×
  • প্রকাশিত : ২০২৪-০৫-১৮
  • ৬৬ বার পঠিত
বিনোদন জগতে এখন ওটিটি প্ল্যাটফরমের দাপট। বাংলাদেশে এর উত্থান করোনা মহামারির সময় থেকে। নতুন এই মাধ্যমে পরিচালকরা পেলেন শৈল্পিক স্বাধীনতা। অভিযোগ উঠেছে, থ্রিলারের আধিক্যে জীবনবোধের গল্প হারিয়ে যাচ্ছে।

এ নিয়ে কথা বলেছেন ওয়েব সংশ্লিষ্টরা। শুনেছেন হৃদয় সাহা।
সব জনরার দর্শকই আছে (শিহাব শাহীন, নির্মাতা)

ওটিটিতে থ্রিলার বেশি হচ্ছে, কারণ দর্শক ওটাই বেশি দেখছে। বেশির ভাগ দর্শকই এখনো তরুণ, ১৫-২৫ বছরের দর্শকরা থ্রিলার বেশি পছন্দ করে।

দর্শকের রায় যেদিকে বেশি, সেদিকেই ঝুঁকবে প্ল্যাটফরমগুলো, সেটাই স্বাভাবিক। অন্য জনরা যে হচ্ছে না, তা তো না। রোমান্টিক ধারার গল্পে আমার ‘মায়াশালিক’, ‘কাছের মানুষ দূরে থুইয়া’ হিট করল, অন্যরাও করছে। দর্শক তো দেখেছে, আলোচনা করছে।

সব জনরার দর্শকই আছে। কিছু হিট করবে, কিছু করবে না। ভারতে বছরে সহস্রাধিক কনটেন্ট মুক্তি পায়, আলোচিত হয় গুটিকয়েক। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের গল্পে সিরিজ নির্মাণে অনেক অর্থের প্রয়োজন। পোস্ট প্রডাকশন থেকে শুরু করে আর্ট ডিরেকশন—সবখানেই প্রয়োজন অর্থ।

ভারতে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের যেসব সিরিজ হয় সেগুলোর বাজেট অন্যগুলো থেকে অনেক বেশি, যা আমাদের দেশে সম্ভব নয়। ফ্যান্টাসি দেখাতে হলে ভিজ্যুয়ালিও সেটাকে সুন্দর করে দেখাতে হবে। যেহেতু এখানে বাজেট বড় ইস্যু, তাই চাইলেই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে সিরিজ বানানো সম্ভব নয়।
থ্রিলার লেখা সহজ, তবে ভালো থ্রিলার লেখা কঠিন (আশফাক নিপুণ, নির্মাতা)

আমরা যখন ডিজিটাল স্ট্রিমিং বা ওটিটির সঙ্গে পরিচিত হই তখন আর্ন্তজাতিকভাবে ‘নারকোস’ বা ভারতের ‘স্যাক্রেড গেমস’ বেশ জনপ্রিয় ও আলোচিত থ্রিলার। আমাদের দেশেও ওটিটির যাত্রা থ্রিলার দিয়ে শুরু। তার অন্যতম কারণ টেলিভিশনের দর্শকই আমাদের ওটিটির দর্শক, যারা টিভিতে রোমান্টিক, কমেডি বা পারিবারিক ধারার বাইরে ফিকশন দেখে অভ্যস্ত ছিলেন না।

