বৈদেশিক বিনিয়োগ একটি দেশের আর্থিক ইঞ্জিনের জন্য শক্তিশালী জ্বালানি, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলো এই বিনিয়োগ বা এফডিআইয়ের অধিক সুবিধা পায়। কারণ এতে দেশগুলোর পুঁজি অর্জন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি এবং মানুষের সক্ষমতা ও দক্ষতা বিকাশের সক্ষমতা বাড়ে। বিশ্ব এখন রূপান্তরিত হচ্ছে।
প্রথমবারের মতো বিশ্ব একটি বহুমেরু বিশ্বব্যবস্থা দেখছে। এটি আমাদের মতো দেশগুলোর জন্য নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। তবে চমৎকার কিছু সুযোগেরও উদ্রেক করছে, যা আমাদের মতো দেশের জন্য অনেক সুবিধাও বয়ে আনতে পারে। তবে সুবিধা অর্জনের এই প্রচেষ্টায় নীতিনির্ধারণী সহায়তা ও সুশাসিত বিনিয়োগ পরিবেশ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
সরকার প্রদত্ত রূপকল্প ২০৪১ অনুযায়ী বাংলাদেশকে একটি উত্কর্ষিত অর্থনীতিতে পরিণত হতে হলে বার্ষিক জিডিপির ১.৬৬ শতাংশের সমপরিমাণ এফডিআই পেতে হবে। ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ বার্ষিক গড় এফডিআই পেয়েছে ২৯২ কোটি ডলার। আঙ্কটাডের ২০২৩ সালের বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদন অনুযায়ী, জিডিপির শতকরা হিসাবে এফডিআই প্রবাহের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। এটি কিছুটা বিস্ময়কর।
কারণ বাংলাদেশ এই অঞ্চলের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি।
বিস্ময় চরমে পৌঁছায় যখন জানি যে বাংলাদেশ গত দুই দশকে গড়ে ৬ শতাংশ বার্ষিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। তা সত্ত্বেও মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা থেকে পিছিয়ে। মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা কেবল ২০২২ সালেই যথাক্রমে নিজ জিডিপির ১১ শতাংশ ও ১ শতাংশেরও বেশি এফডিআই অর্জন করেছে। আমরা জানি যে মালদ্বীপ প্রকৃতপক্ষে একটি একক শিল্প অর্থনীতি এবং কয়েক বছর আগেই শ্রীলঙ্কা একটি বড় অর্থনৈতিক বিপদ সামলে উঠল।
তা সত্ত্বেও এই দুই দেশ বাংলাদেশ থেকে এফডিআই অর্জনে এগিয়ে।
অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ আমাদের জন্য শঙ্কায় পরিণত হতে চলেছে যেন। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়াতে একাধিক উদ্যোগ নিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানি নিয়ন্ত্রণ, রেমিট্যান্সের ওপর প্রণোদনা প্রদান, অফশোর হিসাব (বৈদেশিক মুদ্রা হিসাব) খোলার অনুমোদন ও এতে প্রণোদনা প্রদানসহ আরো অনেক নির্দেশনা দিয়েছে।
আমদানি কমানোর বিষয়ে সহজ যুক্তি হচ্ছে, আমরা যদি আমদানি কমাতে শুরু করি, তাহলে ছয় থেকে ৯ মাসের মধ্যে আমদানির জন্য মূল্য পরিশোধের বাধ্যবাধকতা কমে যাবে। এই পন্থা বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে রাখায় কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। তবে আমদানি কমানোর এই পন্থা আমাদের রপ্তানি খাত ও নিত্যপ্রয়োজনীয় আমদানির ওপর প্রভাব ফেলছে। আমদানি কমে যাওয়ায় সেটা উৎপাদনকারী কারখানার কাঁচামালের মজুদে প্রভাব ফেলে। এতে উৎপাদনে বৈরী প্রভাব পড়বে এবং ফলে রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফলাফল বৈদেশিক মুদ্রা আয় হ্রাস পাবে।
দেশের আর্থিক অনিশ্চয়তা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিতেও বাধ্য করেছে। তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই সতর্কতামূলক পদক্ষেপের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক আবার যেন কিছু স্ববিরোধী সিদ্ধান্তও নিয়েছে। একদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে অগ্রাধিকার হিসেবে উল্লেখ করা হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছু শরিয়াভিত্তিক ব্যাংককে সহায়তা করার জন্য টাকা ছাপিয়েছে, যা অবধারিতভাবে মুদ্রাস্ফীতি ত্বরান্বিত করেছে।
আমাদের আমদানি ব্যয় পরিশোধের বাধ্যবাধকতা বজায় রাখার জন্য, বৈদেশিক ঋণ (বর্তমান ও ভবিষ্যৎ) এবং অন্যান্য বাহ্যিক পেমেন্ট পূরণের জন্য, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার টেকসই এবং ক্রমবর্ধমান প্রবাহ প্রয়োজন। প্রবাহ বৃদ্ধির সবচেয়ে টেকসই উপায় হলো রপ্তানি বৃদ্ধি। রপ্তানি বাজার, রপ্তানি পণ্য বৃদ্ধি ও সমৃদ্ধ করা। প্রবাহ বৃদ্ধির আরেকটি কার্যকর ও টেকসই উপায় হলো এফডিআই বাড়ানো। এ ক্ষেত্রে আমরা অনেকটা পিছিয়ে আছি।
সরকার অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাই-টেক পার্ক এবং ওয়ানস্টপ ডিজিটাল সার্ভিস প্রতিষ্ঠার মতো উদ্যোগ নিয়েছে। তবে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো অর্থাৎ সড়ক, গ্যাস, বিদ্যুৎ ইত্যাদির অভাবে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অসহযোগিতামূলক বাণিজ্যিক পরিবেশ, যা আমরা ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান দেখলেই অনুধাবন করতে পারি।
এবার আরেকটি বিষয় নিয়ে একটু কথা বলি। ফিচ রেটিং এজেন্সি বাংলাদেশকে ডাউনগ্রেড করেছে, যা সম্ভাব্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য নেতিবাচক বার্তা বহন করে। যেসব বিদেশি বিনিয়োগকারী বাংলাদেশকে তাদের পরবর্তী সম্ভাব্য বিনিয়োগ গন্তব্য হিসেবে বিবেচনা করছিলেন, ফিচের ডাউনগ্রেডের সিদ্ধান্ত তাদের নিরুৎসাহ করবে। এতে আমাদের বিনিয়োগ আকর্ষণের সম্ভাব্যতাই শুধু হ্রাস পেয়েছে। অর্থাৎ চ্যালেঞ্জ আরো বেড়েছে।
এ পর্যন্ত যা আলোচনা করলাম তা আমাদের আর্থিক খাত, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং বিদেশি বিনিয়োগ পরিস্থিতির যে চিত্র ফুটে ওঠে তা নিশ্চিতরূপেই আশঙ্কাজনক। তন্মধ্যে ব্যাংক আলফালাহ’র সংবাদ আমাদের জন্য যেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো কাজ করছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতকেন্দ্রিক ব্যাংক, যা বাংলাদেশে যথেষ্ট ভালো ও লাভবান ব্যবসা পরিচালনা করছে, তা সত্ত্বেও তারা বাংলাদেশের এক স্থানীয় ব্যাংকের কাছে নিজ অংশ বিক্রি করে, পাকিস্তানে আরেকটি ব্যাংক ক্রয় করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। তাদের এই সিদ্ধান্ত আমাদের এফডিআই আকর্ষণের সক্ষমতাকে আরো দুর্বল করবে।
প্রশ্ন হলো, লাভজনক হওয়া সত্ত্বেও তারা ব্যাংক বিক্রি করে, বাংলাদেশের চেয়েও দুর্বল অথনীতি ও আর্থিক পরিস্থিতির শিকার পাকিস্তানে গিয়ে আরেকটি ব্যাংক ক্রয় করছে কেন? বাংলাদেশে বিনিয়োগের চিন্তা-ভাবনা করছে এমন সম্ভাব্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে এটা এক বিরাট প্রশ্ন হয়ে দেখা দেবে, যা তাদের আরো নিরুৎসাহ করবে। আল ফালাহর এই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে যা-ই থাকুক না কেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সবার মনেই বিষয়টা আরো সন্দেহের উদ্রেক করবে শুধু। আল ফালাহর সব শেষ প্রতিবেদনে জানা যায় যে ব্যাংকটি বেশ লাভজনক অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশে। তা সত্ত্বেও আরো দুর্বল একটি রাষ্ট্রে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ সম্পর্কে বিদেশি ফোরামে যে বার্তা প্রদান করে, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এতে বিদেশি মুদ্রার প্রবাহে তো প্রভাব পড়বেই, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে আরো প্রশ্নবিদ্ধ করবে। আরো একটি বিষয় হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের মিত্র রাষ্ট্র হিসেবেই পরিচিত। সেই রাষ্ট্রের একটি ব্যাংক, যা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে ভালো ব্যবসা সত্ত্বেও তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে যাচ্ছে, বিষয়টা ঠিক মেনে নেওয়া কঠিন।
মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিচারে ব্যাংকিং খাত বাংলাদেশের সবচেয়ে সুসংহত খাতের একটি। এখানে এভাবে একটি বিদেশি ব্যাংক চলে যাওয়া অনেক দক্ষ কর্মীর কর্মসংস্থানেও বিরূপ প্রভাব ফেলবে। সরকারের উচিত ব্যাংকের চলে যাওয়া বন্ধ করতে না পারলেও এই ব্যাংকের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারী যেন তাদের ন্যায্য ও আইনসিদ্ধ পাওনাটা পায় সেটা নিশ্চিত করা। এ ধরনের ব্যাবসায়িক পটপরিবর্তনের সময় অনেকেই যে তাদের ন্যায়সংগত পাওনা পায় না, সেটা আমাদের সবার জানা। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় এযাবৎ যে কর্মদক্ষতা ও সুসংহতির পরিচয় দেখিয়েছে, তার বিচারে এমন অন্যায় কারো সঙ্গে হতে দেওয়া বেদনাদায়ক হবে। একই সঙ্গে এই দক্ষ মানবসম্পদকে সঠিকরূপে কাজে লাগানোর বিষয়ও বাংলাদেশ ব্যাংকের চিন্তা করা উচিত।
বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য আমাদের দেশের বাণিজ্যিক পরিবেশ উন্নত করতে হবে। আমাদের দক্ষ শ্রম যেন সুরক্ষিত থাকে তাও নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা অর্থনীতিতে আরো বেশি অবদান রাখতে পারে। এখন আমরা নতুন অর্থবছরের বাজেটের দিকে এগিয়ে চলেছি, যা সম্ভবত অনেক অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং আর্থিক বিষয় সমাধানের প্রয়াস করবে। এটি আমাদের টেকসই ভবিষ্যতের জন্য আইএমএফ প্রগ্রামের ইচ্ছা তালিকার সঙ্গে সরাসরি প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলোও সমাধানে সচেষ্ট হবে। বাজেটে তাই এফডিআই আকৃষ্ট করার জন্য প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা এবং যথাযথ কর্মসূচির দিকেও মনোনিবেশ করা উচিত।
লেখক : রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক
এ জাতীয় আরো খবর..