সাবেক পুলিশ প্রধান (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের আরো ১১৯টি দলিলের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি জব্দ ও ক্রোকের আদেশ দিয়েছেন আদালত। দুদকের আবেদনে রবিবার (২৬ মে) ঢাকা মহানগর আদালতের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেনের আদালত এ আদেশ দেন। আদালতের আদেশটি নিশ্চিত করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পাবলিক প্রসিকিউটর মাহ্মুদ হোসেন জাহাঙ্গীর।
তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘১১৯টি দলিলের স্থাবর সম্পত্তি জব্দ করার আদেশ হয়েছে।
এই স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে আছে গুলশান আবাসিক এলাকার সিইএস (জি) ব্লকে ১৩৪ (পুরাতন ১৩০) নম্বর রাস্তার ১ নং প্লটে মোট ১৯ কাঠা ১২ ছটাক জমির ওপর নির্মিত রেনকন আইকন টাউয়ারে ৪টি ফ্ল্যাট। ১৪ তলায় দুটি ফ্ল্যাটের আয়তন ২ হাজার ২৪২ দশমিক ৯৯ বর্গফুট। এ দুটি ফ্ল্যাটের ক্রয়মূল্য ৫৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। একই টাওয়ারের ১৩ তলায় দুটি ফ্ল্যাটের আয়তন ২ হাজার ৩৫৩ দশমিক ৪০ বর্গফুট।
এ দুটি ফ্ল্যাটের ক্রয়মূল্য ৫৬ লাখ টাকা। চারটি ফ্ল্যাটই বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে। বাকি ১১৫টি দরিলের সম্পত্তির মধ্যে আছে সাভারের মৈস্তাপাড়া মৌজার ৩ কাঠা জমি। এই জমির মালিক বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জীশান মীর্জা।
আর মাদারীপুরের রাজৈড়ে সাতপাড় ডুমুরিয়া মৌজায় ১১৩টি দলিলের সম্পত্তির মালিক বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী। এছাড়া মাদারীপুরের শিবচরে ঠেঙ্গামারা মৌজায় তাদের আরও ৫ কাঠা জমি আছে।’
অস্থাবর সম্পদের মধ্যে সোনালী ব্যাংকের রমনা কর্পোরেট শাখায় বেনজীর আহমেদের নামে ৩০ লাখ টাকার একটি সঞ্চয়পত্র। লঙ্কা সিকিউরিটিজ লিমিটেডে বেনজীর আহমেদের বিও অ্যাকাউন্ট, শান্তা সিকিউরিটিজ লিমিটেডের গ্রাহক হিসেবে বিনজীর আহমেধের স্ত্রী জীশান মীর্জার ও দ্বিতীয় মেয়ে তাহসিন রাইশা বিনতে বেনজীরের বিও অ্যাকাউন্ট। এছাড়ও যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহ পরিদপ্তরের নিবন্ধিত সাভানা ন্যাচারাল পার্ক প্রাইভেট লিমিটেড, সাভানা এগ্রো লিমিটেড, সাভানা ইকো রিসোর্ট ও একটি শিশির বিন্দু লিমিটেড।
এই চারটি প্রতিষ্ঠানেরই শতভাগ মালিক বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যরা। এর বাইরে বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে ১৫টি কম্পানির শেয়ার অবরুদ্ধ করা হয়েছে বলে জানান দুদকের আইনজীবী মাহ্মুদ হোসেন জাহাঙ্গীর।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার (২৩ মে) বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে ৮৩টি দলিলের স্থাবর সম্পদ জব্দ (ক্রোক) এবং ৩৩টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করার আদেশ দেন এই আদালত। ওইদিনের আদেশ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ৮৩টি দলিলে জমি প্রায় ১১৪ একর। এর মধ্যে বেনজীরের স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে অন্তত ৮১ একর। বেনজীরের নিজের নামে রয়েছে ৭.৬০ একর। বাকি প্রায় ২৬ একর জমি তার তিন মেয়ে ও কয়েকজন স্বজনের নামে রয়েছে। তবে ৩৩টি ব্যাংক হিসাবে কত টাকা জমা আছে, সে হিসাব আদালতের আদেশ থেকে পাওয়া যায়নি।
দুদকের আইনজীবী মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অনুসন্ধান চলাকালে বেনজীর আহমেদ কিংবা তার পরিবারের সদস্যদের নামে আরো সম্পত্তির তথ্য আসলে সেগুলোর কী করা হবে, সে বিষয়ে কমিশন সিদ্ধান্ত নিবে। কমিশন যে সিদ্ধান্ত দিবে সে অনুযায়ী আমরা কাজ করবো।’
‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’ শিরোনামে গত ৩১ মার্চ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে কালের কণ্ঠ। এরপর গত ২ এপ্রিল ‘বনের জমিতে বেনজীরের রিসোর্ট’ শিরোনামে দ্বিতীয় দফার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। দুটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর ৪ এপ্রিল দুদক চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে অনুসন্ধানের উদ্যোগ নিতে অনুরোধ করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সালাহ উদ্দিন রিগ্যান। এতে কাজ না হওয়ায় গত ১৮ এপ্রিল আইনি নোটিশ দেন তিনি। নোটিশে স্বউদ্যোগে অনুসন্ধানের অনুরোধ করা হয় কমিশনের চেয়ারম্যানকে। তাতে সাড়া না পেয়ে গত ২১ এপ্রিল হাইকোর্টে রিট করেন তিনি। রিটে বেনজীর আহমেদের অনিয়ম-দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার অনুসন্ধানে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নিষ্ক্রীয়তা চ্যালেঞ্জ করা হয়।
গত ২৩ এপ্রিল এই রিট শুনানিতে ওঠে। শুনানিতে দুদকের আইনজীবী জানান, বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অনুসন্ধানে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি কাজ করছে। পরে হাইকোর্ট অনুসন্ধান কমিটিকে দুই মাসের মধ্যে অগ্রগতি প্রতিবেদন দিতে বলে আদেশ দেন।
এ অবস্থায় গত ২৩ মে বেনজীর আহমেদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দ ও অবরুদ্ধের নির্দেশনা চেয়ে সংস্থাটির অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা উপপরিচালক মো. হাফিজুল ইসলাম আবেদন করলে আদালত সেই আদেশ দেন।
আদালত আদেশে বলেন, ‘বর্ণিত স্থাবর সম্পত্তি জব্দ (ক্রোক) এবং অস্থাবর সম্পত্তি অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করা না হলে তা হস্তান্তর হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে, যা পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা সম্ভব হবে না। অতএব অর্থপাচার প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এ ১৪ ধারা এবং দুর্নীতি দমন কমিশন, বিধিমালা-২০০৭-এর ১৮ বিধি অনুযায়ী স্থাবর সম্পদ জব্দ (ক্রোক) এবং অস্থাবর সম্পদ অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করা হলো।’
আদেশে আরো বলা হয়, স্থাবর সম্পদের ওপর জব্দের আদেশ কার্যকর থাকা অবস্থায় কোনো অবস্থাতেই তা হস্তান্তর বা বিনিময় করা যাবে না। আর অস্থাবর সম্পদে অবরুদ্ধের আদেশ কার্যকর থাকা অবস্থায় ব্যাংক হিসাবগুলোতে অর্থ জমা করা যাবে, কিন্তু উত্তোলন করা যাবে না। আদেশটি বিজ্ঞপ্তি আকারে একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি জাতীয় দৈনিকে প্রচারের নির্দেশ দেন আদালত। এ জন্য আদেশের অনুলিপি কমিশনের সচিবের কাছে পাঠাতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
এ ছাড়া আদেশের অনুলিপি কমিশনের সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিটের পরিচালক, বাংলাদেশ ফরম ও প্রকাশনা অফিসের উপপরিচালক, ঢাকা, গোপালগঞ্জ, টুঙ্গিপাড়া, কোটালীপাড়া, টেকনাফ, উখিয়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি), সাবরেজিস্ট্রার, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তার কাছে পাঠাতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
এ জাতীয় আরো খবর..