বাজেটসহ বিবিধ কারণে থ্রিলারধর্মী কাজ টিভিতে দেখানোর সুযোগও ছিল না। ওটিটিতে দেশীয় থ্রিলারে তারা নতুন স্বাদ পেল। থ্রিলার যে শুধু দর্শকের কাছে নতুন তা নয়, নির্মাতাদের জন্যও নতুন ছিল। নতুন জনরা এক্সপ্লোর করার সুযোগ নির্মাতারা হারাতে চাননি। সেজন্যই ওটিটি প্লাটফরম আর নির্মাতারা প্রথম সুযোগে থ্রিলার বেছে নিয়েছেন। সত্যি বলতে থ্রিলার লেখা তুলনামূলক সহজ, তবে ভালো থ্রিলার লেখা খুব কঠিন। এখন থ্রিলার কনটেন্ট অনেক হচ্ছে এটা ঠিক, সবগুলো আলোচনায় আসছে না মানের কারণে। শুধু ভালো থ্রিলারই দর্শকপ্রিয় হচ্ছে। যেমন—কারাগার, মাই শেলফ অ্যালেন স্বপন, মহানগর। প্রচুর ওয়েব ছবি হচ্ছে, সে তুলনায় সিরিজ কম। কারণ ভালো সিরিজ নির্মাণের জন্য যে রিসোর্সের প্রয়োজন সেটা আমাদের নেই। সিরিজ লেখক ও পরিচালকের সংখ্যা এখনো অপ্রতুল। একটা সিরিজ লেখা থেকে বানানো এবং প্রচার করা পর্যন্ত লেগে যায় বছরখানেক সময়। অন্যদিকে ওয়েব ছবির ফরম্যাটের সঙ্গে নির্মাতারা আগে থেকেই পরিচিত, টিভিতে টেলিছবি নির্মাণের সুবাদে। বাইরের প্লাটফরমগুলো ওয়েব ছবির চাইতে অরিজিনাল সিরিজ বেশি করে। তারা বরং ফিচার ফিল্মস থিয়েটারে প্রদর্শনের পর কিনে নেয়। প্রতিমাসে নতুন কনটেন্ট হাজির করার চাপ থেকেই দেশীয় প্লাটফরমগুলোকে সিরিজের চেয়ে বেশি ওয়েব ছবিতে আগ্রহী হতে হচ্ছে। আর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে সিরিজ নির্মাণে যে সময় আর পড়াশোনা প্রয়োজন সেটা আমরা হয়তো এখনো করছি না। কারণ এর নির্মাণ ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ। আমি বিশ্বাস করি, ওয়েব সিরিজ দিয়েই দীর্ঘমেয়াদি জনপ্রিয়তা পেতে পারে ওটিটি।

সব ধরনের কনটেন্ট থাকা উচিত (মিজানুর রহমান আরিয়ান, নির্মাতা)

ওটিটি যখন যাত্রা শুরু করে সেসময় টিভি- সিনেমাতে থ্রিলার জনরার কাজ হতো না বললেই চলে। ওটিটি এলো, নির্মাতারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে শুরু করলো। দর্শকদের ভিন্ন অভিজ্ঞতা দিতে নির্মাতারা থ্রিলার নির্মাণে আগ্রহী হন। শুরুর দিকে বেশ কিছু থ্রিলার সিরিজ দর্শকপ্রিয় হয়। শুরু হয় একের পর এক থ্রিলার। ফলাফল যেটা হওয়ার সেটাই, থ্রিলারে আগ্রহ কমে দর্শকের। একটা পরিবারের ৫ সন্তানই দুষ্টু হলে সেটা যেমন যন্ত্রনার আবার ৫ সন্তান বোকাসোকা হলে সেটাও বোরিং। পরিবারে দুষ্টু সন্তান থাকতে হয়, দায়িত্বশীল সন্তান থাকতে হয়, হিউমারাস একজন থাকতে হয় আবার প্রেমিকের হাত ধরে ঘর পালানো কাউকেও থাকতে হয়। আমাদের ওটিটি প্লাটফরমে সব ধরনের কনটেন্ট থাকা উচিত। তাহলে সব শ্রেণীর দর্শক ওটিটিতে আগ্রহী হবে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে সিরিজ তেমন না হওয়ার কারণ দুটি হতে পারে—এক, ব্যয়বহুল। দুই, এই জনরার প্রতি দর্শকের আগ্রহ কম। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের কনটেন্ট উপভোগ্য করে বানানো যাচ্ছে না।

থ্রিলার ব্যাপারটা কিছুটা লার্জার দ্যান লাইফ (সৈয়দ আহমেদ শাওকী, নির্মাতা)

