছাড়পত্র পায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের জাহাজ ‘বাংলার জ্যোতি’। এখন সমুদ্রে পণ্য পরিবহন করে কার্গো পণ্যবাহী জাহাজ রয়েছে সর্বোচ্চ ৭৭টি।
আর কনটেইনারবাহী জাহাজ আছে ৯টি, অয়েলট্যাংকার রয়েছে সাতটি, কেমিক্যাল ট্যাংকার পাঁচটি আর এলপিজি বহনকারী জাহাজ আছে তিনটি। এখন মোট জাহাজের সংখ্যা ১০১টি। এর মধ্যে ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে জাহাজ ছিল ৭৩টি। ২০১৮ সালে ৩৭টি, ২০১৭ সালে ৩৮টি ও ২০১৬ সালে ৪৫টি জাহাজ নিবন্ধিত হয়। বর্তমানে সমুদ্রে পণ্য পরিবহন করে এমন জাহাজের মধ্যে কবির গ্রুপের (কেএসআরএম) এসআর শিপিং ও মেঘনা গ্রুপের বহরে রয়েছে ২৫টি মাদার ভেসেল (বড় জাহাজ)।
এসব জাহাজ সাগরে খোলা পণ্য পরিবহন করে। আকিজ গ্রুপের ১০টি, এইচ আর শিপিং আটটি, শিপিং করপোরেশনের সাতটি, ভ্যানগার্ড গ্রুপের সাতটি, দেশে শীর্ষ শিল্প গ্রুপ বসুন্ধরার রয়েছে ছয়টি, তিনটি করে বিএসএ শিপিং ও এমআই সিমেন্ট জাহাজ, দুটি করে জাহাজ রয়েছে ডুরিয়া শিপিং ও হানিফ মেরিটাইমের। একটি করে জাহাজ রয়েছে ওরিয়ন, মবিল-যমুনা, পিএনএন শিপিং ও অ্যাডভান্সড শিপিং ও ডরিন শিপিংয়ের বহরে। নিবন্ধিত জাহাজের বাংলাদেশি পতাকাবাহী সমুদ্রগামী জাহাজের বেশির ভাগই ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টন পণ্য পরিবহন সক্ষমতার। এর বাইরে রয়েছে কনটেইনারবাহী ফিডার জাহাজ, যা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সিঙ্গাপুর ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে কনটেইনার পরিবহনে নিয়োজিত রয়েছে। এক লাখ টন তেল পরিবহনকারী অনেক বড় একটি জাহাজ রয়েছে মেঘনা গ্রুপের। এ ছাড়া বসুন্ধরা গ্রুপের বহরে রয়েছে এলপিজি পরিবহনকারী বড় জাহাজ।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যে দেখা যায়, দেশের শিল্পগ্রুপগুলো পণ্য পরিবহন করতেই জাহাজে বিনিয়োগ শুরু করে। এ খাতে বিনিয়োগ এখন ১৪৪ কোটি ডলার বা বাংলাদেশি অর্থে ২০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে মেঘনা গ্রুপের বিনিয়োগ ৫০ কোটি ডলার। কবির গ্রুপের বিনিয়োগ প্রায় ২৯ কোটি ডলার। এ দুই গ্রুপের দখলে রয়েছে ৫০টি জাহাজ। বাকি ৫০টিতে বিনিয়োগ রয়েছে ৬৫ কোটি ডলার। ২০২৩ সাল পর্যন্ত সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যায় শীর্ষে ছিল চট্টগ্রামভিত্তিক কবির গ্রুপ (কেএসআরএম)। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মেঘনা গ্রুপ। এর মধ্যে কবির গ্রুপের বহরে নতুন করে যুক্ত হয়েছে জাহাজ ‘এমভি জাহান-১’। যেটি শততম জাহাজ হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছে বাংলাদেশ সমুদ্র বাণিজ্য অধিদপ্তরে। এর মধ্যে মেঘনা গ্রুপ ‘মেঘনা সেঞ্চুরি’ আর ভ্যানগার্ড গ্রুপ ‘রয়েল আরাকান’ জাহাজ সাগরে নামাতে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে।
গত ৭ জুন ইন্দোনেশিয়ার মেয়ারা ওয়ানতাই বন্দর থেকে বাঁশখালীতে অবস্থিত এস আলম গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রায় ৬০ হাজার টন কয়লা নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছে ‘জাহান-১’। গত সপ্তাহে জাহাজটি সরেজমিনে সার্ভে বা জরিপ করতে যান জাহাজ নিবন্ধনকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান রেজিস্ট্রার অব শিপস বাংলাদেশের প্রধান ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ। তিনি বলেন, শততম জাহাজ হিসেবে নিবন্ধন পেতে আবেদন করেছিল দেশের মেঘনা গ্রুপ, কবির গ্রুপ ও ভ্যানগার্ড গ্রুপ। অবশেষে দেশের শততম জাহাজ হিসেবে কবির গ্রুপের ‘এমভি জাহান-১’ জাহাজটি চূড়ান্ত নিবন্ধন পেয়েছে। ফলে এ খাতে বিনিয়োগ আরো বাড়ল। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ৩৬১টি সমুদ্রগামী জাহাজের নিবন্ধন হয়েছে। এর মধ্যে ১০১টি জাহাজ এখন বহরে রয়েছে। বাকি জাহাজ চলাচলের অনুপযোগী হওয়ায় ভাঙার জন্য বিক্রি হয়েছে।
কবির গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কবির গ্রুপের এসআর শিপিংয়ের বহরে ওশান গোয়িং জাহাজ ‘এমভি জাহান-১’ যুক্ত হয়েছে। জাহান-১ জাহাজটির আগে নাম ছিল ‘এমভি নর্ড প্যাসিফিক’। ইন্দোনেশিয়া থেকে জাহাজটি এস আলমের বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ৫৯ হাজার ৮০০ টন কয়লা বোঝাই করে রওনা দিয়েছিল গত ২৬ মে। চট্টগ্রাম বন্দরে আসে গত ৭ জুন। কবির গ্রুপ পরিচালনাধীন সব জাহাজে কাজ করে থাকেন বাংলাদেশি নাবিকরা। এতে করে মেরিন একাডেমি থেকে পাস করা নাবিকদের নিশ্চিত কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। ‘জাহান-১’-এ ২৩ নাবিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। ফলে অর্জিত হয় প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম সোহায়েল বলেন, ‘দেশের পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা বাড়লে, এ খাতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানও বাড়বে। ফলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সুনামও বাড়ছে।’
এ জাতীয় আরো খবর..