×
  • প্রকাশিত : ২০২৪-০৫-২৮
  • ২৩৭ বার পঠিত
প্রতিবছর কোরবানি ঈদের আগে চাহিদা অনুযায়ী দেশীয় গরুর যোগানের বিপরীতে আমদানি করা গরু নিয়ে নানান আলোচনা-সমালোচনা হয়। প্রশ্ন ওঠে, কোরবানির জন্য পর্যাপ্ত গরু থাকার পরও এমন আমদানি নিয়ে। তাছাড়া নানা প্রচেষ্টা আর নজরদারির পরও ভারত ও মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে গরু আনা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায় সংশ্লিষ্টদের।

২০১৪ সালে গরুর মাংসের কেজি ছিল ৩০০ টাকা। তারপর থেকে শুরু হলো গরুর মাংসের দাম বাড়া। এখন তো হাতের নাগালের বাইরে চলে গেছে সমাজের নিম্নবিত্তদের। বর্তমান দাম অনুযায়ী, গত ১০ বছরে গরুর মাংসের দাম বেড়েছে ১৫০ শতাংশ। অথচ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকেই বাংলাদেশ মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। 

তবে দামের উচ্চহারের চিত্র দেখে বুঝতে বাকি থাকে না, আসলে বাস্তবে এ স্বয়ংসম্পূর্ণতার কোন প্রভাব নেই বাজারে। অবশ্য এক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি, গো-খাদ্যের দাম বৃদ্ধি এবং খামারিদের সিন্ডিকেট, বিভিন্ন ধরনের চাঁদাবাজি ও সরকারের সঠিক পরিকল্পনার অভাবে গরুর মাংসের দাম বাড়ে বলে মনে করেন অনেকেই।
 
২০১৪ সালে ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে বাংলাদেশে গরু আসা বন্ধ হয়ে যায়। তার আগে প্রতিবছর গড়ে ২০ লাখ গরু ভারত থেকে বাংলাদেশে আসতো। যেমন: ২০১৩ সালে ভারত থেকে গরু এসেছিল ২৩ লাখ। তাই চাহিদা মেটানোর জন্য বাংলাদেশে গবাদি পশুর লালনপালন বেড়ে যায়। 
 
বর্তমানে দেশের প্রায় ৬৮ হাজারের বেশি নিবন্ধিত খামারে দুধ ও মাংস উৎপাদন হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে এসব খামারের গবাদিপশু দিয়ে সারা বছর মাংসের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি কোরবানির চাহিদাও পূরণ হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন খামারিরা উপকৃত হচ্ছেন, অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হচ্ছে দেশের।
 
প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে যেখানে দেশে মাংস উৎপাদন হয়েছিল ৩৬ লাখ ২০ হাজার টন, সেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ৮৭ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু তারপরও ভারত ও মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে চোরাই পথে প্রচুর গরু দেশে ঢোকে। কেন?
 
একটি গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া যায়, এবার প্রায় ৫ লাখ গরু আমদানির আশংকা করছেন দেশীয় খামারিরা। তারা বলছেন, এবার কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে শুধু কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে আনা হতে পারে থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের নানা জাতের গরু। প্রতিবছর কয়েকটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট ও অসাধু চক্র ট্রলারে করে নিয়ে আসে এসব গরু। 
 
বিএসএফের একটি চক্র, দুর্নীতিবাজ কাস্টমস কর্মকর্তা এবং স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের যোগসাজশে প্রতিবছর ঈদের আগে তাদের এ চোরাচালান তৎপরতা বেড়ে যায়। গতবার পাটগ্রাম, দহগ্রাম, আঙ্গরপোতা ও হাতিবান্ধার দইখাওয়া সীমান্ত দিয়ে প্রচুর গরু চোরাচালান হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের ১১টি পয়েন্ট দিয়ে রাতের আঁধারে পাচার করা হয় লাখ লাখ গরু।
 
মৎস ও প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী গত বছর কোরবানির ঈদ উপলক্ষে দেশে ১ কোটি ২৫ লাখ গবাদিপশু প্রস্তুত ছিল। ঈদ শেষে হিসেব করে দেখা যায়, অবিক্রিত গরুর সংখ্যা ছিল প্রায় ১৯ লাখ । মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. আবদুর রহমান বলছেন, এবারের ঈদে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ গবাদিপশুর ব্যবস্থা আছে এবং কোনরকম আমদানির চিন্তা নেই সরকারের।
  
