জাতীয় পর্যায়ের মতো স্থানীয় নির্বাচনেও জনস্বার্থ ব্যাপকভাবে উপেক্ষিত বলে দাবি করেছে টান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। জনপ্রতিনিধিত্বের নামে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে সম্পদের বিকাশই মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেছে সংস্থাটি।
রবিবার (৯ জুন) ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রার্থী ও বিজয়ীদের হলফনামার তথ্য বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ প্রকাশ উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনে এই মন্তব্য করে টিআইবি।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী ও বিজয়ী প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে ড্যাশবোর্ড প্রস্তুত করেছে টিআইবি।
হলফনামা বিশ্লেষণে বলা হয়, গত পাঁচ বছরে একজন জনপ্রতিনিধির আয় বেড়েছে সর্বোচ্চ ৩১ হাজার ৯০০ শতাংশ। তাদের স্ত্রী, স্বামী ও নির্ভরশীলদের সম্পদ বেড়েছে সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৪০০ শতাংশ।
একজন চেয়ারম্যানের অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ১১ হাজার ৬৬৬ শতাংশ। ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে একজন বিজয়ীর গত পাঁচ বছরে আড় বেড়েছে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ৮৬৬.৬৭ শতাংশ এবং অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে সর্বোচ্চ ২৩ হাজার ৯৩৭.৬৫ শতাংশ।
বিশ্লেষণে ক্ষমতায় থাকার সঙ্গে দ্রুত আয় ও সম্পদ বাড়ার প্রবণতাও স্পষ্টভাবে দেখানো হয়েছে। টিআবি বলছে, আদর্শিক ও জনকল্যাণমূখী জনপ্রতিনিধিত্বের কোনঠাসা অবস্থায় দেশের সুশাসন, গণতন্ত্র ও দুর্নীতিবিরোধী কাঠামো ও সক্ষমতার ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মুখে।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'জনপ্রতিনিধিত্বের নামে ক্ষমতার অপব্যবহার কেন্দ্রিক অসুস্থ প্রতিযোগিতার বিকাশ ঘটছে। জনপ্রতিনিধিত্বের অবস্থানকে আনুষ্ঠানিক-আনুষ্ঠানিকভাবে, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ও বিভিন্ন যোগসাজসে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অর্থ ও সম্পদ বৃদ্ধির লাইসেন্স হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
যারা জনকল্যাণমূখী আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করতে চাইছেন, এমন পরিস্থিতিতে তারা নিজেদের কোনঠাসা ভাবছেন। রাজনৈতিক দলসমূহ ক্ষমতা অপব্যবহারের সুযোগ এমন ব্যাপকভাবে তৈরি করে দিচ্ছে যে, তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই ভূমিকা রাখতে হবে।'
সংবাদ সম্মেলনে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ব্যবসায়ীদের আধিক্য বাড়ার হার দেখিয়েছে সংস্থাটি। বিশ্লেষণে বলা হয়, জাতীয় নির্বাচনের মতো উপজেলা নির্বাচনেও ব্যবসায়ী প্রার্থীদের দাপট অক্ষুণ্ণ রয়েছে।
ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চতুর্থ নির্বাচনের তুলনায় ব্যবসায়ী প্রার্থী ৮ শতাংশ বেড়ে ৫৭.৩৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৬৯ শতাংশ, ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী প্রায় ৬৮.১৬ শতাংশ ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ২৮ শতাংশ ব্যবসাকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন।
নির্বাচিতদের মধ্যে ব্যবসায়ীদের হার ৫ বছরে বেড়েছে ৬.৫ শতাংশ এবং চেয়ারম্যানদের প্রায় ৭৯ শতাংশই ব্যবসায়ী। নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৫০.৯৬ শতাংশ নিজেকে গৃহিণী বা গৃহস্থালি কাজকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন। এসব পেশা হিসেবে দেখানো প্রার্থীদের ১৫.৬৮ শতাংশের আয় আসে ব্যবসা থেকে। আবার, ১৫.৭৯ শতাংশ প্রার্থীর কোনো না কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। নির্বাচিতদের ক্ষেত্রে এ হার ২০ শতাংশ।
পাঁচ বছরে কোটিপত প্রার্থী বেড়েছে ৩ গুণের বেশি
ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দেওয়া হলফনামা বিশ্লেষণে জানানো হয়, ৭.১৩ শতাংশ বা ৩৯০ জন প্রার্থীর সম্পদ কোটি টাকার বেশি। গত পাঁচ বছরে কোটিপতি প্রার্থীর সংখ্যা বেড়েছে তিন গুণের বেশি। নির্বাচিতদের ১২.৩৭ শতাংশ বা ১৫০ জন এবং নির্বাচিত চেয়ারম্যানদের ৩০.৪১ শতাংশ বা ১৩২ জন কোটিপতি।
চেয়ারম্যান ও অন্যান্য প্রার্থীদের আয়ে উল্লেখযোগ্য বৈষম্য
হলফনামা বিশ্লেষণে টিআইবি জানায়, চেয়ারম্যান প্রার্থীদের প্রায় ২৩ শতাংশের আয় সাড়ে ষোল লাখ টাকার বেশ। এই আয় দেখিয়েছেন অন্যান্য প্রার্থীদের ৩.০৩ শতাংশ। বছরে ১০ লাখ টাকা আয় করেন এমন নির্বাচিত প্রার্থীর সংখ্যা ২৮০ জন। নির্বাচিত চেয়ারম্যানদের ৫১ শতাংশ বছরে এই আয় করেন। বছরে ১ কোটি টাকা আয় করেন এমন নির্বাচিত প্রার্থীর সংখ্যা ৪০ জন। এর মধ্যে ২ জন ভাইস চেয়ারম্যান, অন্যান্যরা সবাই চেয়ারম্যান। আবার, আইনি সীমা ১০০ বিঘা বা ৩৩ একরের বেশি জমি আছে ২৫ জন প্রার্থীর এবং তাদের ৭ জন নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। আইনি সীমার বাইরে প্রার্থীদের সর্বমোট জমির পরিমাণ ৮৭৪ একর।
সংস্থাটির দাবি, প্রায় ৮৪ শতাংশ প্রার্থীর হলফনামায় তথ্যের সাথে আয়কর বিবরণীর তথ্যের অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। আবার ৪০ শতাংশ প্রার্থীর প্রদত্ত তথ্যমতে তাদের করযোগ্য আয় নেই, যা অবিশ্বাস্য মনে হওয়া অযৌক্তিক নয়। এই অসামঞ্জস্যসমূহ, বিশেষ করে আয় ও সম্পদের বিকাশ বৈধ আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি-না, তা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন, দুদক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মতো সংস্থার।
এ জাতীয় আরো খবর..