২০২৩ সালে মার্চে দেশে ব্যাংক খাতের বাইরে বা মানুষের হাতে নগদ অর্থ ছিল দুই লাখ ৫৪ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা। ঠিক এক বছর পর চলতি বছরের মার্চের শেষে মানুষের হাতে নগদ অর্থের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৬১ হাজার ১৯৫ কোটিা টাকা। অর্থাৎ এক বছরে নগদ অর্থ বাড়ল ৬ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
নগদ অর্থ বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহে মানুষ ব্যাংকের সঞ্চয় ভেঙে ফেলছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ নূরুল আমিন বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ বৃদ্ধির কারণে মানুষের খরচ বেড়েছে।
দীর্ঘ সময় ধরে চলা উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ব্যাংকের সঞ্চয় ভাঙিয়ে খাচ্ছে মানুষ। সাধারণ আমানতকারীরা ব্যাংক থেকে টাকা তুললেও ব্যাংকে নতুন করে তেমন জমা দিচ্ছে না।
এতে ক্রমে বাড়ছে ব্যাংকবহির্ভূত টাকার পরিমাণ। এ ছাড়া মার্জারের খবরে ব্যাংকে টাকা রাখতে ভয় পাচ্ছেন আমানতকারীরা। ফলে ব্যাংক থেকে মানুষ সঞ্চয় ভেঙে ফেলছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহ করছে।
স্বল্প সময়ে ও সহজে এই সংকট কাটবে বলে মনে হচ্ছে না। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ ঠিক থাকলে এবং নিত্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক হলে ব্যাংকের আমানত আগের অবস্থানে ফিরবে বলে মন্তব্য করেন এই জ্যেষ্ঠ ব্যাংকার।
এদিকে সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দেশে মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ১০ শতাংশ। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস, সানেম, সিপিডি) বলছে, এই হার ১৫ শতাংশের ওপরে। মূল্যস্ফীতির সরাসরি প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের জীবনে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি, স্বল্প সুদহার এবং ব্যাংক খাতের নেতিবাচক খবরের কারণে মানুষের হাতে নগদ অর্থ বেড়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির ফলে মানুষের জিনিসপত্র কিনতে আগের চেয়ে বেশি টাকা লাগছে। তাই মানুষ টাকা হাতে রাখছে, যাতে প্রয়োজনে সহজেই খরচ করা যায়; বাড়তি ঝামেলায় পড়তে না হয়। এটা অর্থনীতির জন্য শুভ নয়। ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থ বৃদ্ধি অর্থনীতির জন্য ক্ষতি।
দুর্বল ব্যাংক সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত (মার্জার) করা নিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলোর আমানতকারীদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। মার্জার হলে ‘তাদের টাকার কী হবে’—এই ভয়ে অনেকেই তাদের টাকা তুলে নেওয়ায় ব্যাংক খাতে আমানত কমেছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
শুধু তা-ই নয়, সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। কারণ সঞ্চয়পত্র মেয়াদপূর্তির পর যে হারে ভাঙানো হচ্ছে, সেই হারে নতুন বিনিয়োগ বাড়ছে না। গত ৯ মাসে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ না বেড়ে কমেছে অর্থাৎ ঋণাত্মক (নেগেটিভ) প্রবৃদ্ধি হয়েছে। একসময় কোনো স্কিমের মেয়াদ শেষ হলে বেশির ভাগ গ্রাহক আবার সেখানেই বিনিয়োগ করত।
কিন্তু এখন যাদের সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ শেষ হচ্ছে তারা আর নতুন করে এখানে বিনিয়োগ করছে না। ফলে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। এখন বিক্রির চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদাসল পরিশোধ বেশি করা হচ্ছে।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সর্বশেষ মার্চ মাসে নিট বিক্রি ঋণাত্মক হয়েছে তিন হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা। আর চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) নিট বিক্রি ঋণাত্মকের পরিমাণ ১২ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ যত টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, তা দিয়ে গ্রাহকদের আগে বিনিয়োগ করা সঞ্চয়পত্রের সুদাসল পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। উল্টো তিন হাজার ১০৭ কোটি টাকা সরকার তার কোষাগার ও ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করেছে।
দেশে বর্তমানে চার ধরনের সঞ্চয়পত্র রয়েছে। পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১১.৫২, পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১১.৭৬, পাঁচ বছর মেয়াদি মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১১.২৮ এবং তিন বছর মেয়াদি ও তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১১.০৪ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সব শাখা অফিস, বাণিজ্যিক ব্যাংকের নির্ধারিত শাখা, জাতীয় সঞ্চয় ব্যুরো অফিস ও পোস্ট অফিস থেকে সঞ্চয়পত্র কেনা যায়।
এ জাতীয় আরো খবর..