সিনেমা বা ওটিটির পর্দায় দর্শক তার নিত্যনৈমিত্তিক জীবনের বাইরে গিয়ে নতুন কোনো অভিজ্ঞতার স্বাদ নিতে চায়। সেটা থ্রিলারও হতে পারে বা লাভস্টোরি। আমার মনে হয়, দর্শক জনরা দেখে সিদ্ধান্ত নেয় না দেখবে কি দেখবে না। গল্পে ইউনিক কিছু দেখতে পেলে তারা আগ্রহী হয়। হলিউড বা ভারতীয় উপমহাদেশে আগে প্রচুর লাভস্টোরি হয়েছে, কারণ সেটার চাহিদা ছিল। এতো এতো লাভস্টোরি হয়েছে যে এখন সেখান থেকে ইউনিক কিছু বের করা কঠিন। যদি হয় সেটা কিন্তু জনপ্রিয় হয়। যেমন ‘কাছের মানুষ দূরে থুইয়া’ দারুণ জনপ্রিয় হয়েছে, ‘নেটওয়ার্কের বাইরে’ ব্যক্তিগতভাবে আমার খুব পছন্দের। এগুলো হিট হয়েছে কারণ ব্যতিক্রমী কিছু না কিছু ছিল। প্রযুক্তির কল্যাণে এখন বাইরের সব ক্ল্যাসিক থ্রিলার আমরা দেখতে পাই। আমাদের জন্য কিন্তু থ্রিলার জনরাটা এখনো নতুন। থ্রিলার ব্যাপারটা যেহেতু কিছুটা লার্জার দ্যান লাইফ, তাতে সাধারণ দর্শক আগ্রহী হয়। সেজন্যই একেবারে শুরুতে ‘তাকদীর’ জনপ্রিয় হয়েছিল। আমি বরং দর্শককে প্রশ্ন করতে বলব, তারা কেন থ্রিলার এত পছন্দ করে। আর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে সিরিজ কেন হচ্ছে না? এই প্রশ্ন করব ওটিটি কর্তৃপক্ষকে। তবে হ্যাঁ, এ ধরনের সিরিজ নির্মাণ খুবই ব্যয়সাপেক্ষ। আমাদের কথা যদি বলি, আমরা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ‘একাত্তর’, ‘জাগো বাহে’, ‘কারাগার’ করেছি। সামনে যে গল্প নিয়ে আসছি, সেখানে পারিবারিক গল্প যেমন আছে, আছে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও।

আমি ব্যক্তিগতভাবে থ্রিলারে আগ্রহীও না (তাসনিয়া ফারিণ, অভিনয়শিল্পী)

আমার ক্ষেত্রে যদি বলি, আমার বেশিরভাগ কাজই কিন্তু থ্রিলার না। ‘কারাগার’কে মিস্ট্রি থ্রিলার ধরা যায়। আমার সর্বশেষ দুটি হিট প্রজেক্টের (‘অসময়’ ও ‘কাছের মানুষ দূরে থুইয়া’) কোনোটাও থ্রিলার না। আমি ব্যক্তিগতভাবে থ্রিলারে আগ্রহীও না। চিত্রনাট্য যদি আমাকে সন্তুষ্ট করতে না পারে তাহলে থ্রিলার কোনো কনটেন্টে অভিনয়ের জন্য রাজি হই না। আমি বুঝতে পারি, গল্পে জোর করে থ্রিল আনা হয়েছে। পরে দেখি, আসলেই ঐ থ্রিলার গল্প দর্শক পছন্দ করেনি। আমার কাছে সব সময়ই মনে হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষ মূলত নিজেদের গল্প দেখতে চায়। আমরা দক্ষিণ ভারতের ছবি যে দেখি, সেখানে কিন্তু তারা নিজেদের শেকড় আর সংস্কৃতির গল্প বলে। এটা নিয়েই তারা আজ অনেক উন্নতি করে ফেলেছে, আমাদেরও দেখতে ভালো লাগে। বাংলাদেশেও যেসব কনটেন্টে নিজেদের গল্প বলেছে, সেগুলো হিট করেছে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের সিরিজে যুক্ত হতে চায় যে কোনো অভিনয়শিল্পীই। আমাদের ইতিহাস এত সমৃদ্ধ, চাইলেই দারুণ দারুণ সিরিজ করা যায়। কেন হচ্ছে না, সেটা আসলে বলতে পারব না। পাশাপাশি সাহিত্যধর্মী কাজ নিয়েও বলতে চাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এমন এমন ছোট গল্প বা উপন্যাস আছে, যেগুলো সব সময়ের জন্য আধুনিক। সেগুলো নিয়েও ভীষণ আক্ষেপ আছে, ঠিকঠাক পর্দায় উপস্থাপন করতে পারি না আমরা, যার কারণে জনপ্রিয় হয় না। বর্তমান যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঠিকঠাক পর্দায় আনতে পারলে নতুন প্রজন্ম আগ্রহ নিয়ে দেখত।

