যুগপৎ কর্মসূচি নিয়ে মাসখানেকের মধ্যে মাঠে নামার পরিকল্পনা আছে বিএনপির। সেই আন্দোলনের কর্মকৌশল নির্ধারণে পরামর্শ নিতে ধারাবাহিক বৈঠক করেছে দলটি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর আন্দোলন নিয়ে প্রথম বৈঠক এটি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গণতন্ত্র মঞ্চের এক নেতা বলেন, আন্দোলনের কর্মসূচি শুরুর আগে বিএনপির আগামী এক বছরের রোডম্যাপ কী, তা জানতে চাওয়া হয়েছে।
বিএনপির পরিকল্পনা জানার পর কর্মসূচি ও আন্দোলন কবে থেকে শুরু করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।
জোট শরিকরা মনে করেন, সংসদ ও উপজেলা নির্বাচনে জনগণ ভোট না দিয়ে সরকারকে অনাস্থা জানিয়েছে। এ বিষয়টি মাঠের আন্দোলনে আনতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালের কণ্ঠকে বলেন, এবার প্রথম ধাপের বৈঠক হয়েছে।
জোট শরিকরা নানা পরামর্শ ও প্রস্তাব দিয়েছে। এসব প্রস্তাব ও মতামত নিয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরামে আলোচনার পর শরিকদের সঙ্গে আরো বৈঠক হবে।
কবে থেকে যুগপৎ আন্দোলন শুরু হবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি এখনো বলার সময় আসেনি। পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও আলোচনার মাধ্যমে আন্দোলনের দিনক্ষণ ঠিক করা হবে।
এদিকে নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতি মূল্যায়নের পর যুগপৎ আন্দোলনের যে পরিকল্পনা করা হচ্ছে, তাতেও সরাসরি সম্পৃক্ত থাকছে না জামায়াতে ইসলামী। বিএনপির পক্ষ থেকে জোট শরিকদের জানানো হয়েছে, জামায়াতের সঙ্গে তাদের আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক নেই। তবে তারা দলটির সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক অব্যাহত রাখতে চায়।
বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, গত সপ্তাহে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সঙ্গে বৈঠকে অন্তত দুটি জোটসহ কয়েকটি দল জামায়াতকে নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে।
এর মধ্যে ১২ দলীয় জোট, গণ অধিকার পরিষদসহ কয়েকটি দল আন্দোলনে জামায়াতকে সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দিয়েছে।
তবে ছয়টি দলের সমন্বয়ে গঠিত গণতন্ত্র মঞ্চ আগের মতোই জামায়াতের বিষয়ে তাদের বিরোধী অবস্থান তুলে ধরে।
জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির এক ধরনের বোঝাপড়া এখনো আছে। দল দুটির একাধিক সূত্র জানায়, সর্বশেষ উপজেলা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর বিএনপি তাদের অবস্থান জামায়াতকে জানায়। অনেকের ধারণা, বিএনপির সঙ্গে বোঝাপড়ার কারণেই উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে জামায়াত।
একাধিক সূত্র জানায়, দল দুটির সম্পর্ক আনুষ্ঠানিক না হলেও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে চায় তারা। এমনকি যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত না থেকেও জামায়াত পৃথকভাবে একই ধরনের কর্মসূচি পালন করলে তা ইতিবাচকভাবে দেখবে বিএনপি।
গত বুধবার যুগপৎ আন্দোলনের প্রভাবশালী শরিক গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বৈঠকে জামায়াতের বিষয়ে বিএনপি তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে।
যদিও এ বিষয়ে দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটিতে কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়, জামায়াতের সঙ্গে তাদের আনুষ্ঠানিক কোনো সম্পর্ক নেই। দলটির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনার মাধ্যমে যুগপৎ আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার কোনো পরিকল্পনাও বিএনপির নেই। তবে জামায়াত পৃথকভাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে থাকলে তাতে নেতিবাচক মনোভাব দেখাবে না তারা।
গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা জানান, জামায়াত যুগপতের কর্মসূচি পৃথকভাবে পালন করলে তাদেরও আপত্তি থাকবে না।
এর আগে গত ১২ মে বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে ১২ দলীয় জোটের নেতারা সরকারবিরোধী আন্দোলনে জামায়াতে ইসলামীকে এক মঞ্চে আনার প্রস্তাব দেন। আন্দোলন সফল করতে হলে জামায়াতসহ বাম-ডান ও ইসলামী ঘরানার সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে নামার পরামর্শও দেন তাঁরা। একই পরামর্শ দেয় নুরুল হক নুরের গণ অধিকার পরিষদসহ আরো কয়েকটি দল।
অবশ্য জামায়াতের কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলাপকালে তাঁরা বলেন, যুগপৎ আন্দোলনে সরাসরি সম্পৃক্ত হতে তাঁরাও চান না। দলের বেশির ভাগ নেতা বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক রাখার ক্ষেত্রে কৌশলী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ বিএনপির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হলে সরকারের রোষানলে পড়তে হতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির ঘনিষ্ঠতার প্রভাব যুগপৎ আন্দোলনেও থাকবে কি না, সে বিষয়ে তাঁরা জানতে চেয়েছেন। বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, যুগপতে আনুষ্ঠানিকভাবে জামায়াত নেই এবং জোটের বর্তমান কাঠামোতে তাদের যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনাও নেই।
সাইফুল হক বলেন, যুগপত্ভাবে দেওয়া কর্মসূচি জামায়াত তাদের মতো করে পৃথকভাবে পালন করলে তাতে গণতন্ত্র মঞ্চের আপত্তি থাকবে না।
যুগপৎ আন্দোলনের দলগুলোর অন্যতম সমন্বয়ক বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জামায়াতকে যুগপৎ আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার প্রস্তাব এসেছে। ভিন্নমতও আছে। এটি বিশদ আলোচনার বিষয়। এক বৈঠকেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়।’
বিএনপি সূত্র জানায়, গত ১২ মে থেকে টানা পাঁচ দিন যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দলটির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এটি প্রথম পর্বের বৈঠক। দ্বিতীয় পর্বে আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হবে।
জোটের পরিধি বাড়ানোর প্রস্তাব
বৈঠক সূত্র জানায়, ১২ দলীয় জোট, গণতন্ত্র মঞ্চসহ কয়েকটি দল জোটের পরিধি বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। তারা মনে করে, জোটের বাইরেও যারা সরকারবিরোধী আন্দোলনে পৃথক কর্মসূচি পালন করেছে তাদের সবাইকে এক মঞ্চে আনা উচিত।
গণ অধিকার পরিষদের উচ্চতর পরিষদের সদস্য আবু হানিফ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনসহ সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকা সব দলকে যুগপৎ আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দিয়েছি।’
এ প্রসঙ্গে নজরুল ইসলাম খান বলেন, জোটের পরিধি বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে। এটি প্রাথমিক আলোচনা।
একটি সূত্র জানায়, ইসলামী আন্দোলনকে যুগপৎ আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে বিএনপি ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছে। এ নিয়ে দলটির সঙ্গে বিএনপির আলোচনা হয়েছে। এখনো ইসলামী আন্দোলনকে সরাসরি আন্দোলনে সম্পৃক্ত করাতে রাজি করা না গেলেও দলটির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করতে চায় বিএনপি।
লিয়াজোঁ কমিটি চায় দলগুলো
সরকারবিরোধী আগামীর আন্দোলন কর্মসূচি প্রণয়ন ও আন্দোলন পরিচালনায় কার্যকর লিয়াজোঁ কমিটি চায় বিএনপির মিত্ররা। দলগুলো মনে করে, লিয়াজোঁ কমিটি না থাকায় নির্বাচন ঠেকানোর আন্দোলনে সমন্বয়হীনতা ছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিএনপি কর্মসূচি চূড়ান্ত করত। জোটের রাজনীতিতে এটি যথাযথ প্রক্রিয়া নয়। তাই এবার এই প্রশ্নে একটা মীমাংসা চেয়েছেন গণতন্ত্র মঞ্চ, গণ অধিকার পরিষদসহ কয়েকটি দলের নেতারা।
গণ অধিকারের শীর্ষ স্থানীয় নেতা আবু হানিফ বলেন, আন্দোলনে সমন্বয়হীনতা কাটাতে সব দলের সমন্বয়ে একটি লিয়াজোঁ কমিটি গঠনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে নিখুঁতভাবে কর্মসূচি প্রণয়ন করা যাবে বলে মনে করেন তিনি।
গত বুধবার রাতে বিএনপির সঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা বলেন, প্রতিটি জোট ও দল থেকে একজন করে নিয়ে ১০-১২ সদস্যবিশিষ্ট একটি লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করতে হবে। সেই লিয়াজোঁ কমিটিতে আলোচনার ভিত্তিতে আন্দোলনের কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হবে। তার আগে নিজ নিজ দল ও জোটের সিদ্ধান্ত নিয়ে সংশ্লিষ্ট নেতারা ওই বৈঠকে বসবেন।
তাঁরা আরো বলেন, নব্বইয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনসহ অতীতের আন্দোলনগুলোতে লিয়াজোঁ কমিটি এভাবে কাজ করেছে। কিন্তু গত নির্বাচনের আগের আন্দোলনে এই প্রক্রিয়ায় কর্মসূচি প্রণীত হয়নি।
বৈদেশিক সম্পর্ক উন্নয়নের পরামর্শ
সরকারবিরোধী রাজপথের আন্দোলনের পাশাপাশি ক্ষমতাধর দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের পরামর্শ দিয়েছে দলগুলো। এ বিষয়ে গণতন্ত্র মঞ্চ সুনির্দিষ্ট মূল্যায়ন ও প্রস্তাব দিয়েছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
বিগত আন্দোলনে ভূ-রাজনীতি ও বৈশ্বিক রাজনীতি বিবেচনায় প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্কের ঘাটতি ছিল বলে মনে করেন জোট শরিকরা। তাঁদের মতে, বিএনপি নেতৃত্ব আন্তর্জাতিক সম্পর্ক জোরদার করতে পারেনি।
বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে মঞ্চের নেতারা বলেন, ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনায় যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশ এবং ভারত ও চীনের সঙ্গেও সম্পর্কের উন্নয়ন করতে হবে। আন্দোলনের প্রধান দল হিসেবে বিএনপিকে এ দায়িত্ব নিতে হবে। বৈশ্বিক রাজনীতিতে প্রভাবশালী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা না গেলে শুধু আন্দোলনের মাধ্যমে সফলতা পাওয়া কঠিন।
তবে জোট শরিকদের সঙ্গে বিএনপি ভারত সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশি হত্যা, মিয়ানমার সীমান্তে অস্থিরতার বিষয়টি আলোচনায় আনেন। সীমান্ত হত্যার প্রতিবাদে কর্মসূচি দেওয়ার ইঙ্গিতও দেন। বৃহত্ভাবে পর্যবেক্ষণ করে আগ্রাসনবিরোধী কোনো কর্মসূচি দেওয়া যায় কি না, সেটা নিয়ে ভাবা যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন বিএনপি নেতারা।
১২ দলীয় জোটের কয়েকজন নেতা ভারতীয় পণ্য বর্জনের প্রচারণা আরো জোরালো করার পরামর্শ দেন।
এ জাতীয় আরো খবর..