এদিকে, খামারিরা বলছেন, প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে খাদ্য গ্রহণ কমিয়ে দেয়ায় গরুর ওজন নিয়ে শংকিত তারা। এক মাসের ব্যবধানে এসব গবাদি পশুর ওজন কমেছে প্রায় ৩০ থেকে ৫০ কেজি পর্যন্ত। এদের লালন-পালনের খরচও বাড়ছে। পশু ঠান্ডা রাখতে দিনরাত বৈদ্যুতিক পাখা চালু রাখার পাশাপাশি দৈনিক কয়েকবার এদের গোসলে বাড়ে বিদ্যুৎ বিল। এ সময় বেড়ে গেছে ভ্যাকসিন ও ওষুধের খরচও।
 
তাছাড়া ২ বছরের ব্যবধানে গো-খাদ্যের দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। গরু মোটাতাজা করতে ধানের কুঁড়া, গমের ভুসি, বুটের ভুসি, খেসারি ভুসি, মসুর ভুসি, ভুট্টা ও ফ্যাটেনিং ফিডসহ সব দানাদার খাদ্যের দাম প্রান্তিক খামারিদের নাগালের বাইরে। এ কারণে এবার যদি সীমান্ত দিয়ে বিদেশি গরু দেশে ঢোকে, তাহলে ব্যাপক লোকসানের আশংকা করছেন খামারিরা।
 
কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে বিএসএফের গুলির মুখেও দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে এরই মধ্যে ভারতীয় গরু বাংলাদেশে ঢোকা শুরু হয়েছে। জানা যায়, সীমান্ত অঞ্চলে ভারত থেকে চোরাই পথে গরু কেনাবেচা শুরু করেছে দুপারের গরু ব্যবসায়ীরা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভারতীয় গরু আনতে গিয়ে অনেকে গুলিবিদ্ধ হন এবং মারাও যান। তারপরেও নগদ লাভের আশায় ভারত থেকে আনা হয় এসব গরু। এতে হুন্ডির মাধ্যমে প্রচুর অর্থ চলে যায় বাইরের দেশে।
 
ঈদের আগে প্রচুর সংখ্যক ভারতীয় গরুর আমদানি হতে পারে। দেশের লালমনিরহাটের পাটগ্রামের বুড়িমারী, আউলিয়ার হাট, বাউরা, রসুলগঞ্জ, ভূরুঙ্গামারী, নাগেশ্বরী, নীলফামারীর চিলাহাটি, দিনাজপুরের হিলি, জয়পুরহাটের টেপরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ ও রাজশাহীসহ বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে গরু আসতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
 
অন্যদিকে, আরেক পক্ষ বলছে, অনেক সময় ব্যবসায়ীরা কোরবানির গরুর দাম নিয়ে ক্রেতাদের কুক্ষিগত করে রাখে। বাজারে পর্যাপ্ত গরু না থাকার অজুহাত দিয়ে প্রতি গরুতে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা বেশি দাম হাঁকান তারা। ভারত থেকে আমদানি বন্ধের কারণে দুদেশ বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। তাই তৈরি হয়েছে কোটি কোটি টাকার কালোবাজার, আর বড় ধরনের অপরাধ জগৎ।
 
তবে সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, কোরবানির জন্য পর্যাপ্ত গবাদিপশু দেশে রয়েছে। আমদানির কোন প্রয়োজন নেই।
 
সরকারের উচিত সঠিক বাজার মনিটরিংয়ের মাধ্যমে গরুর দাম ক্রেতার নাগালের বাইরে না যাওয়ার ব্যবস্থা করা। পাশাপাশি দেশের খামারিদের স্বার্থ রক্ষার্থে সীমান্তে টহল আরও জোরদার করা। সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে যাতে কোনো গরু বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে, সে বিষয়ে বিজিবির গোয়েন্দা নজরদারির পাশাপাশি আভিযানিক তৎপরতা বাড়ানো উচিত। তাতে দেশের খামারিরা লাভবান হবেন; পাশাপাশি দেশের টাকা অবৈধ উপায়ে বাইরে যাবে না বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat