রিজার্ভ কত আছে না আছে তার চেয়েও বড় বিষয় দেশের মানুষের চাহিদা পূরণ। এমন মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস উপলক্ষে গতকাল শুক্রবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনাসভায় তিনি এমন মন্তব্য করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, এবারের বাজেটে মানুষের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করার জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, দেশীয় শিল্প ও সামাজিক নিরাপত্তায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
এগুলো মানুষের জীবনকে উন্নত করবে।
তিনি বলেন, ‘আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু কভিড দেখা দিল। এর ফলে সারা বিশ্বে মন্দা দেখা দিল।
এর মধ্যেই ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ। স্যাংশন-পাল্টাস্যাংশনের ফলে সব কিছুর দাম বৃদ্ধি। গম, তেল, জ্বালানি, গ্যাসসহ অনেক কিছু আমাদের বাইরে থেকে আনতে হয়। রিজার্ভ কত আছে সেটা বিবেচনার বিষয় না, আমাদের মানুষকে খাওয়াতে হবে আগে।
রিজার্ভ কত আছে না আছে, সেটার চেয়ে বেশি দরকার আমার দেশের মানুষের চাহিদাটা পূরণ করা। সেদিকে লক্ষ রেখে আমরা পানির মতো টাকা খরচ করেছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ একমাত্র দেশ যেটা কোনো উন্নত দেশ করেনি, বিনা পয়সায় কভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন দিয়েছি, বিনা পয়সায় টেস্ট করিয়েছি। সেটা করেছি কেন? মানুষকে বাঁচাতে। চিকিৎসা বিনা পয়সায়, যে ডাক্তার চিকিৎসা করেছে তাদের প্রতিদিন আলাদা ভাতা দিতে হতো, এভাবে পানির মতো টাকা খরচ হয়েছে।
তারপর যখন দাম বেড়েছে, তখন ২০০ ডলারের গম ৬০০ ডলার করেও আমি কিনে নিয়ে এসেছি। ঠিক সেইভাবে ভোজ্য তেলের দাম বেড়েছে, উন্নত দেশগুলোও এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে।’
এবারের বাজেট প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘অনেকে বসে বসে হিসাব কষে, আগে এত পার্সেন্ট বেড়েছে, এবার কম পার্সেন্ট বাড়ল কেন? এখন সীমিতভাবে আমরা এগিয়ে যেতে চাই, যাতে আমাদের দেশের মানুষের কষ্ট না হয়। মানুষের যে চাহিদা সেটা যেন পূরণ করতে পারি, সেদিকে লক্ষ রেখেই আমরা বাজেট করেছি।’
বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটা প্রশ্ন আসছে, কালো টাকা নিয়ে। কালো টাকা নিয়ে আমি শুনি, কালো টাকা সাদা করলে আর কেউ ট্যাক্স দেবে না। ঘটনা কিন্তু এটা না, এটা শুধু কালো টাকা নয়। জিনিসের দাম বেড়েছে, এখন এক কাঠা জমি যার আছে সে-ই কোটিপতি। কিন্তু সরকারি যে হিসাব, সেই হিসাবে কেউ জমি বিক্রি করে না। বেশি দামে বিক্রি করে, এতে কিছু টাকা উদ্বৃত্ত হয়। এই টাকাটা তারা নিজেদের কাছেই রাখে। এবার আমরা চেয়েছি এমন ব্যবস্থা করতে, যাতে করে সামান্য কিছু টাকা দিয়ে তারা যেন সেটা আসল পথে নিয়ে আসে। আগে নিয়ে আসুক। তারপর তো ট্যাক্স দিতে হবে।... মাছ ধরতে গেলে তো আগে আধার দিতে হয়।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জাতির পিতার আদর্শ নিয়ে কাজ করেছি বলেই বাংলাদেশ আজ এগিয়ে যাচ্ছে। আজ গ্রাম পর্যায়ের মানুষের মাঝেও আর্থিক সচ্ছলতা দেখা দিয়েছে। আমরা আমাদের প্রবৃদ্ধি প্রায় ৮ ভাগের কাছাকাছি নিয়ে এসেছিলাম। মাথাপিছু আয় আমরা বাড়িয়েছি। কিন্তু ’৭৫-এর পর যারা সংবিধান লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে ক্ষমতায় এসেছে। বিশেষ করে ২১ বছর জিয়াউর রহমান, এরশাদ ও খালেদা জিয়া। এরপর ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত খালেদা জিয়া ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এই ২৯ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে পরিবর্তন, বাংলাদেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন এবং বাংলাদেশের অবকাঠামোগত যে উন্নয়ন তা কিন্তু কেউ করতে পারেনি। এটা হয়েছে কেবল আওয়ামী লীগ সরকারের সময়।’
তিনি বলেন, ‘৯৬ সালে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করি। বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি, সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ শুরু করি। যে পরিকল্পনা নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন ২০০১ সালে আমাদের ক্ষমতায় আসতে দেওয়া হয়নি। কারণ গ্যাস বিক্রি করতে চাইনি, এটাই ছিল আমার অপরাধ।’
তিনি বলেন, এরপর দেশটা দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও বাংলা ভাই ছিল নিত্য দিনের ব্যাপার। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছিল অস্ত্রের ঝনঝনানি। মেধাবী শিক্ষার্থীদের অস্ত্রধারী হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এটা প্রমাণিত হয়েছে, যে দল বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া, সেই দলের নেতৃত্বে যখন সরকার হয়, তখন মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়, ভাগ্যের দুয়ার খুলে যায়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা কারো কাছে হাত পেতে চলব না। ভিক্ষা করব না। এটাই আমাদের নীতি। বিশ্ব পরিস্থিতি মাথায় নিয়েই আমাদের পরিকল্পনায় চলতে হবে। আমাদের দেশে ভালো লাগে না গ্রুপ আছে, তাদের ভালো না লাগাই থাক—এগুলোতে কান দেওয়ার দরকার নেই। এটা যুগ যুগ ধরেই দেখছি, নতুন নয়। যখন কোনো অস্বাভাবিক সরকার আসে তারা খুব খুশি হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তারা খুশি ছিল। কারণ তখন নাকি তাদের গুরুত্ব থাকে। আর মানুষের ভোটে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তাদের নাকি মূল্যায়ন হয় না। আরে মূল্যায়নটা করব কিভাবে? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তো আমরা দেখেছি, তারা অগণতান্ত্রিক সরকারকে কিভাবে তেল মারে। আমাদের ওই তেল মারা গোষ্ঠীর দরকার নেই। আমাদের শক্তি দেশের জনগণ। জনগণ আমাদের ভোট দেয়, জনগণের জন্য কাজ করি। জনগণের কল্যাণ করি। এটাই আমাদের লক্ষ্য। আমরা সেইভাবে পদক্ষেপ নিই, যেন মানুষের কষ্ট না হয়। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের স্মরণ রাখতে হবে—আওয়ামী লীগের একমাত্র শক্তি দেশের জনগণ।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘অনেক জায়গায় অনেক খেলা খেলতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু জনগণ আমাদের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রেখেছে। তাদের ভোটেই আমরা জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছি। আজ ক্ষমতায় আছি বলেই বিশ্বে বাঙালি জাতি সম্মান নিয়ে চলতে পারে। বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল বলে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের আরো এগিয়ে যেতে হবে।’
আলোচনাসভা শুরুর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে সংগঠনের কার্যালয়ে ফিতা কেটে ‘ইতিহাসের গতিধারায় বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা’ শীর্ষক সংবাদচিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন।
‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করাই প্রধান চ্যালেঞ্জ’
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি গতকাল সন্ধ্যায় তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে এ কথা বলেন। তিনি বলেন. ‘আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কিভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করব। আমাদের এটি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞা, কভিড-১৯ মহামারির কারণে বিশ্ব অর্থনীতি অর্থনৈতিক মন্দা ও উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির সম্মুখীন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এর পরও উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উত্তরণ সহজ করতে বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। বাজেটে মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, চিকিৎসার ক্ষেত্র ও শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে, যাতে এসব ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির চাপটা না আসে।
এ জাতীয় আরো খবর..