শুধু থ্রিলার দিয়ে চলা সম্ভব নয় (অনিন্দ্য বান্যার্জি হেড অব কনটেন্ট, চরকি)

ওটিটি যখন বিশ্বব্যাপী চালু হলো তারও আগে ভারতের টিভিএফ ইউটিউবে বেশ ভালো ভালো কনটেন্ট দিয়েছে। তারপর যখন ‘স্যাক্রেড গেমস’ হলো, থ্রিলার নিয়ে সবার আগ্রহ বেড়ে যায়। দর্শককে একটানা বসিয়ে রাখা যায় থ্রিলার সিরিজ হলে। যেটা অন্য জনরায় সম্ভব না। তবে শুধু থ্রিলার দিয়ে তো ওটিটি প্লাটফরম চলা সম্ভব না। দরকার ‘ফিলগুড’ সিনেমা, কমেডি বা নাটকীয় গল্প। কিন্তু এ জনরাগুলো বাংলাদেশের নাটকে বেশ জনপ্রিয়। দর্শক সাবস্ক্রাইব করে দেখতে চাইবে বড় পরিসরে ভিন্ন কিছু। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলি, আমাদের কাছে বেশ কিছু কমেডি পান্ডুলিপি এসেছে। পড়ে দেখি, বিশেষ কিছু দৃশ্যে হয় সেটা ভাঁড়ামি হয়ে যাচ্ছে নইলে জোর করাতে হাসতে হচ্ছে। কমেডি গল্পে ঘটনা কম কিন্তু দর্শকের আগ্রহ ধরে রাখার জন্য সেভাবেই উপস্থাপন করতে হয়। থ্রিলারে এ ব্যাপারটা নেই।  কিন্তু তাই বলে তো আমাদের ছেড়ে দেয়া যাবে না, যেখান থেকে আমাদের ‘মিনিস্ট্রি অব লাভ’-এর সৃষ্টি, এখানে কিন্তু কোনো থ্রিলার নেই। সবগুলোই প্রেমের গল্প, কোনোটা হয়তো জটিল আবার কোনোটা সরল। ইতিমধ্যেই তিনটা মুক্তি পেয়েছে। সিরিজের বেলায় আমার মনে হয়, ফিলগুড কনটেন্ট এক পর্ব থেকে আরেক পর্বে দর্শককে নিয়ে যাওয়ার যে চাপা উত্তেজনার প্রয়োজন, সে মুন্সিয়ানা এখনো আমরা রপ্ত করতে পারিনি। কোথাও যেন খামতি রয়ে গেছে। সেই খামতিটা পূরণে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। আরেকটা দিকের কথা বলতে চাই, ওটিটির দর্শক বলতে আগে শুধু তরুণদেরকেই ভাবা হতো, কিন্তু কোভিডের সময় দেখা গেল বাসায় বড় স্ক্রিনে পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে ফিকশন দেখছে। যার কারণে প্রাপ্তমনস্কদের ভেবে যেভাবে শুরু হয়েছিল, তা থেকে বেরিয়ে এসে পারিবারিক কনটেন্টও কিন্তু নির্মিত হচ্ছে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে সিরিজ নির্মাণ ব্যয়সাপেক্ষ, যেখানে ওটিটিতে মাত্র উত্থান বাংলাদেশে। তাই পূর্বে হয়নি, তবে আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে, শিগগিরই জানতে পারবেন। তবে এখন পর্যন্ত সিনেমাটি নিয়ে তেমন কোনো বক্তব্য দেননি পরিচালক বা নির্মাতা কেউ। জানিয়েছেন আগামী জুনেই মুক্তি পাবে এটি।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat